নভেম্বর ০৫, ২০২২
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ইসলামের গবেষক হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বহুল পরিচিত আলী রীয়াজ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। দেশের চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ দুই রাজনৈতিক বিশ্লেষক সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন
আগামী এক বছর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়: আলী রীয়াজ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হবে—এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইঙ্গিত দেখি না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বলে যে দেশ আরেকটা সাজানো নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাতে বিজয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীনরা কী কৌশল নেবেন, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। নির্বাচনের সময় কী ধরনের সরকার থাকছে, তার ওপর নির্ভর করছে কী ধরনের নির্বাচন হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হয় না, এটা সবাই জানে। গাইবান্ধার নির্বাচনের পর এমনকি নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত বলেছে যে পুলিশ এবং প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি। নির্বাচন কমিশনের আচরণও সঠিক ছিল না বলে প্রমাণিত হয়েছে। কমিশন জেনেও ‘ডাকাত’দের ঠেকাতে পারেনি।
নির্বাচনে প্রভাবশালী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?
আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। দল, সরকার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাদের জন্য ‘পরাজয়ের মূল্য’ অনেক বেশি। জাতীয় পার্টি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসতে পারবে তার লক্ষণ নেই। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে সরকারের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছে। বিএনপি দৃশ্যত সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে। তাদের এ সমাবেশগুলোয় কর্মীদের উপস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে তারা কোনো রকমের দাবি আদায় না করে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হবে না।
বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে। হেফাজতে ইসলাম নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। এর বাইরেও জোট আছে, দল আছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে সরকারের ওপরে বিদেশীদের চাপ আছে। ফলে নির্বাচনের আগে নতুন ধরনের মেরুকরণ হবে, এটা নিশ্চিত।
ইংরেজিতে যাকে ‘স্ট্রেঞ্জ বেডফেলো’ বলে, তেমন দলগুলোকে একত্রে দেখা গেলে আমি অবাক হব না। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে ক্ষমতাসীনরা কার সঙ্গে কী ধরনের সমঝোতা করে সেটাই দেখার বিষয়। এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে নির্বাচন কমিশন নতুন কোন দলগুলোকে নিবন্ধন দিচ্ছে, তার মধ্যে। অন্যদিকে আগামী দিনগুলোয় বিএনপি অন্যদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করতে পারবে কিনা, সেটিও নির্ধারকের ভূমিকা পালন করবে।
নির্বাচনে বিদেশী শক্তির প্রভাব থাকবে? থাকলে কোন দেশের প্রভাব কেমন হবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ২০০৮ সাল থেকেই স্পষ্ট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারত প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এবারো ভারতের ভূমিকা থাকবে। ভারত কী চায়, সেটা কূটনীতিকদের ভাষা থেকে বোঝার কিছু নেই। ভারতের নীতিনির্ধারকরা, ব্যবসায়ীরা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অব্যাহত শাসনেই লাভবান হবে। সেটাই তারা চাইবে। স্থিতাবস্থা রক্ষায় চীনের স্বার্থ আছে। এটা বোঝার মধ্যেই পরোক্ষভাবে চীনের ভূমিকা অনুমান করা যায়। পশ্চিমা দেশগুলো, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলো একটি অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। প্রশ্ন হচ্ছে দৃশ্যত অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে কিনা। কিন্তু এসব প্রভাবের সব হিসাবনিকাশ বদলে যাবে, যদি নাগরিকরা অবাধে ভোট দিতে পারেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করার স্বাধীনতা কতটুকু?
কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় রাজনীতির মাঠ আওয়ামী লীগ একচ্ছত্রভাবে দখল করে রেখেছে। এটা রাজনীতির স্বাভাবিক চিত্র নয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিএনপি এবং অন্যান্য দল খানিকটা জায়গা পেয়েছে। কিন্তু বিএনপির প্রতিটি সমাবেশ অনুষ্ঠানে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়া হয়েছে। বাধা দেয়ার জন্য আগে পুলিশ ব্যবহার করা হতো। প্রশাসনকে ব্যবহার করা হতো। এখন সেটা দলের ওপর ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। সরকার বিরোধীদের জায়গা দিচ্ছে এটা দেখাতে যে দেশে সমাবেশের ওপরে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই। সরকার বাধা দিচ্ছে না। দেশে গণতন্ত্র আছে। যা সাংবিধানিক অধিকার সেটা দেখানোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে মানেই অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে বিদেশীদের চাপ। ক্ষমতাসীনরা বিদেশীদের দেখাতে চায় যে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এখনো রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ভুতুড়ে মামলার শিকার হচ্ছেন। আইনানুগ সমাবেশে যোগদানের কারণে আটক হচ্ছেন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে আটক হচ্ছেন। ফলে বিএনপিকে কয়েকটা সমাবেশ করতে দিলেই দেশে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে বা নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেটা মনে করা সঠিক হবে না।
বিএনপির চলমান আন্দোলনের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোকে আন্দোলন বলার মতো অবস্থা হয়নি। এসব সমাবেশে বিএনপির কর্মী ও সমর্থকরা যোগ দিয়েছেন। তাতে দলের প্রতি তাদের আন্তরিকতা প্রকাশিত হয়েছে। তারা সব ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করতে পারছেন, সেটা বোঝা গেছে। এটা ইতিবাচক। বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। প্রতিপক্ষের বিভিন্ন ধরনের বাধা এবং সহিংসতা সত্ত্বেও বিএনপি কর্মীরা সহিংস হচ্ছেন না। উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিএনপি বর্তমান সংকট, নির্বাচনকালীন সরকার এবং ভোটের অধিকারের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এগুলো বিএনপির একার দাবি নয়। এসব প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে দলের বাইরের লোকদের ও অন্য দলগুলোকে যুক্ত করতে হবে। সেটা করা গেলেই একটা আন্দোলনের সূচনা হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলি, বড় বড় সমাবেশ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনে এ ধারণা জন্মাতে পারে যে এখন নির্বাচনে গেলেই তারা বিজয়ী হবেন। এ ধারণা তাদের জন্যে ক্ষতিকারক হবে।
এখন বারবার দুর্ভিক্ষের কথা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে কারো কোনো রাজনৈতিক ফায়দার সুযোগ আছে কিনা?
সরকার আগামীতে দুর্ভিক্ষের কথা বলছে, কিন্তু যে তথ্য-উপাত্ত হাতে আছে তাতে এটাই দেখায় যে এরই মধ্যেই খাদ্য সংকট উপস্থিত। দুর্ভিক্ষ মানে কিন্তু কেবল খাবারের অভাব না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনার সামর্থ্য না থাকাও দুর্ভিক্ষ। এরই মধ্যে ৬৮ শতাংশ মানুষ বলছে তারা খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্ভিক্ষের কথা বলে ভীতি তৈরি করা, এজন্য সারা বিশ্বের খাদ্য সংকটকে দায়ী করা। প্রশ্ন হচ্ছে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকার কী করছে, কেন খাদ্য সংকট মোকাবেলার প্রস্তুতি ছিল না, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোথায় অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দুর্ভিক্ষের কথা বলে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। অবস্থা ভয়াবহ বলার পরে সংকটের মাত্রা কম হলে তাকেই তারা দাবি করবেন তাদের সাফল্য হিসেবে। কিন্তু দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের তো এর মধ্যেই নাভিশ্বাস উঠে গেছে, তাদের কী হবে?
দুর্ভিক্ষ হলে তা আগামী নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হলে দেশের অর্থনীতির এ সংকট, দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা, খাদ্য সংকট—সবকিছুর জন্যেই ক্ষমতাসীন দলকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। সব দেশেই সব জাতীয় নির্বাচনই ক্ষমতাসীনদের কাজের ব্যাপারে রেফারেন্ডাম। বাংলাদেশে যখনই যথাযথ নির্বাচন হয়েছে, তখন ক্ষমতাসীন দল না থাকলেও আগের দফায় যারা ক্ষমতায় ছিল সে দল পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো আমাদের এ ইঙ্গিত দেয়।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
পঞ্চাশ বছর আগে যে প্রতিশ্রুতি এবং প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি সেই পথে অগ্রসর হচ্ছে মনে করার কারণ নেই। দেশের শাসন ব্যবস্থা এখন কর্তৃত্ববাদী রূপ নিয়েছে। আগামী এক বছর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসনেই যাবে কিনা, তা এ সময়েই নির্ধারিত হবে। আমার আশঙ্কা যে এই সময়ে নিপীড়ন বৃদ্ধি পাবে, ভিন্নমত দমন জোরদার হবে, সহিংসতার মাত্রা বাড়বে। বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট দেশকে ভয়াবহ দিকে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু এ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, রাজনীতিতে সবার অংশগ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি না করে ও মতপ্রকাশের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ তুলে নেয়। মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ ক্ষোভ প্রকাশিত হলে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো তা মোকাবেলা করতে পারবে না। কেবল শক্তি প্রয়োগ করে মোকাবেলার চেষ্টা সফল হবে না, তাতে সংকট বাড়বে।
আমরা এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে আছি: বদিউল আলম মজুমদার
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, আমাদের এগারোটি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। এ চারটি নির্বাচনে যারা আগে ক্ষমতায় ছিল, তাদের রদবদল হয়েছে। নির্বাচনগুলো দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি—এ দুটি নির্বাচন হয়েছে একতরফা। এ দুটিসহ বাকি পাঁচটি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। এর সবগুলো হয় একতরফা হয়েছে, নয়তো হয়েছে কারচুপির নির্বাচন। এবং এগুলোয় যারা ক্ষমতায় ছিল, তারাই ক্ষমতায় থেকে গিয়েছে। গাইবান্ধার উপনির্বাচন আবারো প্রমাণ করল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ করতে বাধ্য হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সীমাহীন দলীয়করণ হয়েছে। যদিও দিনবদলের সনদে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করা আছে।
আমার মনে হয়, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনে জিতে আসার সম্ভাবনা কম। এজন্য এখন রক্ষাকবচ হিসেবে ইভিএমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইভিএমের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী। ইভিএম কেনার জন্য যে কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়, তিনি তার প্রধান ছিলেন। তিনি এ ইভিএম কেনার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন, কারণ এটিতে পেপার ট্রেইল নেই। যেমন আমরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে দুটি রসিদ পাওয়া যায়, যার একটি আমাদের কাছে থাকে। আরেকটি থাকে যাদের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়েছে তাদের কাছে। বিশেষজ্ঞরা চেয়েছিলেন এমন ইভিএম কিনতে। যাতে ইভিএম থেকে প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে ওই কাগজ দেখে পুনর্গণনা করা যায়। কিন্তু এখন যেটি কেনা হয়েছে, সেটিতে এমন কোনো কাগজ থাকবে না। আর এখন তো কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল ঘোষণা করবে, সেটাই মেনে নিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো প্রিজাইডিং অফিসারদের আঙুলের ছাপ দিয়ে ইভিএমকে ওভাররাইড করার সুযোগ। ইভিএমে যাদের আঙুলের ছাপ পড়তে পারে না, প্রিসাইডিং অফিসাররা নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে তাদের ভোট দেয়ার জন্য ইভিএম খুলে দিতে পারলে সে ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা নিজেরাও অন্যের ভোট দিয়ে দিতে পারবেন। গত জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এ রকম ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। যেখানে ২ শতাংশ ভোট এদিক-সেদিক করতে পারলেই নির্বাচনের ফলাফল পাল্টানো যায়। নির্বাচন কমিশন, তার কর্মকর্তা, কারিগরি টিম ও বুথ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষেই ইভিএমে জালিয়াতি করা সম্ভব। তারা সবার অলক্ষ্যে নির্বাচনী ফলাফল বদলে দিতে পারে। কাকপক্ষীও জানবে না।
নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারকারী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?
আমাদের অনেকগুলো দলের শেকড় খুব শক্ত না। এ শেকড় কেমন তার ওপরই নির্ভর করবে তাদের প্রভাব। আমি আশা করব জাতীয় পার্টি স্বচ্ছ এবং গণতান্ত্রিক একটা দলে পরিণত হবে। সবগুলো দলই এখন একেকটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। বিএনপির তো অনেক সমস্যা, কিন্তু আওয়ামী লীগের এর চেয়েও বেশি সমস্যা। বিএনপি একটি দুর্বল দল, আওয়ামী লীগ আরো বেশি দুর্বল দল। এখন দল আর সরকার এক হয়ে গেছে বলে আওয়ামী লীগের শক্তি আছে। প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দলের লোকের মতো কাজ করে। এটিই তাদের শক্তি। কিন্তু আওয়ামী লীগে কোনো নতুন নেতৃত্ব নেই। শেখ হাসিনা যদি না থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব নিয়ে বড় কোন্দল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপিতে উত্তরাধিকার ঠিক থাকলেও, আওয়ামী লীগে তা নেই।
নির্বাচনে বিদেশী শক্তির প্রভাব থাকবে? থাকলে কোন দেশের প্রভাব কেমন হবে?
বিদেশী শক্তির প্রভাব দুইভাবে হতে পারে। এখন বিরোধী দল যে সভা করতে পারছে, তার একটা বড় কারণ হলো বিদেশী স্যাংশন (বিধিনিষেধ) বা স্যাংশনের ভয়। যারা ফায়দা লোটেনি, তাদের মধ্যেও একটা চিন্তা আসতে পারে যে স্যাংশনের কারণে তারাও ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেসব টাকা লুটপাট হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই এখন উত্তর আমেরিকায়। অনেকের পরিবার সেখানে থাকে। অনেকের ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া করে এবং ভবিষ্যতেও করতে যাবে। এই যে সংযোগ, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
ইউডিএইচআরসহ (জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা বা ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস) একটি আন্তর্জাতিক আইন, যা আমরা মানতে বাধ্য। আরো কতগুলো চুক্তি আমরা স্বাক্ষর করেছি। এগুলো অনুযায়ী আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বাধ্য। এতে বিদেশীদেরও সোচ্চার ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়া রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবেও বিদেশীদের সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নির্বাচনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটা বড় ভূমিকা আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সেন আমাদের দেশে এসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এতে অংশ নিতে রাজি করার চেষ্টা করেছিলেন। তখন এরশাদ অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু তার দলের একটা অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। র্যাব এরশাদকে অসুস্থ বলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা যদি প্রয়াত ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর জীবনী পড়ি, সেখানেও তিনি দেখিয়েছেন আমাদের নির্বাচনে তাদের একটা ভূমিকা আছে।
আবার চীনের যেহেতু অনেক বড় একটি বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। গত নির্বাচনে কিন্তু ভারত আর চীনের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা ছিল, কে আগে প্রথম অভিনন্দন জ্ঞাপন করবে।
আমরা আগে সিদ্ধান্ত নিতাম কাকে নির্বাচিত করব। কিন্তু এখন এ বিষয়ে পর্দার অন্তরালে অন্য কারো ভূমিকা আছে কিনা, সে ব্যাপারে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। যদি হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে এটা কারো জন্যই ভালো হবে না। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে একটা স্থিতিশীল রাষ্ট্র। যেটা তাদের জন্যও প্রয়োজন। তাই কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করলেই ভালো।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করার স্বাধীনতা কতটুকু?
দেশের নীতিনির্ধারকদের কথা শুনে মনে হয় দেশে রাজনীতি করার স্বাধীনতা নেই। সংগঠন করার অধিকার আমাদের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে। এগুলো মৌলিক অধিকার। আদালতে গিয়ে এগুলো বলবৎ করা সম্ভব। সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা পালন করা উচিত।
বিএনপির চলমান আন্দোলনের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
বিএনপি এখন যে সভা-সমিতি করছে তাতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। বস্তুত অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এবং স্যাংশনের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দল মাঠে নেমে একটা আন্দোলন করার সুযোগ পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে, বিশেষত ভোটাধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে মাঠে নামছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। এটিরই প্রতিফলন আমরা দেখছি। তবে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতিও মানুষের অসন্তোষ আছে।
এখন বারবার দুর্ভিক্ষের কথা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে কারো কোনো রাজনৈতিক ফায়দার সুযোগ আছে কিনা?
