Farhad Mazhar (from his Facebook entry) 11 March 2023
আমার এই কথাটা শুনতে অনেক খারাপ লাগতে পারে, তবে তরুণদের প্রতি ভালোবাসা থেকে বলছি. বাংলাদেশের তরুণরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে সকল তর্ক বিতর্ক চলছে সে সম্পর্কে খুব কমই খোঁজখবর রাখে। যে সকল সম্মেলন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবে তাদের ভাগ্যের নির্ধারক সেখানে তাই তাদের দেখা যায় না। এর ফলে তাদের যে বিপুল সম্ভাবনা আমরা দেখি – বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ কিম্বা বিভিন্ন তারুণ্যের নানান বহিঃপ্রকাশের মধ্যে – তার কোন পরিণতি আমরা লক্ষ্য করি না। এর জন্য আমি অবশ্য তরুণদের দোষ দেই না। আমাদের জেনারেশান তরুণদের বোঝাতে পারে নি যে একটি বাজে কবিতা লেখা, বাজে নাটকে তারুণ্য ক্ষয় করা, কিম্বা নগর বাউল হবার চেষ্টা করার চেয়ে সত্যকারের চিন্তাচর্চা বা প্রজ্ঞার সাধনা অনেক বড় কাজ। নান্দনিক কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। কিন্তু ফালতু কবিতা আর ফেইসবুকে কুতর্ক করার চেয়ে একজন বিজ্ঞানী হতে পারা বিশাল কাজ। হোক তা অর্থশাস্ত্র, বায়লজি কিম্বা কৃষি।
বিশ্ব নিয়ে ভাবতে হবে নিজের জায়গা থেকে। ধরুন, Chat GPT । কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শক্তি আমরা টের পাচ্ছি। এটা বাস্তব। কারণ ডিজিটাল ও আর্টীফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে আমরা যার বিপরীতে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।
কিন্তু প্রশ্ন হোল, আমরা কি শুধুই ব্যবহারকারী থাকবো? আমরা কি শুধু হাইটেক কোম্পানিগুলোর বাজার হবো? নাকি নিজেরাও বিজ্ঞান কৃৎকৌশলের নেতৃত্বে পৌঁছাবার চেষ্টা করব?
ব্যবহারকারি হবার ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে কোথায় কিভাবে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল আমরা ব্যবহার করবো, কোথায় করব না। বিগডাটার যুগ এসেছে, কিন্তু তর্ক হচ্ছে আমাদের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি আরও নিখুঁত হচ্ছে কিনা। আমাদের আদৌ কোন প্রাইভেসি আছে? নাকি নাই? একালে তর্ক চলছে তথ্যের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া থাকবে কি না, অর্থাৎ গুগল, ফেইসবুকে আমরা যেসব তথ্য দিচ্ছি — সেটাতো আমাদের দেওয়া তথ্য। এর মালিক কে হবে? কোম্পানি? আমাদের তথ্যের ভাণ্ডারের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ কিভাবে কায়েম হবে? তথ্যের ওপর সার্বভৌমত্ব কায়েমের (Data Sovereignty) তর্কও সামনে চলে এসেছে। ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের তর্কের সঙ্গে এই তর্কও এখন জীবন্ত এবং যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। সামনে রিদয়পুরের ‘ভাববৈঠকি -৬’-এ আমরা এ নিয়ে আলোচনা করব। কারণ গণক্ষমতা তৈরির সঙ্গে এই নতুন কিন্তু অপরিসীম শক্তিধর ডিজিটাল জগতের প্রশ্ন জড়িত।
কিন্তু হতাশ হয়ে যাই। যখন দেখি তরুণদের মধ্যে ব্যবহারকারী হবার চেষ্টা বেশি, তখন হতাশ হয়ে যেতেই হয়। তবে যখন দেখি তাঁরা বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলকে নিজের আয়ত্বে এনে নিজেরা সেখানে নেতৃত্বের স্থান আদায় করে নিতে আগ্রহী – তখন ভরসা জাগে। তবে এমন তরুণের সংখ্যা খুব কমই দেখি। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। ভূয়া স্মার্টনেস দেখিয়ে ফায়দা নাই। কাজের মানুষ দরকার।
দর্শনের ক্ষেত্রে দেখুন। তরুণরা পড়াশুনা করতে চায়, কিন্তু পড়াশোনা করা ও বুঝে শুনে কথা বলা এক কথা – আর দার্শনিকদের নাম আওড়ানো ভিন্ন জিনিস। ফল নাম জপবার অভ্যাসই দেখি। যার এক পাতাও পড়ে নি, তার নাম আওড়ানো। দর্শনের সামনের সারির তর্কগুলো বুঝতে হবে, জানতে হবে। বিশেষত আমাদের জীবনের সঙ্গে সরাসরি যে সকল প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা জড়িত সেই জিজ্ঞাসাগুলোকেই সামনে আনতে হবে।
দর্শনের কাজ আকাশকুসুম কল্পনা না। নিজেদের বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হওয়া এবং চিন্তার চ্যালঞ্জগুলো মোকাবিলা করা।
কথাগুলো মনে হোল জাতিসংঘের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আফ্রিকার তরুণদের তৎপরতা ও প্রস্তুতি দেখে। তারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমস্যা ও সংকট নিয়ে কথা বলছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেনদরবার করছে। অনেক বুদ্ধিমান তরুণ বাংলাদেশে হয়তো আছে। কিন্তু দেখলাম না।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বেরুতে চায়। কিন্তু তার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, সেই প্রস্তুতি নাই। একে স্রেফ ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা হিশাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল দেখাতে চায় তাদের আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। অথচ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ভয়ানক বিপদাপন্ন দেশ। আমরা বিশাল সংকটের দিকে ধেয়ে চলেছি।
তাই তরুণদের বলি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান না করে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা আপনা আপনি সফল হবে এটা দুনিয়ার কোন দেশের পক্ষেই সম্ভব হয় নাই। একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে সেটা কখনই সম্ভব না। মাথা পঁচে গেলে শরীরের পচনও শুরু হয়। তরুণরা বহুজাতিক কোম্পানি বা বিদেশীদের গোলাম হতে পারবে, কিন্তু স্বাধীন স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের সকল সুযোগ তাদের দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থা দ্রুত বদলাতে হবে। আগের কাজ আগে।