- রিন্টু আনোয়ার
- ০৩ জুলাই ২০২২, ১৯:৪৮
দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যাকবলিত মানুষের হাহাকার ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আকস্মিক বন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা। তাই ঘরে কেউই নিরাপদ বোধ করছেন না। এ অবস্থায় অনেকে হন্যে হয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। অনেকে নৌকার অভাবে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ঘরে মাচা বেঁধে কোনোমতে আছেন। কেউ কেউ দিনের বেলা ঘরের চালেও আশ্রয় নিয়েছেন। পরে অবশ্য নৌকায় তারা চাল ছেড়ে বিভিন্ন উঁচু এলাকায় ঠাঁই নিয়েছেন। চুলা তলিয়ে যাওয়ায় অনেকের ঘরেই রান্না হয়নি। এতে খাদ্যসঙ্কটে পড়েছেন অনেকে। সুপেয় পানির সঙ্কটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভোগান্তি আরো বেড়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় গবাদিপশু নিয়ে অনেকে বিপদে পড়েছেন।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা এর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা এখন পানির নিচে। সিলেট বিভাগের বাকি জেলাগুলোর শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা ও ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। টিনের ছাউনির ঘর ও একতলা ভবনের ছাদ পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বর্তমানে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও সামনের বার্তা মোটেও ভালো নয়।
শুনতে খারাপ লাগলেও সম্প্রতি বন্যা নিয়ে সার কথা বলে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সিলেটে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির কিঞ্চিত উন্নতিতে সন্তুষ্ট না হয়ে দেশে আরো বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সংশ্লিষ্টদের দিয়েছেন এ-সংক্রান্ত কিছু নির্দেশও। এ নিয়ে নানা কথা হতে পারে। ট্রল হলেও রোখার উপায় নেই। অপ্রিয় সত্যটাই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সামনে বন্যার আরো শঙ্কা রয়েছে জানিয়ে সতর্কতার পাশাপাশি, মোকাবেলার একটি বার্তা তিনি দিয়েছেন।
মন্দের ভালো খবর হচ্ছে, সিলেটলাগোয়া আসাম তছনছ করা বন্যার পানি সিলেটে ওইভাবে ঢোকেনি। সিলেট লেপ্টে দেয়া পানির বেশির ভাগই মেঘালয় থেকে আসা। আসামের পানি ঢুকলে সিলেট-সুনামগঞ্জের সাথে কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের পরিস্থিতি আরো করুণ হতে পারত। এখনো তা হয়নি বলে সামনে যে হবে না। সেই গ্যারান্টি নেই। বরং সেই শঙ্কাই বেশি। শঙ্কাকে আমলে রাখা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলকর। প্রধানমন্ত্রীর এ শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আবেদন তৈরির ওপর নির্ভর করছে এর সম্ভাবনা তথা কার্যকারিতা।
ভাসা ভাসা হলেও অনেকের জানা, এ মেঘের উৎস হচ্ছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জী।
সিলেটের তামাবিল পেরোলেই মেঘের এ রাজ্যটি সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের জন্য বিশ্বের বিখ্যাত স্থান। চেরাপুঞ্জীর প্রবল বর্ষণ ঢলে তলিয়ে দিয়েছে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে। অনিবার্যভাবে ঢলের পানি সিলেট থেকে দ্রুত দক্ষিণে নেমে যাচ্ছে না। কারণ সুরমা-কুশিয়ারার নাব্য হারিয়ে গেছে কবেই। হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ, হাওর-বিল-ঝিল ভরাট; নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কেটে একাকার করে দেয়া হয়েছে। এসব কারণ জিইয়ে রেখে বন্যা মোকাবেলা অসম্ভব। বাংলাদেশে ষড়ঋতুর হিসাব অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল।
সেই পঞ্জিকা মতে, বর্ষাকাল সবে শুরু। সামনে আরো কত সময় বাকি। এরই মধ্যে সুরমা-কুশিয়ারা পাড়ে কোথাও দ্বিতীয় আবার কোথাও তৃতীয় দফায় বন্যা চলছে। বান আরো ডাকলে তা সুরমা-কুশিয়ারা ভেদ করে পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ অন্যান্য নদ-নদীর অববাহিকায়ও আছড়ে পড়বে। তাই সমাধানের প্রথম পথ হচ্ছে- সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খননের কার্যকর চিন্তা। সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক ‘ছড়া’গুলো দখলমুক্ত করে খনন করা উচিত।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সঠিক নকশা ও পদ্ধতিতে সিলেটের নদীগুলো খনন করে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা বাড়ানো জরুরি। নির্বিচারে হাওর ও বিল ভরাট করায় পানির ধারণক্ষমতা অনেক কমে গেছে। দেশে মুষলধারে বৃষ্টির পানি টানারই সক্ষমতা নেই এগুলোর। ভারত থেকে ঢল নামলে হাওর ও বিলগুলোর কী দশা হয়, ভাষা না থাকায় বলতে পারছি না। কিন্তু বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে সব পানিতে ছারখার করে। এখন এর একটি পর্বই চলছে মাত্র। এতেই এ অবস্থা। যে দিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। রেকর্ড ভঙ্গ করা এ বন্যায় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম একাকার। ভেসে গেছে গোলাঘর, গোয়ালঘর, বসতঘর। কারো কারো ভিটেমাটিও। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ সবাইকে এক কাতার করে দিয়েছে।
