বগুড়ায় পুলিশ আতঙ্ক
২৪ ঘণ্টায় অর্ধশতাধিক গ্রেপ্তার
বগুড়ায় পুলিশ গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারসহ বিএনপির দুজন প্রার্থীর বাড়িতে গভীররাতে ফিল্মি কায়দায় তল্লাশি করেছে। বগুড়া কারাগারে ইতিমধ্যে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিনগুণের বেশি কয়েদি রয়েছে। বগুড়া পুলিশ প্রশাসনের একটি সূত্র যদিও ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৭৪ উল্লেখ করেছে কিন্তু পুলিশ সুপার ভিন্নমত দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যাটা প্রায় ৫০। তাঁর কথায়, ‘চুরি, ডাকাতিসহ চলমান রাজনৈতিক মামলায় তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল ইসলামের পক্ষে প্রচারণায় সক্রিয় থাকা বগুড়া পৌরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন পশারি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিএনপির আরও তিন কাউন্সিলরের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে বলেও বগুড়ার মেয়র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। বগুড়া সদরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম বদিউজ জামান বলেছেন, বগুড়া সদরে পশারি ছাড়া আরও ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
২৪ ডিসেম্বর রাতে বগুড়া-৩ এ ধানের শীষের প্রতীক পান মাসুদা মোমিন। তিনি গতরাত সাড়ে আটটায় জানান, দুপচাচিয়ায় প্রচারণাকালে তালোরা পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল জলিলসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথচ প্রতিপক্ষের কর্মীরা তাঁদের মাইক ভেঙেছে। পোস্টার ছিঁড়েছে। দুপচাচিয়ার ওসি সাবেক মেয়রসহ ৬ জনের গ্রেপ্তারের কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন।
বগুড়া শহর থেকে মাঝগ্রাম ৩০ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম। এটি নন্দিপাড়ায় মহাজোট (জাসদ) প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ একেএম রেজাউল করিম তানসেনের এলাকা। সকাল প্রায় ১১টা। ১৫ জন কর্মজীবী দরিদ্র নারী ধানের শীষের প্রার্থী মো. মোশাররফ হোসেনের পক্ষে বাড়ি বাড়ি ভোট চাইছিলেন। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে দুই পুলিশ হাজির। তাদের দেখেই অনেকেই ঝোপঝাড়ের আড়ালে যায়। কেউ লিফলেট লুকিয়ে ফেলে।
যারা সাহস করে দাঁড়িয়েছিলেন ফাতেমা বেগম (৪৫) তাদের একজন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই দৌড় পারছে। তাঁরা (পুলিশ) জিজ্ঞেস করেছে, কাদের ভোট কর? জবাব শুনে বলেছে, তোমরা গরিব মানুষ। তোমাদের টাহা দেয়নি? বলেছি, গরিব হইলে কি হইবে? সে আমার ভাই।’ মাঝগ্রামে তাঁরা আগে পুলিশ দেখেননি।
বগুড়া-৩ আসনে (আদমদিঘি-দুপচাচিয়া) প্রতীক বরাদ্দের আগের দিন শান্তাহারে সভা ছিল। এক ভ্যান পুলিশ এসে হাজির। মাসুদা গতকাল দ্বিধা নিয়ে বলেন, পুলিশ তাদের কিছু বলেনি। কিন্তু আমরা সভা বাতিল করেছি।
এভাবেই পুলিশ আতঙ্কে ভুগছে বগুড়ার ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এবং তাদের কর্মী সমর্থকেরা। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বগুড়ায় ধানের শীষের ৬ প্রার্থীই আলাদাভাবে প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিটি এলাকার অভিন্ন চিত্র হচ্ছে, পুলিশি টহল, হয়রানি এবং তল্লাশি। আর এর ফল হলো বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর রাতে বাড়িতে না ঘুমানো। তবে এত দিন যা ঘটেনি, ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যরাতের পরে তাই ঘটেছে।
আসামির সন্ধানে বগুড়া-১ ও ৫ আসনের আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যথাক্রমে জি এম সিরাজ এবং কাজি রফিকুল ইসলামের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। জি এম সিরাজ মুঠোফোনে বলেন, আগের দিন তার গাড়িবহরে ভয়ানক হামলা হলো, পরদিন প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলার আসামি (৩২ জন) ধরতে পুলিশ মধ্যরাতে হাজির। তারা আমার বেডরুম ছাড়া সব রুম তল্লাশি করেছে। তার মতে তফসিলের পরে মোট গ্রেপ্তার ৮১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুর পৌরসভার কাউন্সিলর মি. শ্যামসহ গ্রেপ্তার ৩ জন।
প্রশ্নের জবাবে শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ুন বলেন, গোসাইবাড়ির মামলায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। কিন্তু সিরাজ অভিযোগ দিয়েছেন। কোনো আসামির নাম দেননি, আমরা তাই সেটা তদন্ত করছি। আর তারা (আওয়ামী প্রার্থী) নাম দিয়ে আসামি দিয়েছে, তাই তাদের ধরতে তার বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু কাউকে পাইনি।
মধ্যরাতের এই অভিযানে পুলিশ চার গাড়ি বোঝাই করে ফুডভিলেজ চত্বরে প্রবেশ করেছিল।
উল্লেখ্য, ২৪ ডিসেম্বরে শেরপুর থানায় বিএনপির যে তিনজনকে ‘হামলা থেকে বাঁচাতে’ থানায় এনেছিল, তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কারণ তারা ওই ৩২ আসামির অন্যতম।
গতকাল বিকেল ৫টায় জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ তাঁর দপ্তরে ওই দুই প্রার্থীর বাড়িতে তল্লাশির কথা জানেন না বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এদিকে কয়েকটি সূত্র বলেছে, খানপুরের একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতার বাসভবনে ককটেল হামলা হয়েছে বলে গতকালই মামলা হয়েছে। তবে এতে নির্দিষ্ট কারও নাম নেই। আছে যথারীতি অজ্ঞাতনামা আসামিদের নাম। একই আসনের ধুনট উপজেলায় বিএনপি অফিস থেকে মঙ্গলবার রাতে ককটেল ‘উদ্ধার’ করেছে পুলিশ। পুলিশের এই ‘অভিযানের’ ঘটনায় ৩৬ জনকে নতুন করে আসামি করে মথুরাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্পাদক গোলাম মর্তুজা মামলা করেছেন। এ ছাড়া ধুনটের বিলচাপুরি গ্রামে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্পে মঙ্গলবার রাত ১২টায় অগ্নিসংযোগের দায়ে বিএনপির ৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যায় পুলিশ ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব সোহেলকে পুরোনো গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করে।
অন্যদিকে সাবেক সাংসদ কাজি রফিকুল ইসলাম বলেন, অনধিক ১০ জন পুলিশ নিয়ে বগুড়া ডিবি রাত একটায় প্রধান ফটক ভেঙে তার বাসায় প্রবেশ করে। এখানেও তার বেডরুম ছাড়া সব ঘরে তল্লাশি চলে।
পরোয়ানা ছাড়া বাড়িতে প্রবেশ কি করে পুলিশ পারে? বগুড়ার সদরের ওসি বদিউজ জামান মুঠোফোনে বলেন, এ ঘটনা তার জানা নেই। ডিবি জানে। তিনি অবশ্য রাত তিনটায় শুনেছিলেন। ডিবির পরিদর্শক নূর এ আলম সিদ্দীকি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই কাজি রেন্টু (সারিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতি) ১০টি মামলার আসামি। তাঁকে ধরতেই তারা ওই অভিযান চালিয়েছিল।
কাজি রফিকুল তাঁর বাসভবনের তল্লাশি অভিযানের বিবরণ দেওয়ার সময় প্রত্যন্ত গাঁ ছায়াহাটা থেকে এসে ঢুকলেন এক মধ্যবয়সী নারী। তিনি পপি বেগম। রফিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, এই খবরের সত্যতা জানতেই তিনি ছুটে এসেছিলেন। তার নামধাম জেনে নিতে তিনি ভয় পেলেন। নীরবে চলে গেলেন।
কাজি রফিকও মাইক ভাঙা ও পোস্টার ছেঁড়ার বিবরণ দেন। বললেন, ৩০ ডিসেম্বরের ম্যাজিক হলো পুলিশকে সামলানো। তারা নিরপেক্ষ থাকলেই ভয় কাটবে। ভোট কেন্দ্রে ঢল নামবে। তাঁর দাবি সোনাতলা উপজেলার ২৭ নেতা-কর্মী এবং সারিয়াকান্দির ২০ জন এখন জেলে। গতকাল গ্রেপ্তার ৫ জন।
বগুড়া-২ আসনের মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল আলাদাভাবে এসপি ও ডিসিকে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি গত কিছুদিনে তার আসনে পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরও খারাপের দিকে গেছে বলে দাবি করেন। অবশ্য ডিসি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে বগুড়ার অবস্থা ভালো। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। মান্না তাঁকে তথ্য দেন যে, ১৭ ডিসেম্বরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শরিফুল ইসলাম জিন্নার সামনেই শিবগঞ্জে এবং একই দিনে মোকামতলায় তাঁর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়। ১৪ ডিসেম্বরে মামলা ছাড়া বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিবগঞ্জের তিন নেতাকে। পোস্টার ছেঁড়ার ভিডিও তাঁর কাছে আছে বলেও তিনি দাবি করেন। ২৩ ডিসেম্বর এসব বিষয় মান্না ইসির কাছে অভিযোগ করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ১২ উপজেলায় তিনটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি এবং ১৩ জন নির্বাহী হাকিম সার্বক্ষণিক গাড়ি নিয়ে মোতায়েন আছে। কিন্তু ডিসি এবং জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তাঁদের দপ্তরে পৃথকভাবে প্রতিবেদককে বলেন, তাঁরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে এ পর্যন্ত কোনো বিষয় তদন্ত করতে বলেননি। তারাও কিছু করেছে বলে তাঁদের জানা নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটেরা গোটা জেলায় দুজনকে জরিমানা করেছে মাত্র।
এটা লক্ষণীয়, বিএনপির বিরুদ্ধে ১২ উপজেলায় দায়ের হওয়া ১৪ মামলায় নির্দিষ্টভাবে ৭৯৮ জনের নাম জানা গেলেও নির্বাচনী তফসিলের পরে ঠিক কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার তালিকা প্রশাসন দিতে পারেনি। ডিসি বলেছেন, পরিসংখ্যান তার জানা নেই।
তবে জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল এবং বগুড়ার মেয়র অ্যাডভোকেট একে এম মাহবুবুর রহমান বলেছেন, এই সংখ্যা দুশর বেশি হবে। শহরের ডিসির দপ্তরের পাশেই কারাগার। জানতে চাইলে জেলর রফিকুল জানালেন, ধারণ ক্ষমতা ৭২০। বর্তমানে কয়েদির সংখ্যা ২১১০। পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেন, চুরি, ডাকাতি, মাদক মামলার আসামিদের কারণে সংখ্যা বেড়েছে। পুলিশ প্রশাসনের একটি সূত্র মঙ্গলবার বলেছে, বর্তমান কয়েদিদের অন্তত ১০ ভাগ রাজনৈতিক মামলার আসামি হবে।
পুলিশের একজন মুখপাত্র তফসিলের পরে ৮০ থেকে ৯০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তবে বেসরকারি হিসেবে গ্রেপ্তার অনেক গুণ বেশি। আবার এর থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ রাতে বাড়িতে থাকেন না।
গ্রেপ্তারকৃত এবং অভিযুক্তদের সংগৃহীত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইউনিয়ন ও উপজেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি ও সম্পাদকের মতো পদে থাকা সক্রিয় কর্মী এবং সম্ভাব্য নির্বাচনী এজেন্টরাই বেশি বাড়ি ছাড়া।
ভোটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসতে পুলিশের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি বেড়েছে। বগুড়া-৭ আসন বিএনপি প্রার্থী শূন্য। প্রার্থী ছিলেন মোর্শেদ মিল্টন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় চাপ কম। তিনি তফসিলের পরে অন্তত তিনজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করলেও থানার ওসি বলেছেন, মঙ্গলবার রাতে নাশকতার মামলায় একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মাহমুদুর রহমানসহ বগুড়ার ছয়জন প্রার্থীর সঙ্গে গতকাল অন্তরঙ্গ আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে, পুলিশ আতঙ্ক সত্ত্বেও তাঁরা বিশ্বাসে অটল। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মানুষ ভোট দিতে আসবে। আর ভোটের দিনে পুলিশ ভীতি অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।