বন্ধ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কবে চালু হতে পারে

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ১১ জুন ২০২৩, ২০:০৬
বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র – ছবি : বিবিসি

কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের উপকূলে পায়রা ও বাঁশখালী বিদ্যুৎ কারখানার জন্য কয়লাবাহী জাহাজ আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি মাসের শেষে ওই দুই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কয়লা সংকটের কারণে গত ৫ জুন পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৮ জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বরিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার মজুদও ফুরিয়ে আসছিল।

এমন সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে শুক্রবার রাতে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২৬ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে মোংলা বন্দরে ভিড়েছে চীনের পতাকাবাহী জাহাজ।

সেইসাথে পায়রা ও বাঁশখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার চালান চলতি মাসের শেষে এসে পৌঁছাবে এবং এ মাসেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে ফিরতে পারবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বরাত দিয়ে শনিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার জন্য জাহাজে কয়লা আসছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট।

এর মধ্যে বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রে দেশি কয়লা ব্যবহৃত হয়। বাকিগুলো চলে আমদানি করা কয়লায়।

তাই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন নিশ্চিত করতে কয়লার আমদানি অব্যাহত রাখা ছাড়া বিকল্প নেই।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
কয়লা সংকটের কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২৬ জুন থেকে পুনরায় উৎপাদনে ফিরতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অংশীদারিত্বে নির্মিত দেশের বৃহত্তম এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট মিলিয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হয়, যার পুরোটাই আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে।

কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি কয়লার আমদানি বিল পরিশোধ করতে না পারায় নতুন করে কয়লা আমদানি করা যাচ্ছিল না।

কয়লার ঘাটতির কারণে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট এবং ৫ জুন পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

দেশটির মোট চাহিদার অন্তত ৯ শতাংশ বিদ্যুৎ পায়রা থেকে সরবরাহ হওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বরিশাল, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের একটি অংশের মানুষ বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখে পড়ে।

তবে নতুন এলসি’র (ঋণপত্র) আওতায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২৫ জুনের মধ্যে ৩৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লাবাহী একটি জাহাজ দেশের বন্দরে এসে পৌঁছবে বলে আশা করছে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড।

ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লাবাহী জাহাজের পায়রার জেটিতে নোঙর করতে অন্তত ১১ দিন সময় লাগে। সে হিসেবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২৬ জুন থেকে ফের স্বাভাবিক উৎপাদনে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া থেকে এরই মধ্যে কয়লাবোঝাই ছয়টি জাহাজ রওয়ানা হয়েছে এবং আরো কয়েকটি জাহাজে কয়লা বোঝাইয়ের কাজ চলছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহ আব্দুল মাওলা।

উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট দৈনিক প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল।

এই কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে মাসে অন্তত তিন লাখ টন কয়লা প্রয়োজন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, কয়লার মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে কয়লার সরবরাহ সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন হবে।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট হলেও কয়লা সংকটের কারণে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩৭০ মেগাওয়াট, যার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০০০ টন কয়লা পোড়াতে হচ্ছে।

বর্তমানে কেন্দ্রটিতে ৪৪ হাজার টন কয়লা মজুদ আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড।

এরই মধ্যে ২৬ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন কয়লার একটি চালান শুক্রবার রাতে মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছেছে।

গত ২১ মে ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজটি ছেড়ে আসে। ১৯ দিন পর জাহাজটি মোংলা বন্দরের এসে পৌঁছল।

শনিবার সকাল থেকেই কয়লা খালাস ও পরিবহনের কাজ শুরু হয়েছে।

সেখান থেকে এসব কয়লা লাইটারেজে করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিজস্ব জেটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ফলে কেন্দ্রটি উৎপাদন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিম।

তিনি বলেন, ‘যদি এলসি (ঋণপত্র) ঠিকমতো খুলতে পারি তাহলে কয়লা আমদানি অব্যাহত রাখা যাবে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হবে। আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে। কয়লা আসছে। কিন্তু সবই নির্ভর করছে এলসি খোলার ওপর।’

বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে তা দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অন্তত এক মাস উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাবে। এর মধ্যে কয়লার নতুন চালান আসতে শুরু করবে বলে তিনি আশা করছেন।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কয়লা সংকটের কারণে গত জানুয়ারি ও এপ্রিলে দুই দফায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় বেসরকারিভাবে নির্মিত এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চার দিনের মাথায় গত ৮ জুন বন্ধ হয়ে যায়।

এসএস পাওয়ার বলছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল।

এরমধ্যে দেশটিতে তীব্র গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা দেখা দেয় এ সময় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি তাদের অনুরোধ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মজুদকৃত কয়লা দিয়ে জাতীয় গ্রিডে সাময়িক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে।

এসএস পাওয়ারের প্রধান ফিনান্সিয়াল কর্মকর্তা এবাদত ভুঁইয়া বলেন, ‘আমরা এখনো বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করিনি। কিন্তু পিডিবির চেয়ারম্যান যখন অনুরোধ করলেন এবং আমাদেরও মনে হলো এমন সংকটের সময় যতোটা সম্ভব বিদ্যুৎ সরবরাহ করা দরকার। গ্রিডে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করেছি।’

বন্ধ হওয়ার আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গত ৪ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে ৩০০ থেকে ৩৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল।

তবে কয়লার মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করার চার দিনের মাথায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

চলতি মাসের শেষে সরকার জাতীয় গ্রিড আপগ্রেড করলে তারা দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবেন বলে জানান এবাদত ভুঁইয়া।

এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে এর মধ্যে ৬০ হাজার টনের একটি কয়লাবাহী জাহাজ তিন দিন আগে ইন্দোনেশিয়ার বন্দর ছেড়ে গেছে বলে জানান তিনি। ১৬ জুনের মধ্যেই প্রথম চালানটি বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়বে বলেও তিনি আশা করছেন।

এসএস পাওয়ারের এবাদত ভুঁইয়া বলেছেন, কয়লা আসলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ফের উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হবে।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে ২৬ জুনের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে আরো ৬০ হাজার টন কয়লার একটি চালান দেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

সব মিলিয়ে চলতি মাসের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা আমদানির কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে দৈনিক অন্তত ১০ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন।

অন্যদিকে বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যার জন্য লাগছে ৩০০০ টন কয়লা।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলার মতো হাতেগোনা কয়েক দিনের কয়লা আছে বলে জানা গেছে।

সূত্র : বিবিসি