বাংলাদেশে আদালতের কাঠগড়ায় লক্ষ মানুষ: নীরবে দমনের শিকার গণতন্ত্র

 আমার দেশ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

 ছবি কৃতজ্ঞতা: নিউ ইয়র্ক টাইমস

ছবি কৃতজ্ঞতা: নিউ ইয়র্ক টাইমস

মুজিব মাশাল / নিউ ইয়র্ক টাইমস

(আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বুর‍্যো চিফ মুজিব মাশাল বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে ইংলিশে প্রকাশিত নিবন্ধটির শিরোনাম হলো “কোয়ায়েটলি ক্রাশিং ডেমোক্রেসি: মিলিয়নস অন ট্রায়াল ইন বাংলাদেশ”। লেখাটির সূচনায় মুজিব জানান, এ লেখাটি সম্পন্ন করতে তিনি দুইবার বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। দেশটিতে বিদেশী সাংবাদিকদের উপর সরকারী বাধানিষেধ ক্রমাগতহারে বেড়েই চলেছে। আমার দেশ পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারুক আমিন।)

সতেরো কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। বহুদলীয় গণতন্ত্রকে এ দেশটির উঁপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা আদালত কক্ষগুলোতে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, কর্মী এবং সমর্থকরা প্রায় প্রতিদিনই বিচারকদের সামনে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সাধারণত অস্পষ্ট। এসব মামলার স্বাক্ষ্য-প্রমাণগুলোকে ভদ্রভাষায় বললে বলা যায় ভুয়া। কিন্তু এসবের মাধ্যমে তাদেরকে যে স্থবির করে ফেলা হচ্ছে, তা অন্তত পরিষ্কার। এ সবই ঘটছে এমন এক সময়ে যখন জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস বাকি রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামার কথা।

এক হিসেবে দেখা যায়, দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পঞ্চাশ লক্ষ সদস্যের অন্তত অর্ধেক সংখ্যক মানুষ বর্তমানে রাজনৈতিক মামলার শিকার। দলটির যেসব নেতা ও সংগঠকরা মাঠে সক্রিয় ছিলেন, তাদেরকে কয়েক ডজন এমনকি কয়েক শত মামলারও আসামী হতে হয়েছে। রাস্তা কাঁপানো মিছিল কিংবা রাতে দেরী করে হলেও দলীয় পরিকল্পনার বৈঠকে যাদের ব্যস্ত থাকার কথা ছিলো, তারা এখন ব্যস্ত আইনজীবীদের চেম্বার এবং আদালতের খাঁচায়। অথবা ব্যস্ত এ দুই জায়গার মাঝে ছুটাছুটি করতে, ঢাকার বেদনাদায়ক শম্বুকগতির ট্রাফিক জ্যামে আটকা অবস্থায়।

সম্প্রতি এক সকালে সাইফুল আলম নীরব নামে এক রাজনৈতিক নেতাকে আদালতে আনা হয়। ঢাকার এ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবনটি দশ তলা। নীরব মোট ৩১৭ থেকে ৩৯৪ টি মামলার আসামী। এমন কি তিনি নিজে অথবা তার আইনজীবীরাও তার বিরুদ্ধে আনিত মামলার সঠিক সংখ্যাটি নিশ্চিত করে জানেন না। এ সময় আদালতের বাইরে সরু চলাচলের পথে অপেক্ষা করছিলো প্রায় এক ডজন সমর্থক। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা হবে আরো চারশ’র মতো। একটু পরপর ছিটে আসা আসা বৃষ্টির ধারা অথবা অন্য কোন রাজনৈতিক আসামীকে নিয়ে আসা পুলিশের হুইসেল তাদেরকে একটু পর পরই সরিয়ে দিচ্ছিলো।

