বঙ্গভবনের নকশা নষ্ট করে হামিদের সাঁতারবিলাস

জাঁহাপনার হঠাৎ মনে চাইল নিশিরাতে জলকেলিতে মত্ত হবেন। সামন্ত আর পাইক-পেয়াদারা মিলে সেই আয়োজন করে দিলেন। জাঁহাপনার ইচ্ছে পূরণে রাজমহলেই বানিয়ে দিলেন জলাধার, সঙ্গে জলসাঘর। এটি কোনো পৌরাণিক কাহিনি নয়। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবনে ঘটেছে এমন ঘটনা।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের জন্য একটি ‘এক্সক্লুসিভ সুইমিংপুল’ নির্মাণ করে। সুইমিংপুলের পাশে পোশাক পরিবর্তনের জন্য দুটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। আর এতে করে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত বঙ্গভবনের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থাপত্যবিদদের। তাদের মতে, বঙ্গভবন হচ্ছে সরকারঘোষিত একটি পুরাকীর্তি। এর মূল নকশায় সুইমিংপুল নেই। নতুন করে সুইমিংপুল নির্মাণের ফলে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মূল নকশার লংঘন হয়েছে।

৮ কোটির প্রকল্পে ব্যয় ২০ কোটি

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির জন্য বঙ্গভবনে সুইমিংপুল কমপ্লেক্স নির্মাণ বাবদ প্রথমে বরাদ্দ হয় ৮ কোটি টাকা। পরে বঙ্গভবনের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়। সুইমিংপুল নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বঙ্গভবনের হিসাব বিভাগেরও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও দরবার হলের পর রাষ্ট্রপতির পরিবারের আবাসনের পেছনের অংশের পূর্ব পাশে সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে পোশাক পরিবর্তনের কক্ষ ও বারবিকিউ পার্টি করার সব ধরনের আয়োজনও রয়েছে সেখানে। বঙ্গভবনে কর্মরত একজন কর্মচারী আমার দেশকে জানিয়েছেন, ‘এখানে আগে বাগান ছিল। এ বাগানটি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল। আমরা এটিকে নিয়মিত পরিচর্যা করতাম। সুইমিংপুল করার পর আমরা আর ওখানে যেতে পারিনি। সেটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা লোক রয়েছে।

বঙ্গভবনের হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব সম্পদ বড়ুয়ার বিশেষ তদারকিতে সুইমিংপুল নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়েছে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুল হামিদ পরিবারের বিনোদনের জন্য বঙ্গভবনের মূল ভবনের পেছনে রাতযাপনের কক্ষসহ সুইমিংপুল কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ৮ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে তা বাড়িয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা করা হয় । এ প্রকল্পে সরকারের অতিরিক্ত ১২ কোটি টাকা ওই সময়ে বঙ্গভবনে গড়ে ওঠা সম্পদ বড়ুয়া সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে।

বঙ্গভবনে সুইমিংপুল কমপ্লেক্স নির্মাণের বিষয়টি পুরোপুরি দেখভাল করেছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী রায়হান নাদিম। মূল নকশা লংঘন, রাষ্ট্রের বিপুল অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী নাদিম আমার দেশকে বলেন, ‘আমি একজন প্রকৌশলী হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ তদারকি করেছি। এর জন্য অর্থ বরাদ্দ ও ব্যয় তদারকির জন্য পৃথক বিভাগ রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি তারাই ভালো বলতে পারবে। তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতির ইচ্ছে অনুযায়ী এ প্রকল্পটি সরকার নিয়েছিল।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব সম্পদ বড়ুয়ার সঙ্গে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তার ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার ফোন করা হয় ও বার্তা দেওয়া হলেও তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কাজ করা প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, বঙ্গভবনের নকশা করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তারাই বিষয়টি ভালো বলতে পারবে।

সুইমিংপুলে গভীর রাতের আড্ডা

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসনামলে টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর এবং ২০১৩ সালের আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান অসুস্থ থাকাকালীন ও তার মৃত্যুর পর কিছুদিন সব মিলিয়ে ১০ বছরের বেশি সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন মো. আবদুল হামিদ।