বারবার দুর্ভিক্ষের কথা সামনে আসছে। এর কারণও রয়েছে। আমাদের রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। আমদানি-রফতানির ভারসাম্য নেতিবাচক হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। ডলার সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যও দিন দিন বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। ভবিষ্যতে এটি তীব্র হলে আমাদের খাদ্যের সমস্যা দেখা দেবে। কারণ আমরা চাল-গমসহ অনেক কিছু আমদানি করি। শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থার পেছনেও অর্থনৈতিক সংকট মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্য ঘাটতি। শুধু খাদ্য ঘাটতি নয়, যদি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকে তাহলেও দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। বিতরণ ব্যবস্থার সমস্যার করণেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমাদের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। অর্থনৈতিক সমস্যা জটিল হওয়ার জন্য আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য আমদানির সমস্যা প্রকট হতে পারে। বর্তমানে সরবরাহের ব্যাপারে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। যদিও আমাদের পঞ্চাশের মন্বন্তরে সরবরাহ একটি বড় সমস্যা ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষের কথা বলে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার সুযোগ আমি দেখছি না। তবে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে তা ভবিষ্যতে আরো জটিল এবং ব্যাপক রূপ নেবে বলে অনেকের আশঙ্কা। মানুষের ভোগান্তির দিন শেষ হয়নি, বরং তা আরো বাড়বে। হয়তো সেজন্যই তাদের সেভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা চলছে।
আর্থিক সমস্যা আরো জটিল হতে পারে রাজনৈতিক ও সুশাসনের অভাবের কারণে। ফুটো কলসিতে পানি ঢাললে কোনোভাবেই লাভ হবে না। ফুটো কলসি সৃষ্টি হয় মূলত স্বজনতোষণ, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের কারণে। এখন আমাদের অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে ধার করছি। কিন্তু ধার করে টাকা এনে যদি ফুটো কলসিতেই ঢালা হয়, তাহলে তো লাভ হলো না। আমাদের যদি ওই ফুটোগুলো বন্ধ করা না যায়, অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও শাসনপ্রক্রিয়ার সংস্কার করা এখন জরুরি; শুধু ধার করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করা যাবে না। দুর্ভিক্ষ হবে কিনা জানি না। তবে ভবিষ্যতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।
দুর্ভিক্ষ হলে তা আগামী নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
এটা বলা দুরূহ। অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকট যদি ভয়াবহ আকার ধারণ করে বা দুর্ভিক্ষ হয় তাহলে মানুষ আরো ক্ষুব্ধ হবে। এক্ষেত্রে মানুষ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পায়, তাহলে নিঃসন্দেহে এর প্রভাব পড়বে। ক্ষমতাসীনদের জন্য নেতিবাচক প্রভাবই পড়বে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
আমরা ব্রিটিশ আমলে প্রজা ছিলাম। স্বাধীনতার পর এখন প্রজা থেকে ক্লায়েন্ট হয়েছি। নাগরিক আজও হতে পারিনি। রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা হলো পেট্রন। আমাদের বর্তমান সংকটের পেছনে রয়েছে স্বার্থপরতা ও অর্বাচীনতা। স্বাধীনতার পর যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত ছিল, তারা কিন্তু যুদ্ধের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তারা আমাদের ইতিহাসের নায়ক হতে পারেনি। নেতৃত্বের রক্তচক্ষুর কাছে তারা পরাজিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশটা সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি।
এখন আমাদের অর্থনৈতিক সংকট প্রকট। আমরা এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে আছি। আমাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। আমাদের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নেই। ফলে সরকারের দায়বদ্ধতা হয়ে গেছে যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে তাদের প্রতি। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের দায়বদ্ধতা। অনেক বিদেশী বিশ্লেষক আমাদের হাইব্রিড রেজিম থেকে এখন অটোক্রেটিক বলা শুরু করেছে। তার মানে রাজনৈতিক সুশাসনের ক্ষেত্রে আমাদের অবনতি হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে তাহলে মানুষ আরো ক্ষুব্ধ হবে এবং মানুষ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পায় তাহলে নিঃসন্দেহে এর প্রভাব পড়বে। ক্ষমতাসীনদের জন্য নেতিবাচক প্রভাবই পড়বে।