
গোলাম সোহরাওয়ার্দি
বাংলাদেশের যেকোনো বাণিজ্যিক জাহাজে ক্যাডেট অফিসার হিসেবে কাজ করার জন্য কনটিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (সিডিসি) গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৩ সালের মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্সের অধীনে সরকারের শিপিং অফিস এই সনদ দিয়ে থাকে। এই সিডিসি সনদ পেতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই স্বীকৃত কোনো নৌ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাক-সাগর প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয়। অনুমোদিত ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেটও দরকার পড়ে। একই সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ডস অব ট্রেইনিং, সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ওয়াচকিপিংয়ের (এসটিসিডাব্লিউ) অধীনে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কোর্স শেষ করতে হয়। এরপর দরকার পড়ে মেয়াদসহ পাসপোর্ট, নাগরিকত্বের সনদ এবং অন্তত দশম গ্রেড পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা।
এর আগে, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির (বিএমএ) মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদেরই শুধু সিডিসি সনদ দেওয়া হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। সরকার বহু নতুন একাডেমিকে অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এই শ্রেণির ক্যাডেটদের জন্য চাকরির সুযোগ কমে এসেছে। গত ১৫ বছরে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সামুদ্রিক খাতের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্তের কারণে যোগ্য গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি পাওয়াটাও কঠিন হয়ে গেছে। প্রক্রিয়াটা এখনো সেকেলে রয়ে গেছে। তা ছাড়া হুটহাট নীতি গ্রহণ বা বদলানোর কারণে যোগ্য ক্যাডেটদের চাকরিটাও অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
২০২৫ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী, বিএমএসহ অন্যান্য স্বীকৃত স্কুল থেকে ২০২৪-এর ডিসেম্বরে যারা গ্র্যাজুয়েশন করেছে, এ ধরনের ৭৫০ ক্যাডেটের মধ্যে মাত্র ৪০ জনের মতো গ্র্যাজুয়েট জাহাজে জায়গা করে নিতে পেরেছে। জাহাজে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের জন্য অনেককে দুই বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিতর্কিত একটি নিয়ম করা হয়েছে, যেখানে অননুমোদিত পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমাধারীরাও এখন সিডিসি সনদ পেতে পারে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এসটিসিডব্লিউয়ের স্ট্যান্ডার্ড ধ্বংস করা হয়েছে। তা ছাড়া বৈশ্বিক নৌ-কমিউনিটিতে বাংলাদেশের যে সুনাম ছিল, সেটিকে ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এ সমস্যা সমাধানে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং জাহাজ পরিবহন দপ্তরকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক খাতের অনেক সমস্যা রয়েছে। একটা বড়সংখ্যক ক্যাডেট জাহাজে তাদের উপযুক্ত জায়গার জন্য অপেক্ষায় আছে। এই বিলম্বের কারণে তাদের ক্যারিয়ারের বিকাশ থমকে যাচ্ছে। শিক্ষার পেছনে বিপুল ব্যয় করার পর তরুণরাও আশা হারিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে, যেসব ক্যাডেট দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, তাদের দরিদ্রতার সুযোগ নিচ্ছেন নীতিবর্জিত জনবল সরবরাহকারী এজেন্টরা। জাহাজে জায়গা নির্ধারণের জন্য এই এজেন্টরা অবৈধভাবে ফি নিচ্ছেন ক্যাডেটদের কাছ থেকে।
এই খাতে বহু অতিরিক্ত ক্যাডেট রয়েছেন। কারণ যত চাকরি আছে বা প্রশিক্ষণের জন্য যত শূন্যপদ আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থী নেয় স্কুলগুলো। বৈশ্বিক শিপিং চাহিদার ভিত্তিতে পরিকল্পনা না নিলে এই ফারাক বাড়তেই থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এসটিসিডব্লিউ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, সেখানকার গ্র্যাজুয়েটদের সিডিসি দেওয়া হলে পুরো সনদের প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ ও দুর্বল হয়ে যাবে। এতে করে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত হতে পারে। পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল তখন পরিদর্শন প্রক্রিয়াকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। সমুদ্র গমনেচ্ছুদের জন্য চাকরির সুযোগও তখন কমে আসবে।
ক্ষতিটা শুধু চাকরির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। কিছু দেশ এরই মধ্যে বাংলাদেশি প্রার্থীদের জন্য ভিসা সীমিত করে দিয়েছে। এসটিসিডব্লিউ নিয়ম ভাঙলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরো বড় নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। দেশের সুনামও ক্ষুণ্ণ হবে। বাংলাদেশিরা সে ক্ষেত্রে বৈশ্বিক শিপিং চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে। এর মাধ্যমে ভুয়া সনদ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