আবদুস সাত্তার নামে একজন সমর্থকের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, “আমি এখন আর কোন কাজ করতে পারিনা। আমাকে সবসময় এক মামলা থেকে আরেক মামলার জন্য দৌড়াতে হয়।“ আবদুস সাত্তার বর্তমানে ৬০ টি মামলার আসামী। প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে চারদিন তাকে আদালত প্রাঙ্গণে কাটাতে হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সফলতার উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটেছে। মূলত রপ্তানীনির্ভর গার্মেন্টস সেক্টরের উপর নির্ভর করে এই সফলতার গল্পটি ঘটেছে। দেশটিতে বিদেশী মুদ্রার নিয়মিত সরবরাহ এনেছে এই সেক্টর। অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। যে দেশটিকে এক সময় আমেরিকান সরকারী কর্মকর্তারা দুর্ভিক্ষ ও জরায় জীর্ণ ঝুড়ি হিসেবে অভিহিত করতো, দশকের পর দশক যাবত ঘটে চলা অভ্যুত্থান – পাল্টা অভ্যুত্থান এবং অতর্কিত হত্যার ইতিহাস থেকে দেশটি শেষপর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে বলেই মনে হয়।

কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ, গবেষক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মতামত অন্যরকম। তারা মনে করেন, উপর থেকে দেখা দৃশ্যমান এ পরিস্থিতির আড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একটি রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন যার মূল উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিকে একদলীয় শাসনে নিয়ন্ত্রিত দেশে পরিণত করা।

ক্ষমতায় থাকার বিগত চৌদ্দ বছরে তিনি বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের বিশ্বস্ত লোকজন দিয়ে পূর্ণ করেছেন। পুলিশ, মিলিটারি এবং ক্রমবর্ধমান হারে বিচারব্যবস্থা এখন এ ধরণের অনুগত মানুষে ভর্তি। কেউ যদি এই আনুগত্য পালন না করে তাহলে তার পরিণতি কেমন হতে পারে, তাও তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন।

তিনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কোন বিরোধীতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার কাজে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি গভীর ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপূর্ণ ক্যাম্পেইন চালিয়ে দমন করেন। তার শিকার হওয়া মানুষদের মাঝে আছেন অনেক শিল্পী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। এমন কি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস ও বাদ যাননি।

আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারী মাসে নির্বাচন হওয়ার কথা, এমন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে দেশটি যেন আবারও ফুঁসে উঠতে উদগ্রীব। বিরোধী দলগুলো মনে করছে এ নির্বাচনই হবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ যুদ্ধ। অন্যথায় তাদেরকে হয়তো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ল্যাফটেনেন্টরাও পরিষ্কার বলে দিয়েছে তারা বিএনপিকে এ নির্বাচনে বিজয়ী হতে দেবে না। “তারা আমাদেরকে হত্যা করবে”, যদি তারা ক্ষমতায় আসে – এমনটাই হলো তার এক সহকর্মীর বক্তব্য।

যখন শেখ হাসিনাকে তার ঢাকা অফিসে বিরোধীদের দমন করতে বিচারবিভাগকে ব্যবহার করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, তিনি তার এক সহকর্মীকে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি ছবির এলবাম নিয়ে আসার জন্য পাঠালেন। এই এলবামটি ভয়ংকর সব ঘটনার এক সংগ্রহ। আগুন ও বোমা সহ নানা ধরণের আঘাতে বিকৃত হয়ে যাওয়া মানবদেহের বীভৎস সব ছবি।

“এটি কোন রাজনৈতিক বিষয় না”। প্রধানমন্ত্রী এ বাক্যটি দুইবার বললেন। তিনি এই সব ভয়াবহ ছবিগুলোকে বিএনপি’র নিষ্ঠুরতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে আদালতের মামলাগুলো প্রসঙ্গে বলেন, “মামলাগুলো তাদের করা এসব অপরাধের কারণেই হচ্ছে।“

অন্যদিকে বিএনপি’র নেতারা বলছেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাদের দলের অন্তত ৮০০ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪০০ ‘রও বেশি নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। স্বাক্ষাতকারে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তারা তার দলের লোকদের সাথে একই কাজ করেছিলো। তখন তার দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো এবং হত্যা করা হয়েছিলো।

শেখ হাসিনা বলেন, “এসব কাজ তারাই শুরু করেছে।“

বেঁচে যাওয়া মানুষদের উপাখ্যান

গত তিন দশক জুড়ে বাংলাদেশের কাহিনী হলো মূলত: দুই প্রভাবশালী নারীর মাঝে তিক্ত প্রতিদ্বন্ধীতার উপাখ্যান। যার একদিকে আছেন পঁচাত্তর বছর বয়সী শেখ হাসিনা, অন্যদিকে সাতাত্তর বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি বিএনপি’র নেত্রী এবং দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কালে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পৃথক ও স্বাধীন হওয়ার চার বছর পর তিনি এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এ সময় তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই নির্বিচার হত্যার শিকার হন।

