২১ মার্চ ২০২৩ ১১:৪৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ভয়ানক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দুঃশাসনামলে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের লোকদের জোরপূর্বক গুম, অপহরণের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-এসব গুম, অপহরণের শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ প্রতিরোধে, তদন্তে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে সীমিত প্রচেষ্টা নিয়েছে সরকার।
সোমবার (২১শে মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
২০২২ সালের ঘটনার ওপর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ এবং মিডিয়ার রিপোর্টে অব্যাহত গুম এবং অপহরণের তথ্য উঠে এসেছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা (রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এসব সংগঠিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়-স্থানীয় একটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন রিপোর্টে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন ১৬ জন।
জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী। গুমের অভিযোগ উঠার পর কিছু ব্যক্তিদের ছেড়ে দিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ, কোন রকমের অভিযোগ ছাড়াই তাদের আটক করে গুম করেছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-মে মাসে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস, দ্য এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস, স্থানীয় সংগঠন মায়ের ডাক এবং অধিকার একটি পাবলিক চিঠি ইস্যু করে। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলেও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের জোরপূর্বক গুম করা হচ্ছে সরকারের মদদে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের বাধা, সভা-সমাবেশে বলপ্রয়োগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে বাধা প্রভৃতি অন্যান্য সময়ের মতো অব্যাহত ছিল। তবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে এসেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের এ নিয়ে মুখ না খুলতে ঘন ঘন ভয়ভীতি এবং হুমকি দেয়া হচ্ছে। জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার থেকে অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ তা নিবন্ধিত করে না। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-এপ্রিলে মায়ের ডাক সংবাদ সম্মেলন করে। এতে তারা জানায়, জোরপূর্বক গুম অব্যাহত আছে। বিশেষ করে গুমের শিকার হচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। আগস্টে এই সংগঠনটি দাবি করে, ভিকটিমের পরিবারের নারী সদস্যদের চরিত্র হননের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বানোয়াট ছবি আপলোড করছিল ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা। ওদিকে ভয়াবহ জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে যে সমালোচনা করা হয় তা প্রত্যাখ্যান করে সরকার। জানুয়ারিতে তাদের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এরই মধ্যে ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করে ফ্রিডম হাউস। তাতে বলা হয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরপূর্বক গুম, তাদের হেফাজতে মৃত্যু, খেয়ালখুশিমত গ্রেপ্তার ও নির্যাতনসহ বহুবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত ছিল।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়-২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের ৭১টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে মার্চে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, গুমের শতকরা ৪০ ভাগের জন্য দায়ী র্যাব। অন্যদিকে শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, গুমের এক তৃতীয়াংশ ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। এর শিকার বেশির ভাগই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী। ভিক্টিমদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগ হলেন শিক্ষার্থী।
ফটো সাংবাদিক ও নিউজ এডিটর শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম জুনে স্থগিত করে হাইকোর্ট। সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে জোর করে ২০২০ সালে আটক করে সরকার এবং গোপনে আটকে রাখে ৫৩ দিন। মানহানির অভিযোগে তিনি মোট ২৩৭ দিন জেলে কাটান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি পান।
মে মাসে পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের মোট ৮১টি ঘটনা তদন্ত করছে। বছরের শুরুতে তারা জোরপূর্বক গুমের কিছু ঘটনায় সরকারের কাছে তথ্য চায়। কিন্তু ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস বলেছে, গুমের শিকার মানুষগুলোর পরিণতি কি হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য ওই তথ্যগুলো পর্যাপ্ত ছিল না। সংস্থাটি রিপোর্ট করেছে যে, তারা নিয়মিতভাবে গুমের অভিযোগ পাচ্ছিল। এর শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
জাতিসংঘের মানবাধিকার চুক্তিগুলোর আলোকে প্রণীত বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক এই বার্ষিক প্রতিবেদনে পৃথিবীর ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের স্থানীয় মানবাধিকার ও শ্রমিকদের অধিকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মানবাধিকারকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে রেখেছেন।
দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কোনো আইনি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় না কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতির ভিত্তিতে প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর কোনো ক্রমতালিকা বা তুলনা করা হয় না।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা শুরু হয়েছে ‘সর্বজনীন’ শব্দ দিয়ে। কারণ বিশ্বের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে যা (বিশ্বের) প্রতিটি মানুষ, সর্বত্র ভোগ করার অধিকার রাখে। যুক্তরাষ্ট্র সেসব অধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী মানুষের পাশে থেকে সবসময় সমর্থন করে যাবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, স্বতন্ত্র ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন একটি অধিকতর নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। (মানুষের) মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মূল দিকটি ফুটে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র সম্মান, শ্রদ্ধা ও অংশীদারিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিতভাবে মানবাধিকারের বিষয়গুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরছে। এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।