এ সমস্যা সমাধানে সরকারের নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিতÑ
১. ক্যাডেট ভর্তির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা : অনুমোদিত স্কুলগুলো বছরে কতসংখ্যক শিক্ষার্থী নিতে পারবে, তার সীমা ঠিক করে দেওয়া। জাহাজে বিদ্যমান সুযোগ ও বৈশ্বিক চাকরির চাহিদা বিশ্লেষণ করে এই সীমা নির্ধারণ করতে হবে। জাহাজ পরিবহন দপ্তরের সঙ্গে মিলে এ বিষয়ে সতর্ক পরিকল্পনা নিতে হবে।
২. জনবল সরবরাহকারী এজেন্টদের ওপর নজরদারি : জনবল সরবরাহকারী এজেন্টদের জন্য শক্ত নিয়ম করতে হবে। তাদের উপযুক্ত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে লাইসেন্স দিতে হবে, তাদের কাজ যাচাই করতে হবে এবং নিয়ম ভাঙলে শাস্তি দিতে হবে। ক্যাডেটদের নিয়োগের জন্য একটি জাতীয় অনলাইন পোর্টাল তৈরি করতে হবে। সেখানে অভিযোগ গ্রহণ ও সেগুলো সুরাহার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৩. বিতর্কিত আইন বাতিল করতে হবে : এসটিসিডব্লিউর স্ট্যান্ডার্ডের বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ক্যাডেটদের সিডিসি দেওয়া বাতিল করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখতে পারবে।
৪. আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা : সরকারকে অন্যান্য দেশ ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে, যাতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন জাহাজে আরো প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
৫. এসটিসিডব্লিউ মানদণ্ড যাচাই করুন : স্বাধীন একটি গ্রুপকে নিয়োগ করুন, যারা যাচাই করে দেখবে, বাংলাদেশের সামুদ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসটিসিডব্লিউ মানদণ্ড কতটা মেনে চলছে। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং বিদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
মৎস্য একাডেমিকে ঢেলে সাজানো
সংকট শুরু হয়েছে নীতি পরিবর্তনের পর। যেমন : বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমিকে (বিএমএফএ) বাণিজ্যিক জাহাজের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিএমএফএ ১৩০০-এর বেশি শিক্ষার্থীকে গ্র্যাজুয়েশন দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল মৎস্য খাতকে সহায়তা করা। কিন্তু গ্র্যাজুয়েটদের অনেকেই এখন বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করছে। এতে বিএমএ ক্যাডেটদের সঙ্গে তাদের একটা অন্যায্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তা ছাড়া সম্পদের অপব্যবহারের কারণে মৎস্য খাতও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বিএমএফএকে তাদের নিজস্ব কাজের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। টেকসই মৎস্যসম্পদ, মেরিন বাস্তুবিদ্যা এবং এ-সংক্রান্ত খাতে তাদের নজর দিতে হবে। এতে তাদের আসল উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং শিপিং চাকরি বাজারের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমবে। প্রধান উপদেষ্টার অফিস, জাহাজ পরিবহন ও মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলো অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে একটা সুস্পষ্ট ক্যারিয়ারের কাঠামো তৈরি করা যায় এবং প্রত্যেক খাতের জনবলকে যাতে সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগানো যায়।
মেরিন একাডেমি সম্প্রসারণের যৌক্তিকতা
সরকার সম্প্রতি বিএমএ মডেলের অনুকরণে সিলেট, রংপুর, পাবনা এবং বরিশালে নতুন মেরিন একাডেমি চালু করেছে। এই স্কুলগুলোয় অভিজ্ঞ শিক্ষক ও স্টাফের ঘাটতি রয়েছে। ফলে ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে দুর্বল। এসব স্কুল থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সংগ্রাম করতে হয়।
সরকারকে তাদের কৌশল বদলাতে হবে। দুর্বল একাডেমির সংখ্যা না বাড়িয়ে কতগুলো প্রতিষ্ঠানকে ভোকেশনাল স্কুলে রূপান্তরিত করা যায়, যেখানে ডেক ও ইঞ্জিনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিএমএকে অর্থায়নের দিকে জোর দেওয়া দরকার যাতে তারা বছরে এক হাজারের মতো বিশ্বমানের ক্যাডেট তৈরি করতে পারে। সম্পদের সমন্বয় করা গেলে উন্নত গ্র্যাজুয়েট বেরিয়ে আসবে এবং আন্তর্জাতিক মেরিটাইম কমিউনিটিতে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হবে।
সামুদ্রিক খাতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশিক্ষণ স্কুলে সংস্কার আনতে হবে, নজরদারির প্রক্রিয়া হালনাগাদ করতে হবে এবং বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার মান ঠিক করতে হবে। পরিব্রাজক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান বলেছিলেন, সমুদ্র বিপজ্জনক, কিন্তু এর যে সম্ভাবনা, সেটা আরো বেশি মূল্যবান। অবহেলা, অদক্ষতা, বা সেকেলে নীতি দিয়ে এই সম্ভাবনার খাতকে অবশ্যই ধ্বংস করা যাবে না। স্মার্ট পরিবর্তন আনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সামুদ্রিক খাতকে আরো শক্তিশালী করতে পারবে। দেশের সমুদ্র গমনেচ্ছুদের জন্য আরো ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক