রুশ প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
মাহবুব রনি
২৯ এপ্রিল ২০২৩
https://www.ittefaq.com.bd/641541
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদার রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বাংলাদেশের চিন্তা বেড়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব প্রকল্প বাস্তবায়নে পড়বে না বলে জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং অ্যাটমস্ট্রয়ের মালিক প্রতিষ্ঠান রোসাটম।
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
আর বাংলাদেশে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ হবে না। তবে অনেক মালামাল এবং জ্বালানি আমদানি বিলম্বিত হয়ে যাবে। বিল পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়েও উভয় পক্ষ বিকল্প সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদী। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কাজ সম্পন্ন না হয়ে বিকল্প উপায়ে সমাধান করতে হওয়ায় সব মিলিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি আরও ধীর হবে এবং ২০২৪ সালে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা কঠিন হবে।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে রাশিয়াকে চাপে রাখতে গত সপ্তাহে দেশটির ৮০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে রূপপুর কেন্দ্রটির নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে গতকাল রোসাটম জানিয়েছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো প্রভাব পড়বে না। রোসাটমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে রূপপুরে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলবে না। বরং এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে রোসাটম।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর কেন্দ্রের দুইটি ইউনিটের প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর্থিক বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সিংহভাগ খরচ (৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি) রাশিয়া সরকারের ঋণসহায়তা থেকে নির্বাহ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রোসাটম এবং অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের। কেন্দ্রটির জীবনকাল ৬০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর প্রতিটি ইউনিটে প্রতি ১৮ মাসে একবার রিফুয়েলিং (পরমাণু জ্বালানি সরবরাহ) করা হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের মধ্যে ২০১৫ সালে সম্পাদিত সাধারণ চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০২১ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল। দুই দফা পেছানোর পর গত অক্টোবরে হালনাগাদ সর্বশেষ সূচি অনুযায়ী, এর প্রথম ইউনিটটির নির্মাণ কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের শেষ ভাগে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ইউনিটের কাজ প্রায় ৮৮-৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে এটি উৎপাদনে আসতে পারে।
রূপপুর প্রকল্পে নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব কেমন হতে পারে সে বিষয়ে উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে দুই জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর তাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এর আগে প্রকল্পের কিছু যন্ত্রপাতি-মালামাল মার্কিন নিষেধাজ্ঞাধীন জাহাজে পরিবহনের পর তা দেশে খালাস করা যায়নি। প্রায় তিন-চার মাস পর বিকল্প জাহাজে করে সে মালামাল দেশে আনা হয়েছিল। এখন মূল ঠিকাদারের (ইপিসি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আসায় বিকল্প উপায় নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে আসার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ঐ দুই কর্মকর্তা আরও জানান, যন্ত্রপাতি-জ্বালানি সরবরাহে রোসাটম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর তাদের প্রদেয় প্রকল্পের পূর্বপ্রস্তুতি পর্যায়ের কাজের বিল বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি পৃথক অ্যাকাউন্টে রাখা অথবা চীনা মুদ্রায় পরিশোধে আপাতত সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল পর্যায়ের প্রকল্প কাজের বিল বা ঋণ পরিশোধ ২০২৬ সাল থেকে শুরু হওয়ার সূচি নির্ধারিত রয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় বাকি রয়েছে। এ সূচিও কিছুটা পেছানো যেতে পারে। মধ্যবর্তী এ সময়ে একটি সমাধান পাওয়ার ব্যাপারে সরকার আশাবাদী। এছাড়া এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২৮ বছরে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে ১০ বছর।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. মো. শৌকত আকবর বিদেশে (তুর্কিতে) অবস্থান করায় এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে সম্মত হননি।
উল্লেখ্য, চলতি মাসে ঢাকা ও মস্কো প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে তা শোধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ সংক্রান্ত সমঝোতার খসড়া চূড়ান্তও হয়। কিন্তু এখনো তা আটকে আছে। কারণ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় বাংলাদেশের হাতে পর্যাপ্ত ইউয়ান নেই। সামনের দিনে ইউয়ানের বড় সরবরাহেরও সম্ভাবনা নেই। এছাড়া এই লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ইউয়ানে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তত্ত্বাবধানে থাকা রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রোসাটমের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র জানায়, রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে ঢাকাকে কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানাতে গত মঙ্গলবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ডলারে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে পারছিল না। এখন আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউয়ান ব্যবহার করে রাশিয়ার ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ। চীন ২০১৫ সালে এ ব্যবস্থা চালু করে।
ইত্তেফাক/এমএএম