অন্যদিকে বেগম জিয়া ছিলেন জিয়াউর রহমানে স্ত্রী। শেখ মুজিবকে হত্যা পরবর্তী রক্তাক্ত এবং বিশৃংখলাপূর্ণ পরিস্থিতির মাঝে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। জিয়া নিজেও ১৯৮১ সালে সৈনিকদের হাতে নিহত হন।

এর পরের বছরগুলোতে বেশিরভাগ সময় জুড়ে এই দুজন বেঁচে যাওয়া নারী পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের মাঝে কে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নির্ধারণ করবেন, এবং এই শাসনের জন্য কে বেশি হকদার – এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছেই।

শেখ হাসিনা বলেন, “মূলত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই আমি সংগ্রাম করছি।“ বেগম জিয়ার স্বামীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি যোগ করেন, “আপনি নিশ্চয় জানেন এক সামরিক স্বৈরশাসক এই বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেছিলো।“

অথচ বিএনপির ভাষ্য হলো তারাই সে দল, যারা শেখ হাসিনার পিতা কর্তৃক দেশটিতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বিএনপির মতে, শেখ হাসিনা তার পিতার সেই একদলীয় শাসন চালু করার অসমাপ্ত প্রকল্প পূর্ণ করার জন্য এখন সংকল্পবদ্ধ।

“তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসই করে না,” বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এটি।

২০১৮ সালে বেগম জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় কারাদন্ড দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি নিজ গৃহে কারান্তরীণ অবস্থায় আছেন। তাঁর সহকর্মীদের ভাষ্য হলো তাকে শুধুমাত্র টেলিভিশন দেখা ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। অথচ তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটছে।

তাঁর পুত্র তারেক রহমান এখন লন্ডনে নির্বাসিত। ২০০৪ সালে এক মিছিলে শেখ হাসিনার দিকে এক ডজন গ্রেনেড ছুঁড়ে আক্রমণের ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত, যে অভিযোগ বিএনপি সবসময় প্রত্যাখ্যান করে আসছে। মা ও পুত্রের অনুপস্থিতিতে দলের নেতা হিসেবে মূলতঃ দায়িত্ব পালন করা মীর্জা আলমগীর নিজেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন ৯৩ টি মামলার মোকাবেলা করার কাজে।

অনেকগুলো বছরের মাঝে বর্তমানে শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছেন, এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিরোধীদের উপর আক্রমণ আরো বেশি শাণিত করছেন।

করোনা মহামারীজনিত কারণে আন্তর্জাতিক চাহিদা কমে যাওয়ার বিপর্যয় শেষে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প যখন ব্যবসায়িক ধকল সামলে উঠছিলো, ঠিক তখনই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে আমদানিকৃত জ্বালানী ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশটির ডলার সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়।

শেখ হাসিনা বলেন, “এই ঘটনা আমাদের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।“

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং লোডশেডিং এর কারণে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিকে ইতিমধ্যেই কাহিল হয়ে যাওয়া বিরোধী দল একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। শেখ হাসিনা যেহেতু নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার প্রশাসন নিযুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন, সুতরাং একটি সাজানো নির্বাচনের আশংকা থেকে তারা রাজপথে শোডাউন করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে।

জুন মাসে এক বিশাল সমাবেশে বিএনপি’র বক্তারা অবাধ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী তুলেন। কিন্তু ঢাকার রাস্তাগুলোতে সমর্থকদের মিছিলে ধ্বনিত হওয়া শ্লোগানে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তারা স্লোগান দিচ্ছিলো: “শেখ হাসিনার গদিতে, আগুন জ্বালাও এক সাথে,” এবং “রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়।“

পুলিশ এ সময় কিছুটা পিছু হটে এবং মিছিলগুলোকে রাস্তায় চলার সুযোগ দেয়। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও একই রকম সভার আয়োজন করে। এ সভার বক্তব্যে তারা স্বীকার করেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আমেরিকান সরকার শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু অফিসারদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং বিভিন্ন ভিসা রেস্ট্রিকশন আরোপের হুমকি দিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকজন আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান সরকারী কর্মকর্তাও বাংলাদেশ সফর করেছেন।

