বাংলাদেশের বাজারে আসছে নতুন একটি ব্র্যান্ডের গাড়ি, যার নাম উলিং। সাত আসনের ‘উলিং কর্টেজ’ মডেলের গাড়িটি দিয়ে বাংলাদেশে শুরু হবে এই ব্র্যান্ডের যাত্রা। বাজারজাত করা হবে আগামী জুনে।
বিগত কয়েক বছরে দেশের বাজারে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রি শুরু হয়েছে। উলিং সেখানে হতে যাচ্ছে নতুন সংযোজন।
চীনের মোটরগাড়ি নির্মাতা সাইক মোটর করপোরেশনের সহযোগী এই ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরি হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মোটর ভেহিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স বা ওআইসিএর তথ্য অনুযায়ী, গাড়ি নির্মাণে ইন্দোনেশিয়া এখন বিশ্বে দশম। দেশটি থেকে এই ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে আসছে র্যানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড। মূলত পারিবারিক গাড়ি হিসেবে এমপিভি (মাল্টিপারপাস ভেহিক্যাল) শ্রেণির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে নতুন মডেলের গাড়ি বাজারজাত করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশে গাড়ি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাজারে চাহিদার কারণে এ বছর রাস্তায় নামতে পারে আরও কিছু নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি।
এই অবস্থা পাল্টেছে এক দশকে। আমদানির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত বছর বিশ্বের ২২টি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের গাড়ি বাজারজাত হয়েছে। এসব গাড়ি আমদানি হয়েছে ১৯টি দেশ থেকে।
নতুন গাড়িতে নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত হয়, সেটা পুরোনো গাড়িতে থাকে না। আবার ওয়ারেন্টি ও ফ্রি সার্ভিসের মতো সেবা গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়ায় ক্রেতাদের। পুরোনো গাড়ির দাম বিবেচনা করলেও নতুন গাড়ি এখন অনেক সাশ্রয়ী। সব মিলিয়ে নতুন গাড়ির বাজার বড় হচ্ছে।
মোহাম্মদ ফাহিম হোসেন হেড অব মার্কেটিং, মিতসুবিশি মোটরস বাংলাদেশ
আমদানির তথ্যে আরও দেখা যায়, বিশ্বে গাড়ি উৎপাদনে শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের গাড়ি বাজারজাত হচ্ছে এ দেশে—চীন, জাপান, ভারত, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া। এর বাইরে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে তৈরি গাড়ি আসছে এ দেশে। নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ির মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের রেঞ্জ রোভার ও এমজি, জাপানের সুবারু, ইউরোপের মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ ও অডি, চীনের হাভাল, টিগগো, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ইত্যাদি। পরিবেশকেরা যেমন নিয়মিত এসব গাড়ি আমদানি করে বাজারজাত করছেন, তেমনি আলাদাভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাজার দেখে গাড়ি আমদানি করছে।
বাংলাদেশের বাজারে পুরোনো (রিকন্ডিশন্ড) ও নতুন গাড়ি বিক্রি হয়। নতুন গাড়ির বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড জাপানের মিতসুবিশি ও টয়োটা। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের হিসাবে, গত বছর নতুন গাড়ি আমদানি হয় ৫ হাজার ৪৯৮টি। এর ৫৪ শতাংশই এই দুটি ব্র্যান্ডের। পরিবেশকদের মাধ্যমে এসব গাড়ি বাজারজাত করছে জাপানি কোম্পানি দুটি।
বাংলাদেশে জাপানের মিতসুবিশি গাড়ির পরিবেশক র্যাংগস লিমিটেড। ১৯৭৯ সাল থেকে এই ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারজাত করে আসছে তারা। গত বছর যত নতুন গাড়ি বাজারজাত হয়েছে, তার ১৯ শতাংশই ছিল মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের। গত কয়েক বছরে এই ব্র্যান্ডের এক্সপান্ডার মডেলের গাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের ৫৮ শতাংশই গাড়ি এক্সপান্ডার মডেলের।
র্যাংগস এ বছরের শুরুতে মিতসুবিশি এক্সপান্ডারের ২০২৩ সালের মডেলের গাড়ি বাজারজাত করেছে। সাত আসনের এই গাড়িতে রয়েছে আকর্ষণীয় নকশা ও অসংখ্য সুবিধা। নতুন এই গাড়িতে তিনটি ফ্রি সার্ভিসিং এবং পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি (এক লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত) সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পারিবারিক গাড়ি হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া গাড়িটি এখন অফিসের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
নতুন গাড়ির ব্যবহার কেন বাড়ছে জানতে চাইলে মিতসুবিশি মোটরস বাংলাদেশের হেড অব মার্কেটিং মোহাম্মদ ফাহিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন গাড়িতে নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত হয়, সেটা পুরোনো গাড়িতে থাকে না। আবার ওয়ারেন্টি ও ফ্রি সার্ভিসের মতো সেবা গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়ায় ক্রেতাদের।
মোহাম্মদ ফাহিম হোসেন আরও বলেন, পুরোনো গাড়ির দাম বিবেচনা করলেও নতুন গাড়ি এখন অনেক সাশ্রয়ী। সব মিলিয়ে নতুন গাড়ির বাজার বড় হচ্ছে।
জাপানের টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারজাত করছে নাভানা লিমিটেড। ১৯৬৪ সাল থেকে টয়োটার পরিবেশক নাভানা। গত বছর যত নতুন গাড়ি আমদানি হয়েছে, তার ১৫ শতাংশই আমদানি করেছে নাভানা। যদিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টয়োটার হাইল্যান্ডার গাড়ি আমদানি করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অনানুষ্ঠানিকভাবে এসব গাড়ি বাজারজাত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক হিসাব ধরা হলে বাজারে টয়োটার হিস্যা ৩৫ শতাংশ।