সিলেট বা হাওরাঞ্চলের বন্যা দেশের অন্য এলাকার বন্যার চেয়ে ভিন্ন। পাহাড়ি ঢলে যেমন দ্রুত বন্যা হয়, আবার পানি দ্রুত বেরও হয়ে যায়। এখানকার প্রায় ৮৫০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা নিচু। মাঝে মধ্যে কিছু বাড়িঘর ছাড়া বর্ষাকালে পুরো এলাকা সাগরের মতো হয়ে যায়। বর্ষাকালে নদ-নদীগুলো অচল হয়ে যায়। এটি এখানকার ভূমিগত বৈশিষ্ট্য। বর্ষাকালে নদ-নদী দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পানি প্রবাহিত হয় হাওরের ওপর দিয়ে। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ভূমি ঢালু হতে হতে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। পানির সাথে হাওরে পাথর ও বালুও এসে মেশে। হাওরের ভূমির এই বৈশিষ্ট্য দেশের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে ভিন্ন।
সিলেটের পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তা হাওরাঞ্চলেও। অথচ আচরণ অন্য নদ-নদী বা প্লাবন ভূমির মতো নয়। হাওরের ক্ষেত্রে সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের আগাম বন্যার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। এবার আর কিছুই হিসাবের মধ্যে নেই। বন্যা বন্ধ করা বা থামানোর বিষয় নয়। যদ্দুর সম্ভব মোকাবেলার বিষয়। নানা কারণে বাংলাদেশে বন্যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ফি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা হওয়ার আশঙ্কার মধ্যেও সেটি মোকাবেলার দক্ষ, টেকসই ও পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যবস্থা এখনো নেয়া হয়নি। কাজের চেয়ে কথা ও গর্জনই বেশি। উদ্যমহীনতা, দায়িত্ববোধের অভাব ও দুর্নীতিই এর পেছনের মূল কারণ। তার ওপর বন্যাপ্রবণ এলাকার জনপ্রতিনিধিরা খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট করে সমানে প্রকল্প বাগাচ্ছেন। এর সুবাদে কোথাও নিজেরাই সেগুলো দখল করছেন। কোথাও চুরি, দুর্নীতি নিশ্চিত করছেন। পরিণামে বন্যাকেও শিরোধার্য করছেন। প্রধানমন্ত্রীর অপ্রিয় সত্যের মতো এটিও আরেকটি মহাসত্য।
এ দেশে বন্যা দুর্ভোগের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়। একসময় পাকিস্তানিরা তা করেছে। স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরেও তা বহাল। ক্ষেত্রবিশেষে আরো চাঙ্গা। বন্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলে দেশে যত প্রকল্প ও কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগের পেছনেই একই কাহিনী। এগুলো হয় দাতাদের পরামর্শে, নয় ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া রাজনীতিক ও আমলাতান্ত্রিক কারসাজিতে। এসব প্রকল্প ও কার্যক্রমের সুফল খুব কমই জুটেছে মানুষের ভাগ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বহু বাঁধ-ব্রিজ-রাস্তা নির্মাণ হয়েছে, যা জলাবদ্ধতা আরো বাড়িয়েছে। গত ক’দিন এ নিয়ে এন্তার কথা হচ্ছে। বন্যার পানি সরাতে প্রয়োজনে সড়ক কেটে ফেলার নির্দেশনাও এসেছে ওপর থেকে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে কোথাও কোথাও পানির নিচে দুর্নীতির মহোৎসবের কিছু ঘটনাও ফাঁস হয়ে চলছে। নদীর পাড় রক্ষায় লাখ লাখ টন পাথর ফেলা বা নাব্য বাড়াতে বালু উত্তোলন দৃশ্যের নেপথ্যে কী ছিল- তা অনেকের ধারণাও ছিল না। বন্যার কারণে এখন জানছে। যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণের পেছনের কাহিনীও প্রকাশ পাচ্ছে। এর মধ্যেও যেটুকু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঘটেছে, সেটুকুর ব্যবহারও ঠিকমতো হলে কথা ছিল না। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মূল মন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মাঠপর্যায়ের বাস্তব কাজগুলো জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে করে থাকে স্থানীয় প্রশাসন। সেখানে নিয়ন্ত্রণ কত জরুরি চলতি বন্যা তার একটি বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।
বন্যার সাথে পাহাড়ধসেরও আপডেট বার্তা। বৃষ্টির মধ্যে সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরের আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল, বরিশালঘোনা ও ফয়’স লেকের লেকভিউ আবাসিক এলাকায় পাহাড়ধসে মারা গেছেন চারজন। প্রতি বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসে এ ধরনের মৃত্যু এবং মানবিক বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। ঘটনা একটু বড় হলে শোরগোল বাধে। তদন্ত কমিটি গঠনসহ তোড়জোড় চলে ক’দিন।
২০০৭-এর পর ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিসহ ছয় জেলায় পাহাড়ধসে ১৬৮ জনের প্রাণহানির পর আবার কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিও বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। পাহাড়ধস বন্ধে ২০০৭ ও ২০১৭ সালে সরকারের কমিটিগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, এর মধ্যে ছিল পাহাড়ধসপ্রবণ এলাকার বাসিন্দাদের পাকাপাকিভাবে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা, পাহাড়ধসের প্রভাবকে প্রশমন করে বেশি পরিমাণে সে রকম গাছ লাগানো। পাহাড় কাটা বন্ধ করা ও জড়িতদের প্রতিহত করার কথা তো ছিলই। শেষতক আসলে কিচ্ছু হয়নি। অতীতে মৌসুমি বন্যা ও পাহাড়ধস নিয়ে বহু তদন্ত-গবেষণা, সুপারিশ দেয়া হয়েছে। কার্যত কাজের কাজ কোনো সরকারের আমলেই হয়নি।