জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র পূর্বনির্ধারিত শুনানিতে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ করেছেন পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিনিধিরা। তারা বাংলাদেশ পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করেছেন। অবশ্য পশ্চিমা দুনিয়ার অবজারভেশনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শ্রমখাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশি ভারত এবং কৌশলগত অংশীদার চীন। কাছের এবং দূরের দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাংলাদেশের চলমান উদ্যোগগুলোর ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। মঙ্গলবার জেনেভায় আইএলওর চলতি ৩৫০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত পর্যালোচনা বা শুনানি হয়। বাংলাদেশের পক্ষে শুনানি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক। তিনি আইএলও ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা সবিস্তারে তুলে ধরেন। পরে বিভিন্ন দেশ, জোট, সংগঠন ও আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সদস্যসহ ২৪ জন বাংলাদেশের জমা করা আগাম প্রতিবেদনেরের ওপর পর্যবেক্ষণ দেন। আইনমন্ত্রী সেসব পর্যবেক্ষণ এবং তৎপ্রেক্ষিতে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব তথা পাল্টা বক্তব্য দেন। শুনানিতে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিনিধিরা মোটাদাগে বাংলাদেশে শ্রম অধিকার চর্চার দ্বার উন্মুক্তকরণ, শ্রমিকদের ওপর হামলা-নির্যাতন বন্ধ এবং শ্রম আইনের দ্রুত সংস্কারের সুপারিশ করেন।
জবাবে আইনমন্ত্রী আইন সংশোধনে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, শ্রমমানের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর সুফল দৃশ্যমান হতে খানিকটা সময় লাগছে। এ অবস্থায় গৃহীত উদ্যোগের যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে আইএলও সহ আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সঙ্গে বাংলাদেশের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে! প্রায় দুই ঘন্টার ওই শুনানিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি। তবে আইএলওর পরিচালনা পরিষদে মালিকদের প্রতিনিধি এবং ভারত, চীন, সৌদি আরব, ইরানসহ অনেক দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ আইএলও সনদ অনুসরণ না করছে না মর্মে পশ্চিমারা যে অভিযোগ এনেছেন, তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা আইনমন্ত্রীও প্রশ্নোত্তর পর্বে পশ্চিমা অভিযোগ খন্ডনের চেষ্টা করেন এবং সনদ না মানা সংক্রান্ত অভিযোগ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
উল্লেখ্য, মৌখিক শুনানির আগে বাংলাদেশের শ্রমমানের বিস্তারিত তুলে ধরে আইএলওতে একটি লিখিত প্রতিবেদন জমা দেয় ঢাকা। বাংলাদেশের সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইএলও আগাম কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়। ৮ মার্চ প্রকাশিত ওই পর্যবেক্ষণে আইএলও বলেছে, সামগ্রিকভাবে ২০২১ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে আইএলওর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে জোরালো অঙ্গীকার প্রকাশ করেছে। শ্রম আইন সংস্কারে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সরকার ও অংশীজনদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা এগিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইএলওর কারিগরি সহায়তা এবং মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। জমাকৃত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বলেছিলো আইএলওসহ সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই অনুযায়ী শ্রম আইন সংশোধন বিলটি শুরুতে মন্ত্রিসভা ও পরে বিগত সরকারের সংসদের শেষ অধিবেশনে বিল প্লেস করা হয়। এরপর বিলটি প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিলটি ফেরত পাঠান। ফলে এটি সেখানেই আটকে যায়। চলমান দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংশোধন বিলটি উত্থাপিত হতে পারে জানিয়ে জমাকৃত বাংলাদেশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শ্রম অধিকার ও নিরাপত্তাসহ এ খাতের সংস্কারে গৃহীত ২০২১-২০২৬ রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। শ্রমখাতের প্রশাসনিক, আইনি ও নীতিগত সংস্কারগুলো নিয়ে সাম্প্রতিক অগ্রগতির প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, মজুরি, দক্ষতার উন্নয়ন এবং শ্রমকল্যাণ। সম্প্রতি আইএলওর পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে তাতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সরকারের সময়মতো গৃহীত এসব উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে। শ্রম খাতের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজীকরণ, অনলাইনে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ, আরও শ্রম আদালত গঠন, হেল্পলাইন স্থাপন, পুরোনো মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, সচেতনতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের অগ্রগতির বিস্তারিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। স্মরণ করা যায়, আইএলও শিল্পকারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের নিবন্ধনের হার ১০ শতাংশ করতে চায়। এ নিয়ে সরকারের তরফে অনাপত্তি রয়েছে। সরকার মনে করে- বিষয়টি শ্রমিক ও মালিকপক্ষে আলোচনায় ঠিক হোক। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শ্রম পরিদর্শন, সমাবেশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে আইএলও এখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের তাগিদ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশও পূর্বনির্ধারিত ২০২৬ সালের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শ্রম আইন সংশোধনের বদ্ধপরিকর। প্রসঙ্গত: গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আইএলও’র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে হাইব্রিড ফরমেটে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে তাড়াহুড়ো নয়, বরং এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে। এতে আইনটি ভাল হবে। আইএলও-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তুওমো পাউটিয়াইনেন, প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীরন রামজুথান, টেকনিক্যাল অফিসার চয়নিচ থামপারিপাত্র, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মো. সাইদুল ইসলাম, প্রোগ্রাম অফিসার চৌধুরী আলবাব কাদিরসহ আইন মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সচিবালয়ের সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জেনেভা থেকে আইএও’র ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলো।
জেনেভার মঙ্গলবারের শুনানিতে যে যা বললেন-
বাংলাদেশ নিয়ে জেনেভায় মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত শুনানিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষিতে কেন শ্রম আইনের সংশোধন করা গেলো না- তা ব্যাখা করেন। সংসদের আগামী অধিবেশনে তিনি শ্রম আইন সংশোধনে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মন্ত্রী জানান, শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যার চার্জশিট প্রস্তুত, দ্রুতই সম্পন্ন হবে বিচার কাজ। আনিসুল হক বলেন, শ্রম খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশকে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এ খাতে সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে সেটির প্রশংসা করা প্রয়োজন। শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের পরিচালক জেফরি ভগ্ট বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ততার স্বাধীনতা নেই। দরকষাকষিতে যুক্ততার হার খুবই কম। শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। নারী কর্মীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের শ্রম আইনে যে সংস্কার হয়েছে তা একেবারেই নুন্যতম। বিশেষ করে শ্রম অধিকার চর্চার নুন্যতম শর্ত রোডম্যাপ অনুযায়ী পূরণে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে।
আইএলওর পরিচালনা পরিষদে মালিকদের প্রতিনিধি জার্মানির রেনাটে ড্রাইস বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ রোডম্যাপ অনুযায়ী সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা আশাবাদী। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে পরিবর্তী সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ যাতে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারে।
ইইউর প্রতিনিধি লিজিন ইলিইস বলেন, যে সংস্কার বাংলাদেশে হয়েছে তা আংশিক, যা উদ্বেগের। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশের নতুন সরকার সব অংশীজনদের নিয়ে দ্রুত শ্রম অধিকার নিশ্চিতের বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। ২০২৩ সালে যে সব শ্রমিক নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে সেগুলোর দ্রুত তদন্ত করে সুরাহা করা হবে। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) সকল শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সংগঠনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সারাহ মরগ্যান বলেন, আইএলওর ৮১, ৮৭ ও ৯৮ নম্বর সনদ বাস্তবায়েনের পাশাপাশি বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত হবে। ট্রেড ইউনিয়ন বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকার যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে সেগুলোকে সাধুবাদ জানাই। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যার বিচার না হওয়ার পাশাপাশি জগদীশ বাবুসহ আরো বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতার নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়গুলো অত্যন্ত উদ্বেগের। আমরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই।
manabzamin