বঙ্গভবনের পুরোনো কর্মচারীদের মনে তাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি রয়েছে। অন্য রাষ্ট্রপতিদের থেকে তার আচরণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। তিনি রীতি-রেওয়াজ তেমন একটা মানতেন না বলেই জানালেন কর্মচারীরা। তবে তার আচরণ ছিল বন্ধুবৎসল। এই দীর্ঘ সময় থাকার সুবাদে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বঙ্গভবনকে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের বাসাবাড়ির মতো। বঙ্গভবনকে রীতিমত জলসাঘরে পরিণত করেছিলেন আবদুল হামিদ । তার আমলে বঙ্গভবনের কিছু পদস্থ কর্মকর্তা লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পর্কে কর্মচারীরা জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু করতেন তিনি। সে সময় তার একান্ত ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ কার্যালয়ে অবস্থান করতেন না। রাত ১১টার পর বঙ্গভবনের মূল কমপ্লেক্সে বসত মদের আসর । যেখানে প্রায়দিনই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ ও তার ঘনিষ্ঠরা উপস্থিত থাকতেন । বিষয়টি নিয়ে বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি ওই সময়। সুইমিংপুল কমপ্লেক্স নির্মাণের পর থেকেই বঙ্গভবন রীতিমতো জলসাঘরে পরিণত হয় বলেও জানান কর্মচারীরা। একজন কর্মচারী জানান, পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তা ডিবির হারুন যে রাতে আসতেন, সঙ্গে মডেল কিংবা নায়িকা নিয়ে আসতেন। তার বেপরোয়া আচরণে আমরা ভয়ে থাকতাম।

বঙ্গভবনের অঙ্গচ্ছেদ

বঙ্গভবনের নকশায় পরিবর্তন এনে সুইমিংপুল নির্মাণের ঘটনা জানতে পেরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থাপত্যবিদরা। তাদের মতে, এতে করে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বঙ্গভবনের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে।

বঙ্গভবনের মূল নকশায় পরিবর্তন এনে সুইমিংপুল নির্মাণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের এ প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধ্বংস করা করেছে বলে জানান গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমার দেশকে তিনি বলেন, বঙ্গভবন দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ প্রাসাদটি প্রথমে ব্রিটিশ-ভারতের ভাইসরয়ের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসস্থান ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ও কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এখানে বিধিবহির্ভূতভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সুইমিংপুল নির্মাণে ব্যয় হওয়া পুরো অর্থের অডিট করা এবং অনিয়ম বা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থাপত্যবিদ মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে যেসব স্থাপনা রয়েছে, সেগুলোতে পরিবর্তন আনতে হলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। বঙ্গভবন দেশের পুরাকীর্তি ও আর্টিওলিজিক্যাল স্থাপনা। এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তিগত স্থাপনা নয় যে, একজন ব্যক্তির পছন্দ বা স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তার ইচ্ছেতে এতে পরিবর্তন আনা যাবে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটিকে নিজের ব্যক্তিগত স্থাপনা মনে করাটা। এ প্রক্রিয়া থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া যে আর্থিক অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে, সেটাও অনুসন্ধান এবং যথাযথভাবে তদন্ত হওয়া উচিত। মোট কথা, বঙ্গভবনের মর্যাদা ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থেই পুরো বিষয়টিই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে আমার দেশ। তার প্রেস সেক্রেটারি মো. জয়নাল আবেদিন এ বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্যার এখান থেকে চলে যাওয়ার পর এখন আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ফোন করলেও তিনি এখন আর ধরছেন না।’

পুরাকীর্তি ধ্বংস করে একজন ব্যক্তি বা পরিবারের ইচ্ছা পূরণে বঙ্গভবনে সুইমিংপুল নির্মাণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জয়নাল আবেদীন আমার দেশকে বলেন, এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি কোনো মন্তব্য করবেন বলে মনে হয় না। কারণ, এ প্রকল্পটি নিয়েছে গণপূর্ত অধিপ্তর। তারাই এ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ ও নকশা করেছে। এতে কোনো ধরনের আর্থিক ও নকশাগত অনিয়ম হলে তার দায়দায়িত্ব পুরোটাই গণপূর্ত অধিদপ্তরের। এতে বঙ্গভবনের কিছু বলার নেই বলেও জানান তিনি।

amardesh

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here