বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ দেশে ঢুকছে ব্যাংকিং চ্যানেলকে পাশ কাটিয়ে। বিশেষ করে বড় অংকের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ব্যাংক খাতকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত সপ্তাহে প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সের বৃহৎ একটি অংশ জুড়ে রয়েছে বড় অংকের লেনদেন।
ব্যাংকবহির্ভূত এসব বড় অংকের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিও। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে অর্থনীতিবিদদের। তারা বলছেন, ট্রাভেল এজেন্সিসহ বিভিন্ন অননুমোদিত মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের বিষয়টির সঙ্গে হুন্ডির সংযোগ রয়েছে। ট্রাভেল এজেন্সির আড়ালে চলছে মানি এক্সচেঞ্জ, হুন্ডি ও উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রির কারবার। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ব্যবসা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব রেমিট্যান্স সংগ্রহের পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি করে সেগুলো আবার বেশি মূল্যে দেশে পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে।
বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যমতে, দেশে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ বছরে দেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন ৫ লাখ টাকা বা এর বেশি অংকের। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের মধ্যে এ পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে সংঘটিত লেনদেনে এ রেমিট্যান্স সীমাভুক্ত প্রবাসী আছেন ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এছাড়া ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা বন্ধুদের হাতে পাঠানো অর্থের ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ ও ৪ দশমিক ১২ শতাংশ।
ট্রাভেল এজেন্সি বা অপ্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে জোর অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ট্রাভেল এজেন্টদের এভাবে রেমিট্যান্স আনার কোনো এখতিয়ার নেই। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কিছু দেশে হুন্ডির কারবার চলছে। সেখানে কিছু লোক ট্রাভেল এজেন্সি খুলে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করছে। আবার তারা মানি এক্সচেঞ্জ ও উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রি করছে। বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের কাছ থেকে মুদ্রা সংগ্রহ করছে। কিছু ক্ষেত্রে আবার দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি করছে তারা। বেশি মূল্য যেখানে পাচ্ছে, সেখানে সেসব মুদ্রা বিক্রি করে দিচ্ছে। সেখানে বসে তারা বিভিন্নভাবে হুন্ডির ব্যবসা করছে।’
রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে মূলত মাঝারি আকারের লেনদেনগুলো সম্পন্ন হচ্ছে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। আবার বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার কোম্পানির মাধ্যমে সংঘটিত লেনদেনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ছোট আকারের লেনদেন। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেশে আগত বার্ষিক রেমিট্যান্সকে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা বা এর বেশি পর্যন্ত পরিমাণভিত্তিক শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। আবার এতে এসব লেনদেনের মাধ্যমভিত্তিক বিভাজনও দেখানো হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, বছরে ২ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ও ৩ লাখ টাকার কম অর্থ পাঠাচ্ছেন ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবাসী। ব্যাংকের মাধ্যমে যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের মধ্যে এ সীমার অর্থ পাঠাচ্ছেন ১৮ শতাংশ প্রবাসী। ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের মধ্যে বছরে ৩ লাখ টাকা থেকে অনূর্ধ্ব ৪ লাখ টাকা পাঠাচ্ছেন ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। দেড়-দুই লাখ টাকা শ্রেণীভুক্তদের ক্ষেত্রে এ হার ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। দালালদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো প্রবাসীদের মধ্যে এ রেমিট্যান্স সীমাভুক্তের হার ১৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এ হার ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, বছরে এক-দেড় লাখ টাকা পাঠানো প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য এজেন্ট বা দালালদের সহায়তা নেন তুলনামূলক বেশি। দালালের সহায়তায় দেশে টাকা পাঠানো প্রবাসীদের ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বছরে রেমিট্যান্স পাঠান এক-দেড় লাখ টাকার মধ্যে। এ রেমিট্যান্স সীমাভুক্তদের ২২ দশমিক ৫১ শতাংশ দেশে টাকা পাঠান বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অর্থের পরিমাণের দিক থেকে দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৭৮ শতাংশই আসছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে আসে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ।