শত বছরের পুরোনো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড মরিস গ্যারেজেস বা এমজি ব্র্যান্ডের গাড়ির চাকাও ঘুরছে বাংলাদেশে। ২০১৯ সাল থেকে বাজারজাত হওয়া এই গাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকায় আমদানিও বাড়ছে। বাংলাদেশে এই গাড়ির পরিবেশক র্যানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড। ২০২১ সালের শুরুতে এমজি ব্র্যান্ডের জেডএস মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়িও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে বাজারজাত হয়।
গাড়ি উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীন। আর চীনে সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি) গাড়িগুলোর মধ্যে হাভাল এক নম্বরে। হাভাল ব্র্যান্ডের গাড়িও বাজারজাত হচ্ছে দেশে। বাংলাদেশে এই গাড়ি বাজারজাত করে আসছে হাভালের পরিবেশক এসিই অটোস প্রাইভেট লিমিটেড। সাশ্রয়ী মূল্যে এসইউভি গাড়ির নতুন নতুন মডেল বাজারে আনছে প্রতিষ্ঠানটি।
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে গাড়ির বাজারে ইউরোপের ব্র্যান্ডের প্রাধান্য ছিল। এরপর বাড়তে থাকে জাপানের গাড়ি। এখন আবার দেশের সড়কে ফিরে আসছে ইউরোপের বিলাসবহুল গাড়ি। ইউরোপের তিনটি ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হচ্ছে বেশি—মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ ও অডি। বাজারে নতুন গাড়ির পাল্লা ভারী করছে এসব গাড়িও।
বড় হচ্ছে নতুন গাড়ির বাজার
নতুন গাড়ির বাজার কেমন বাড়ছে, তা জানতে পাঁচ বছর আগের তথ্য দেখে নেওয়া যাক। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি আমদানি হয় ২২ হাজার ৪৩৭টি। এর মধ্যে নতুন গাড়ি ছিল ২ হাজার ৬৬৭টি, যা মোট গাড়ি আমদানির ১২ শতাংশ। সে বছর দেশে সংযোজনের জন্য আমদানি হয় ১৪০টি গাড়ি। অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে পুরোনো গাড়ির বাজার হিস্যা ছিল ৮৮ শতাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সাধারণত জাপানের ব্যবহৃত পুরোনো গাড়ি আমদানি হয়।
বছর বছর নতুন গাড়ির বাজার হিস্যা বাড়তে থাকে। কমতে থাকে পুরোনো গাড়ির হিস্যা। ২০২২ সালে নতুন গাড়ি আমদানি হয় ৫ হাজার ৪৯৮টি, যা মোট গাড়ি আমদানির ২১ শতাংশ। চলতি বছরে নতুন গাড়ির হিস্যা আরও বেড়েছে। যেমন এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৭৫০টি গাড়ি আমদানি হয়। এর মধ্যে নতুন গাড়ি আমদানি হয় ৮৬২টি। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নতুন গাড়ি আমদানির হিস্যা ২৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস ও মোংলা কাস্টমসের হিসাবে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
নতুন গাড়ির হিস্যা বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, একসময় নতুন গাড়ির বড় অংশের ক্রেতা ছিল সরকারি সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানি। এখন বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন গাড়ির বড় গ্রাহক। আবার ব্যক্তি খাতে নতুন গাড়ির ক্রেতা শ্রেণিও এখন গড়ে উঠছে। কারণ, দেশে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে নতুন গাড়ি বিক্রি বাড়ছে। আগে পুরোনো-নতুন গাড়িতে দামের ব্যবধান ছিল বেশি। এখন সেই ব্যবধানও কমে এসেছে। নতুন গাড়ি কেনার সময় সার্ভিসিং, ওয়ারেন্টিসহ ক্রেতাদের নানা সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বিক্রয়োত্তর সেবার নিশ্চয়তা নতুন গাড়ির বাজার বড় করছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানি থেকে সংযোজন-নির্মাণ
আমদানি করে বাংলাদেশের বাজারে মালয়েশিয়ার প্রোটন গাড়ি বাজারজাত শুরু হয় ১৯৮৭ সাল থেকে। মাল্টিমোড গ্রুপ ছিল এই গাড়ির পরিবেশক। তবে ২০১৪ সালের পর সেভাবে আর আমদানি হয়নি এই গাড়ি। কারণ, ২০১৭ সাল থেকে এই গাড়ি দেশেই সংযোজন শুরু হয়। পিএইচপি অটোমোবাইলস লিমিটেড চট্টগ্রামের সাগরিকার কারখানায় সংযোজন করছে প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি।
এখন দেশেই গাড়ি সংযোজনের কারণে আমদানির চেয়ে কম খরচে গ্রাহকেরা প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি পাচ্ছেন। তবে পিএইচপির লক্ষ্য দেশেই প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি উৎপাদন। তাতে আরও কম খরচে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে এই ব্র্যান্ডের গাড়ি। বিক্রয়োত্তর সেবা ও যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতার কারণে এই গাড়ির চাহিদা বাড়ছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
বাজার আরও ‘বাড়বে’
নতুন গাড়ির বাজার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মনে করেন বেসরকারি খাতে গাড়ি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান পিএইচপি অটোমোবাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আকতার পারভেজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো গাড়ির সঙ্গে নতুন গাড়ির দামের ব্যবধান কমে আসছে। নতুন গাড়িতে ওয়ারেন্টি সুবিধা, ফ্রি সার্ভিসের নিশ্চয়তা রয়েছে। যন্ত্রাংশও এখন সহজলভ্য। এ কারণে ব্যবহারের পর বিক্রি করলেও ভালো দাম পাওয়া যায়। এসব সুবিধা নতুন গাড়ির বাজার বড় করছে।