বাংলাদেশে যেন রাহুমুক্ত হতে পারছে না। সেই ’৭১ সন থেকেই একটার পর একটা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এই দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন মানবসৃষ্ট হয়ে প্রতি বছরই দুই/তিনবার বাংলাদেশে হানা দেয়। আর রাজনৈতিক দুর্যোগ প্রতিদিনের সাথী। যেকোন দিন যেকোন কারণে, এমনকি বিনা কারণে কারণ সৃষ্টি করে অশান্তি হানাহনি শুরু হতে পারে। এতে কেবল আর্থিক নয়, মানবসম্পদও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন বাংলাদেশে এখন কেবল ঘূর্নিঝড়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর সব দুর্যোগই, এমনকি বন্যাও মানবসৃষ্ট । সর্বোপরি সব ধরনের রাজনৈতিক হানাহানি প্রতিবেশি ভারতের চাপিয়ে দেয়া দুর্যোগ । কখন কীভাবে কোন কারণে এই দুর্যোগ শুরু হবে, তা আগাম বলার কোন সুযোগ নেই। মূর্তি-ভাস্কর্যের বিতর্ক তেমনি চাপিয়ে দেয়া দুর্যোগ।
বাংলাদেশকে পর্যুদস্ত পঙ্গু ও অচল করে ভারতভুক্ত না করা পর্যন্ত এই ধরনের চক্রান্তমূলক দুর্যোগ বাংলাদেশকে ভুগতে হবে । দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্পদ ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, আমলাবাহিনী, শিক্ষক, সাংবাদিক, মৌলভী-মাওলানাসহ সর্বশ্রেণীর মানুষের একটি অংশের কারণেই দেশের স্বার্থ, স্বাধীনতা, সার্বভৌত্ব ভারতের খোয়াড়ে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। যখন তাদের মনে এই অনুভূতি জন্মাবে যে, আমরা বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের জনগণের কাছে যাই। তাদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হই। বিদেশীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তাদের খপ্পর হতে বের হওয়া যাবে না ।
চলমান মূর্তি-ভাস্কর্য বিতর্ককে সামনে এনে কেবল বঙ্গবন্ধুকে মূর্তি-ভাস্কর্যে বন্দী করা হচ্ছেনা, তাকে আরো বিতর্কিত, এমনকি তাকে নিন্দিত ও অপমানিত করার নতুন সড়ক খোলা হচ্ছে। দেশের সংখ্যাগুরু বাংলাদেশী মুসলমানদেরকে ধর্মীয়ভাবে দুইভাগে ভাগ করে ব্যাপক সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কারারুদ্ধ, সম্পদ ও জীবন হানি, এমনকি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
মূর্তি আর ভাস্কর্য এক না কী ভিন্ন ভিন্ন বস্তু, এমনকি মূতি-ভাস্কর্য ইসলামধর্ম সমর্থিত কী না, সেই বিতর্কে জয়ী হয়ে একপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে মুর্তি-ভাস্কর্যে বন্দী করার জন্য কোরআন-হাদিসের ওপর সামান্যতম ধারণাও না থাকা সত্বেও ‘ফেসবুক ও অনলাইন মাওলানা’ কোরআনের অপব্যাখ্যা করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও শত্রুতা বাড়াচ্ছেন। ইসলাম ধর্মকে বিতর্কিত করছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, কিছু ‘মৌলোভী’ মাওলানা, আমলা, বিচারপতি উকিল বঙ্গবন্ধুর জন্য ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে মূর্তি-ভাস্কর্যের ইট-পাথর-সিমেন্ট-লোহার (রড) খাঁচায় না ঢুকালো বঙ্গবন্ধুর জন্য যে ভালোবাসা রয়েছে তা প্রমাণিত হবে না।
প্রথমেই দেখা যাক মূর্তি-ভাস্কর্য কী একই বস্তুকে বুঝায়, নাকি এদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সরকারী ওলেমাদের দাবি মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়। তাদের মতে ভাস্কর্য বলতে মূর্তি বুঝায় না। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর জন্য ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা ইসলামবিরোধী হবে না। এই তত্ত্ব কতোখানি সঠিক তা দেখা যাক।
ভাস্কর্য মানে মূর্তি নয় Ñ এমন ফতুয়া মন্ত্রী এমপিদের । ক্ষমতার মালিকরা যা বলেন, তা বার বার বলার জন্য অনেক ভাড়াটে পাওয়া যায়। আর রাজা-উজিররা তো কোন ভুলতে করতে পারেন না। তারা যা বলবেন, তা-ই আইন। রাজা-উজিরের কথার বাইরে কোন কথা নেই। তাদের মুখ দিয়ে যখন যা বের হয়, সব কথাই আইন। উজির হবার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকাদের একজন মোহা¥দ হানিফ ১৩ নভেম্বর মসজিদের ইমাম ও ওলামাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বলেন, “ভাস্কর্য নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে, আপনারা মসজিদে খুৎবার সময় এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলবেন ইসলামে ভাস্কর্য সাংঘর্ষিক নয়, নিষিদ্ধও নয়।”