টালমাটাল একটি পরিস্থিতিতে থাকা সত্ত্বেও বিএনপি’র ঐ সমাবেশের কয়েক সপ্তাহ পরে শেখ হাসিনা শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নেন। দলটির নেতাকর্মীরা আরেকটি সমাবেশ আয়োজনের চেষ্টা করেছিলো। এবার পুলিশ লাঠি ও টিয়ার গ্যাস দিয়ে তাদেরকে দমন করে। সাথে যোগ হয় ৫০০ টি নতুন মামলা। এ ক্র্যাকডাউন থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে পশ্চিমা দেশগুলো যতই হুমকি দিক না কেন, আঞ্চলিক দুই শক্তি চীন ও ভারতকে চতুরভাবে এক সাথে মানিয়ে চলা একজন নেতার উপর তাদের কার্যকর প্রভাব খুব বেশি একটা নেই।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের একজন কর্মী আশরাফ জামান বলেন, সরকারের দমন করার ঘটনাগুলো বিপুলভাবে বেড়েই চলছে। তিনি নির্বাসনে থাকা একজন বাংলাদেশী আইনজীবী এবং একটিভিস্ট। তিনি জানান, পুলিশ এক একটি মামলায় অসংখ্য মানুষকে আসামী করে। তাদের বিরুদ্ধে “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড” অথবা পুলিশের কাজে বাঁধা প্রদানের অভিযোগ আনা হয়। এই মামলাগুলোতে “অজ্ঞাতনামা” আসামী হিসেবে উল্লেখ করে পরবর্তীতে কয়েক ডজন এমন কি কয়েক শত মানুষকেও ভবিষ্যতে আসামী হিসেবে যুক্ত করার সুযোগ রাখা হয়। এসব মামলার প্রতিটিতেই একাধিক অভিযোগ যোগ করা হয়।

অনেক মানবাধিকার কর্মী জানিয়েছেন এসব মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বানোয়াট এবং দুর্বল প্রকৃতির হয়। মামলাগুলো যতদিনে একজন বিচারকের সামনে উপস্থাপন করা হয়, ততদিনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বেশ কয়েক মাস জেলে বন্দী অবস্থায় কাটিয়ে ফেলেন। বিভিন্ন আইনজীবী এবং আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক মামলাগুলোতে জামিন পাওয়া বর্তমানে অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। যদি কোনভাবে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেয়েও যায়, তখন সরকার এই ঘটনাকে বিশাল করুণা হিসেবে উপস্থাপন করে। যেখানে ঐ মানুষটির গ্রেফতার হওয়াটাই উচিত ছিলো না, কিন্তু এ বিষয়টি তারা স্বীকার করেনা।

জামান বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এখন আদালতে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, “তাদের মক্কেলের একটি পরিবার রয়েছে, তিনি ইতিমধ্যেই দীর্ঘসময় কারাগারে কাটিয়েছেন, সুতরাং আপনি যদি দয়া করে তাকে জামিন দেন তাহলে তারা কৃতজ্ঞ থাকবে। এবং তখন সরকারপক্ষের উকিল তাতে ‘সম্মতি’ দেয়।“

আদালত

রাজনৈতিক মামলাগুলোর কাজে তুমুল ব্যস্ত একটি জায়গা হলো ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। বিএনপি নেতা এবং ৩০০ টিরও বেশি সংখ্যক মামলার আসামী নীরবকে জুন মাসের এক সকালে এখানে আনা হয়। নীরবের আইনজীবী সৈয়দ নজরুল জানান, শহরের প্রতিটি থানাতে তার এ মক্কেলের নামে অন্তত একটি হলেও মামলা দায়ের করা রয়েছে।

প্রতিদিন সকালে মামলার কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে প্রায় এক ডজন আইনজীবী বার এসোসিয়েশন বিল্ডিং এর ২০৫ নাম্বার কক্ষটিতে জড়ো হন। এ সময় সৈয়দ নজরুল শেষবারের মতো কাগজপত্রগুলোতে চোখ বুলান। জুন মাসের ১২ তারিখে এই অফিসের দৈনন্দিন কার্যক্রমের খাতায় দেখা যায় আইনজীবীদের দলটি সেদিন ৩৩ টি মামলার কার্যক্রমে অংশ নিতে যাচ্ছিলো। যার মাঝে ৩২ টি মামলায় বিএনপি জড়িত।

