বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র-চীন মুখোমুখি

বাংলাদেশে চীনের নানামুখী কূটনৈতিক ও কৌশলগত তৎপরতায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। জুলাই বিপ্লবের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোরালো রাজনৈতিক সমর্থন, বন্দর ও পানি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হওয়া, সর্বোপরি বিএনপিসহ ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে টেকসই অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই তৎপরতাকে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য বড় হুমকি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং অন্যান্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চীনের তৎপরতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে জানানোর পাশাপাশি চীনের প্রভাব বলয় থেকে ঢাকাকে বেরিয়ে আসতে নানাভাবে চাপ তৈরি করছে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি ট্রেড নেগোসিয়েশনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার পেছনে চায়না ফ্যাক্টরই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ট্রেড নেগোসিয়েশনের সময়ে চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা কমানোর জন্য বাংলাদেশকে রীতিমতো চাপ দেওয়া হয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে সচেতন রয়েছে চীন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেছেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে ঢাকার সঙ্গে জোরালো অংশীদারত্ব অব্যাহত রাখবে বেইজিং। তিনি বলেন, সময় এসেছে বাংলাদেশকে তার প্রকৃত বন্ধু চিনে নেওয়ার। কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। চীন তার বেন্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের বলয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিযোগী দুই পরাশক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিষয়টি স্বীকার করে পররষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনৈতিক আমার দেশকে বলেছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থান এবং বাংলাদেশের জন্য তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ইস্যুতে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা কিছুটা লুকোচুরি করেছে। যার ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান জোট নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
এদিকে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেছেন, সাময়িক অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আমাদের অবশ্যই চীনের দিকে ঝুঁকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তান মডেলকে অনুসরণ করতে পারি। তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর। তিনি আমার দেশকে বলেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র একটি এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে চীনেরও একটি এজেন্ডা রয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে না কারো এজেন্ডার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া। বরং দুই দেশের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া উচিত বাংলাদেশের।
গত বছর জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ২০-২৪ জানুয়ারি বেইজিং সফর করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। ওই সফরেই তৈরি হয় ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের নতুন ভিত্তি। প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর আমন্ত্রণে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীনে যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২৬-২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ওই সফরটি ছিল কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের পক্ষ থেকে বিরল সম্মান জানানোর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি চীনের পক্ষ থেকে জোরালো রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন জানানো হয়। তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সার্বিক সহায়তার অঙ্গীকার করা হয়। মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা হয় চীনকে যা ছিল একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনের তৈরি ১৬টি জে-১০ সি মাল্টিরোল ফাইটার জেট কেনার প্রস্তাব করা হয়।
জে-১০ সি ফাইটার জেট কেনার প্রস্তাব মার্কিন প্রশাসনে উদ্বেগ তৈরি করে। এ ব্যাপারে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, আমরা শুনেছি বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান কিনতে যাচ্ছে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ। বাংলাদেশ কেন এই মুহূর্তে জে-১০ সি’র মতো যুদ্ধ বিমান কিনতে যাচ্ছে তা একটি বড় প্রশ্ন। তিনি আরো বলেন, এটা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
এদিকে গত ১৯ জুন চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়Ñ বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি ত্রিদেশীয় ফোরাম গঠনের জন্য একমত হয়েছে তিন দেশ। এই খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো ফোরাম গঠনের কথা অস্বীকার করা হলেও বিষয়টি নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে রীতিমতো ব্যাখ্যা চেয়ে বসেন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আমার দেশকে জানান, মার্কিন দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা এসে বৈঠক করে গেছেন। ত্রিদেশীয় জোটের ব্যাপারে তারা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে এখানে ঠিক কি হচ্ছে তা জানতে চান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, বিষয়টি পত্রপত্রিকায় যেভাবে এসেছে আসলে বিষয়টি তেমন নয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কৌশলগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব গড়ে তোলার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক ও অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে অব্যাহত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকের পাশাপাশি দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত ৭ নভেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপনের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে।
