বাংলাদেশে মিডিয়া খাতে “আদানি মডেল”?

logo

আলী রীয়াজ

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার

বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাতের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা সীমিত বললেও বেশি বলা হয়। গণমাধ্যম নিয়ে বাংলাদেশে যত ধরনের গবেষণা কাজ হয় তাতে আধেয় বিশ্লেষণ (বা কন্টেন্ট এ্যানালাইসিস)-এর প্রাধান্য লক্ষণীয়। এই ধরনের কাজের গুরুত্বকে খাটো না করেও বলা যেতে পারে যে এতে করে গণমাধ্যম সেক্টরের পূর্নাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়না; অন্তত এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনা যে গণমাধ্যমের আধেয় কেনো এই রকম হয়। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে বোঝা দরকার গণমাধ্যমের মালিক কারা এবং এই ধরনের মালিকানার কাঠামো কেনো গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা বিষয়ে মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান এবং আমি ২০২১ সালের এক গবেষণায় যে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করেছিলাম তা হচ্ছে – প্রথমত গণমাধ্যমের, বিশেষত ইলেকট্রনিক মাধ্যমের, মালিকানা লাভের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা আবশ্যিক শর্ত; দ্বিতীয়ত এসব গণমাধ্যমের পরিচালকদের এক বড় অংশই হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা; অর্থাৎ একই পরিবারের সদস্যরা একই গণমাধ্যমের পরিচালক বোর্ডের সদস্য; মালিকানার এক বৃত্তচক্র। তৃতীয়ত এসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং মালিকেরা অন্যান্য এমন সব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যেগুলো কেবল বিতর্কিতই নয়, এই সব ব্যবসাখাতে বড় ধরনের ঋণ খেলাপিদের উপস্থিতি আছে এবং এইসব খাতে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বড় ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যম খাতের এই মডেল ক্ষমতাসীনদের প্রতি গণমাধ্যমের মালিকদেরই শুধু নয় গণমাধ্যমগুলোকেই ‘কৃতজ্ঞ’ করে রেখেছে।

গণমাধ্যমগুলোর ওপরে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ আরোপের এই মডেলের প্রধান বিষয় হচ্ছে গণমাধ্যমগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় রেখেই সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। সারা বিশ্বেই স্বৈরাচারী সরকারগুলো এই মডেলকেই অনুসরণ করে আসছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে অনেকগুলো গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মডেল। বাংলাদেশে এই ধরনের মডেল আমরা দেখতে পেয়েছি ব্যাংকিং খাতে। অন্যদিকে গণমাধ্যম সেক্টরে ভারতে এই মডেলের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে গৌতম আদানি।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে আদানী গোষ্ঠী এনডিটিভি কিনে নিলে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ভারতের ব্যবসা সংক্রান্ত ডিজিটাল খবরের প্ল্যাটফর্ম কুইন্টিলিয়ন বিজ়নেস মিডিয়ার ৫১% অংশীদারি কিনে নিয়েছে আদানী গোষ্ঠী। এতে করে বিকিউ প্রাইম তাঁদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বাংলাদেশের মিডিয়া সেক্টরে এই ধরনের পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্ত এই বিষয়ে গণমাধ্যমে আলোচনার অনুপস্থিতিও লক্ষ্য করার বিষয়। ব্যাংকিং খাতে এই মডেলের ব্যবহার গোটা খাতের জন্যে কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছে সে বিষয়ে সকলেই অবগত আছেন। তদুপরি যে গুটিকয় সংবাদপত্র এখনও সামান্য হলেও সরকারের জবাবদিহিতার বিষয়ে দায়িত্ব পালন করছে নির্বাচনের আগে সেগুলোর মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে যাবার ইঙ্গিত রাজনীতি এবং গণমাধ্যমের জন্যে নেতিবাচক।

[লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]