এরপর আইনজীবীরা সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। রাস্তাটি হকারদের ভীড়ে পরিপূর্ণ, তারা মুরগি থেকে শুরু করে গাঁদা ফুল অথবা নকল দাঁত, এমন অসংখ্য জিনিস বিক্রি করছে। বার এসোসিয়েশন ভবন থেকে এ রাস্তাটি দিয়েই জনাকীর্ণ আদালত ভবনে যেতে হয়।

আইনজীবী নজরুল বলেন, “একটি শুনানীতে সর্বোচ্চ বিশ মিনিট সময় লাগে। এর বাইরে বাকি পুরো দিন এ হয়রানিতে যাওয়া আসা করতেই ব্যয় হয়।“

দুই রাজনৈতিক দলের তিক্ত এ প্রতিদ্বন্ধীতার বাইরে অন্য কোন উদ্দেশ্য বা দাবী নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদেরকেও বর্তমান সময়ে বিপুল মূল্য চুকাতে হচ্ছে।

পেশাগত জীবনে দীদারুল ভুঁইয়া কম্পিউটার প্রকৌশলী। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা শেষে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। তিনি একটি ছোটখাটো সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, বিয়ে করেন এবং তিন সন্তানের পিতাও হয়েছেন। কিন্তু এখন একটি প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়: দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি কি ঠিক কাজ করেছিলেন?

ভুঁইয়া একটি সুশীল সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন। তাদের সংগঠনটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদ্ধতির সংস্কারের উদ্দেশ্যে কাজ করছে। তার চাওয়া হলো, যেন তার সন্তানদেরকে ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে জীবন কাটাতে না হয়। “যারাই ক্ষমতায় আসে, তারাই আইনের উর্ধ্বে উঠে যায়,” তিনি বলেন।

করোনা মহামারীর সময় ত্রাণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভুঁইয়ার সংগঠনটি সমালোচনা করার পর একদিন কালো কাঁচের একটি মাইক্রোবাসে করে এসে সাদা পোষাক পরিহিত নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়।

তাঁর স্ত্রী দিলশাদ আরা বেগম বলেন, “বাংলাদেশে গুম হয়ে যাওয়া খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। তার কি হবে তা নিয়ে আমরা অনেক উদ্বিগ্ন ছিলাম।“

ভুঁইয়ার স্ত্রী তাঁর স্বামীর জামিনের আবেদন নিয়ে আদালত থেকে আদালতে ঘুরছিলেন, কিন্তু তার মামলাটির শুনানি করতে বারবার অস্বীকৃতি জানানো হয়। যদিও সরকার তখনো ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযোগ দায়ের করেনি।

ভুঁইয়ার স্ত্রী বলেন, “বিচারক একবার আসামীর নাম দেখেন, তারপর মামলার কাগজপত্র দেখেন, এবং বলেন ‘দু:খিত, আমি এটি পারবো না।“

কারাগারে পাঁচ মাস কাটানোর পর শেষপর্যন্ত ভুঁইয়ার জামিন হয়। তাঁর গ্রেফতারের প্রায় এক বছর পর গিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এ অভিযোগটিও অস্পষ্ট ধরণের। রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এ মামলার মূল প্রমাণ হিসেবে ভুঁইয়ার লেখা একটি ফেইসবুক পোস্টকে পুলিশ দাখিল করেছে, অথচ তিনি সে পোস্টটি লিখেছেন জামিনে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাস পর। প্রমাণ হিসেবে যে স্ক্রিনশটটি জমা দেয়া হয়েছে তার টাইমস্ট্যাম্পে দেখা যায় এটি দাখিলের তিন ঘন্টা আগে নেয়া হয়েছে।

দীদারুল ভুঁইয়ার গ্রেফতারের কাছাকাছি সময়ে আরেকজন একটিভিস্ট মুশতাক আহমেদকেও গ্রেফতার করা হয়েছিলো তিনি কারাগারে মারা যান। ভুঁইয়ার হোম-অফিসে ড্রয়ারের উপর মুশতাকের একটি বড় আকৃতির ছবি রাখা আছে।

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে দীদারুল ভুঁইয়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, “কোন ধরণের বিচার কার্য ছাড়াই কাউকে দশ মাসের জন্য কারাগারে আটকে রাখা তাকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।“