এরপর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে ২৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে যান। ওই প্রতিনিধি দলে বিএনপির পাশাপাশি তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ছিলেন।
সর্বশেষ গত ২২ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফরে যান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয় এই সফরের সময়ে।
অতীতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চীনের পক্ষ থেকে সম্পর্ক বজায় রাখা হলেও বাংলাদেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগই ছিল না। তবে বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতায় ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা কৌশলগতভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গত ২৭ নভেম্বর প্রথমবারের মতো চীন সরকারের আমন্ত্রণে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহম্মদ তাহের। এরপর গত ১১-১৫ জুলাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফর করেন। ওই সফরকে উভয়পক্ষ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, চীনের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার এবং শেখার রয়েছে। চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সিপিসি এবং জামায়াতের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে আমরা কাজ করছি।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এমনকি হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পর হেফাজত নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা দেখা করেছেন। তবে চীন অতীতে ইসলামপন্থি দলের ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। হঠাৎ করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা উদ্বেগ তৈরি করেছে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মাঝে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। তবে চীন ইস্যুতে ইউনূস সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে দ্বিধা করছে না মার্কিন প্রশাসন। বহুল আলোচিত ট্রেড নেগোসিয়েশনে চীন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নানা শর্ত মেনে চুক্তি করতে না পারলে আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর মনে করছেন, ট্রেড নেগোসিয়েশনে যা আলোচনা হচ্ছে সেখানে ট্রেডের তুলনায় ভূরাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা-ওয়াশিংটন ট্রেড নেগোসিয়েশনে থার্ড পার্টি হিসেবে চীন বসে আছে। সাদা চোখে সেটা হয়তো দেখা যাচ্ছে না।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র আমার দেশকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়েছে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি চীন থেকে আমদানি কমাতে হবে। বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে চীনা নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে ঢাকার ওপর ওয়াশিংটনের চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশের বন্দর, জেটি এবং জাহাজে ব্যবহৃত চীনের তৈরি লজিস্টিকস সিস্টেম ‘লগিঙ্ক’ (LOGINK) ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে জোরালোভাবে তৎপর হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন কূটনীতিকদের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন কূটনীতিকদের ব্যাপক তৎপরতা দৃশ্যমান। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করছেন মার্কিন কূটনীতিকরা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন গত কয়েকদিন আগে লন্ডনে গিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করে এসেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। ঢাকায় ফিরে জ্যাকবসন বৈঠক করেন জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমানের সঙ্গে। এসব বৈঠকে আগামী দিনের বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে।
চীনের প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা এবং মার্কিন প্রশাসনের উদ্বেগ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াং ওয়েন আমার দেশকে বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে ঢাকার সঙ্গে জোরালো অংশীদারত্ব বজায় রাখবে বেইজিং। বাংলাদেশের সামনে সময় এসেছে তাদের প্রকৃত বন্ধু চিনে নেওয়ার। তিনি বলেন, আমি আশা করি বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেবে। আমরা যা কিছু করছি তাই দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই করছি। এখানে অন্য কোনো দেশকে টার্গেট করে কিছু করা হচ্ছে না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র কেন তৃতীয় কোনো পক্ষকে টেনে আনে সেই প্রশ্ন সবার করা উচিত।
বাংলাদেশ প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র-চীন কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন নেগোসিয়েশনের নামে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যা করছে তাকে কোনোভাবেই কূটনীতিক বলা যাবে না। এটা স্রেফ মাস্তানি। তারা রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সাময়িক অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঝুঁকতে হবে। ভারত বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই বলে না। ভারতের হুমকি মোকাবিলায় চীনের বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো এখন যদি বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কমিয়ে দেয় তাহলে চীন আর কখনোই আমাদের বিশ্বাস করবে না। এটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। তিনি বলেন, আমাদের পাকিস্তান মডেল অনুসরণ করা উচিত। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের কী ধরনের সম্পর্ক তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র কাছে টানছে।
তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর। তিনি আমার দেশকে বলেন, ভূরাজনীতি খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে খুবই সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন আলাদা আলাদা এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কারো এজেন্ডার সঙ্গেই বাংলাদেশের সরাসরি যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না। দুই দেশই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তারা অনেক কিছুই চাইবে। কিন্তু আমরা সবকিছু দিতে পারব না। এই বিষয়টি দুই দেশকেই আমাদের সততার সঙ্গে জানানো উচিত। তাদের বলা উচিত আমরা এতটুকু করতে পারব, বাকিটা পারব না। বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।