সৌদি আরবের জেদ্দায় বিলাসপণ্যের একটি শোরুম পরিচালনা করেন বাংলাদেশী জহির আহমেদ (ছদ্মনাম)। ওই দোকান থেকে প্রতি মাসে তার মুনাফা হয় ৮-১০ লাখ টাকা। নিজের আয়ের পুরোটা ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাতে পারেন না তিনি। কারণ উদ্যোক্তা নয়, বরং সাধারণ শ্রমিক হিসেবেই জহির আহমেদ সৌদি আরব গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তার মাসিক আয় হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা।
আয়কৃত অর্থ কীভাবে দেশে পাঠান—এমন প্রশ্নের জবাবে জহির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক কিংবা মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় দেশে টাকা পাঠাতে গেলে আয়ের উৎস দেখাতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নথিপত্র চাওয়া হয়। কিন্তু আমার পক্ষে আয়ের যথাযথ উৎস দেখানো সম্ভব নয়। কারণ সৌদি সরকারের কাছে যে নথি আছে, তাতে আমি একজন সাধারণ শ্রমিক। একজন শ্রমিক হিসেবে আমি এত টাকা আয় করতে পারি না। তাই বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে হলে হুন্ডিওয়ালাদের কাছে যেতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমেও দেশে টাকা পাঠাই।’
কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের আইনগুলো কঠোর হচ্ছে। আবার প্রত্যেক দেশই চাচ্ছে নিজেদের দেশ থেকে অতিরিক্ত অর্থ যাতে অন্য দেশে চলে না যায়। এজন্য সব দেশই প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোয় কড়াকড়ি আরোপ করছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্য। দেশের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান উৎসও মধ্যপ্রাচ্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। গত কয়েক বছরে এসব দেশের মানি লন্ডারিংসহ অর্থ স্থানান্তরের আইনগুলো কঠোর করা হয়েছে।
প্রবাসীরা বলছেন, ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জসহ আইন অনুমোদিত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে দেশে অর্থ পাঠানো অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল ও জটিল। এসব মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হলে সেটির দালিলিক প্রমাণও থেকে যায়। কিন্তু হুন্ডি, হাওলা, ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে সেটির ব্যয় কম হয়। আবার জবাবদিহিতার ভয়ও কমে যায়।
সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা ঠেকাতে বেশ তৎপর ছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দেশের এ আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (এমএফএস) কয়েকশ এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আবার হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীদের সতর্কও করা হয়েছে। এসব তৎপরতা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে যেসব অর্থ পাঠান কেবল সেগুলোই রেমিট্যান্স হিসেবে গণ্য হয়। হুন্ডি বা আইন অননুমোদিত কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে অর্থ পাঠালে সেটি রেমিট্যান্সের হিসাবে আসে না। কারণ এসব মাধ্যমে আসা অর্থে কেবল সুবিধাভোগী পরিবার বা ব্যক্তি উপকৃত হয়। দেশের হিসাবে কোনো ডলার যুক্ত হয় না।’
মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘রেমিট্যান্স গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে আইন-কানুন বেশ উদার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেসব দেশ থেকে অর্থ পাঠানো হচ্ছে সেখানে। কারণ বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকরা নির্দিষ্ট পেশার বাইরেও ওভারটাইম করে অর্থ আয় করেন। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। কিন্তু সেসব দেশের আইন অনুযায়ী, আয়কৃত অতিরিক্ত অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন না। এ কারণে বেশি আয় করা প্রবাসীদের বড় রেমিট্যান্স আমরা ব্যাংক খাতে কম পাচ্ছি। এসব অর্থ হুন্ডি, ট্রাভেল এজেন্টসহ অন্যান্য মাধ্যমে চলে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশ থেকে ৩০ লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক বিদেশ গিয়েছেন। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের বিদেশ যাওয়ার কোনো প্রভাব রেমিট্যান্স প্রবাহে দেখা যাচ্ছে না। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২ হাজার ৪৭৭ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও সেটির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত অর্থবছর দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশেরও অনেক কম। এ সময়ে ৮৮০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
যদিও শুধু চলতি ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ জন বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। এর আগে ২০২১ সালেও ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন।
বনিক বার্তা