আর তাদের কথা যে সঠিক ‘টু’ পাইস পাওয়ার বিনিময়ে সে সাক্ষ্য বারবার দেয়ার জন্য ‘মৌলোভী’ মাওলানাও রয়েছে। মূর্তি-ভাস্কর্য ইসলাম অনুমোদন করে কী না তা তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও জানা। আমার মতো তথাকথিত শিক্ষিতরা ধর্মীয় বিষয়ে বলতে গেলে একেবারেই অজ্ঞ। মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে আমরা শিশুকালে মায়ের কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি তা থেকে জানি, সব মুসলমনরাই জানেন, ভাস্কর্য-মূর্তি সরাসরি ইসলামে নিষিদ্ধ। দেশে হাজার হাজার আলেম-ওলেমা রয়েছেন। আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানটিও নীরব। ক্ষমতার কাছে কিনারে থাকা মাওলানা ফরিদ উদ্দিনরা কোথায়? মন্ত্রী-এমপিরা তাদেরকেও ডাকতে পারেন। মাওলানা ফরিদরা কী আওয়ামী ওলেমা লীগের অনুসারী ? তিনিও কী বলে ফেলবেন ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়।
আমি মন্ত্রী-এমপি নই। স্বাধীনতার পরেই আমার দল ক্ষমতায় আসে। আমার সমসাময়িকদের অনেকের চেয়ে দেশের জন্য আমার ত্যাগ-তিতীক্ষা, যোগ্যতার কমতি ছিল না। তথাপি আমার দল ক্ষমতা থাকাকালীন আমি ওসবের কাছে কিনারে যাই নি। হয়তো আমি মুর্খই ছিলাম। আমি এখন বুঝতে পারি আমার মতো মুর্খরাই দেশ ও ধর্মকে ভালোবাসেন । এই দুটোকে কোন কিছুর বিনিময়ে, স্বার্থ কিংবা ক্ষমতার বিনিময়ে হারাতে চাই না। দেশ ও ধর্ম ছাড়া আমার মতো মূর্খদের আর কিছুই নেই। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ ’তোমরা জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। আর সত্য ও মিথ্যাকে সংমিশ্রণ করো না।’ এইজন্যই আমার মতো অবুঝরাই সত্যি কথা বলার চেষ্টা করেন । কোন ভীতি সত্যি বলা কথা থেকে বিরত রাখতে পারে নি। এই জন্যই হয়তো আমাদের মতো অজ্ঞদেরকে কেই কিনতে পারে নি।
আমি নির্ভয়ে বিশ্বাস করি: ভাস্কর্য ও মূর্তি এক ও অভিন্ন। সামান্য চিন্তা করলেই বুঝা যায় মূর্তি-ভাস্কর্য হলো ইংরেজীতে ১৯৬১ (১৯৬১)’কে উল্টিয়ে লেখলে যা হয়, ঠিক তা-ই। অথবা বাংলায় ‘রমা কান্ত কামার’ এই তিনটি শব্দকে উল্টিয়ে লিখলেও একই অর্থ হয়ে যায়।
‘মূর্তি’ ও ’ভাস্কর্য’ শব্দ দুটির অর্থ পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে ‘মূর্তি’ ও ’ভাস্কর্য’ সহোদর ভাইয়ের মতো। আমি ও আমার বড়ভাইয়ের নাম ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু আমরা সহোদর ভাই। ‘মূর্তি’ ও ’ভাস্কর্য’ অনেকটা তার মতোই । দুটোই এক, একটি আরেকটির প্রতিশব্দ। দুটি শব্দই একই বস্তুকে বুঝায়, একই অর্থ বুঝায়। আরেকটি কথা বলি: মূর্তি ও ভাস্কর্য যে একই বস্তুকে নির্দেশ করে তা হিন্দুদের লিখিত অভিধানেই স্পষ্ট লেখা আছে। মূর্তি বা ভাস্কর্য’এর ইংরেজী প্রতিশব্দের মধ্যে ‘স্ট্যাচু’statue বা ‘স্কাল্পচ্যার’ (sculpture) । ‘স্ট্যাচু’statue কিংবা ‘স্কাল্পচ্যার’ (sculpture) এর বাংলা অর্থ এক এবং অভিন্ন : ভাস্কর্য, ভাস্কর কর্তৃক নির্মিত মূর্তি, প্রস্তরাদিতে খোদাই, প্রস্তর মৃত্রিকা প্রভৃতি দ্বারা মূর্তি নির্মাণ।
এই শব্দগুলো যে এক ও অভিন্ন তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ক্ষমতার মালিক হওয়াতে অনেক কিছু পরিবর্তন করা গেলেও আভিধানিক শব্দ পরিবর্তনের কোন ক্ষমতা তাদের নেই। এখানেই তারা পরাজিত। ইংরেজীতে ‘যাহা ছয়, তাহাই নয়’। মূর্তি মানে ভাস্কর, আর ভাস্কর মানে মূর্তি। ক্ষমতার কাছে কিনারে কিংবা ক্ষমতায় থাকা মহান ব্যক্তিবর্গ ‘মূর্তি ও ভাস্কর্য’কে একই শব্দ নয়, এমন অসার দাবি করে তাদের অবসস্থানকেই তারাই হেয় করছেন।
সবচেয়ে বড়কথা বঙ্গবন্ধুকে অমর করার জন্য মূর্তি-ভাস্কর্য তৈরির কোন প্রয়োজন নেই। তাকে অমর করতে হলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশে সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর যে দেশপ্রেম ছিল তা অনুসরণ ও বাস্তবায়নই হলো তাকে প্রকৃত ভালোবাসার এবং তাকে অমর রাখার শ্রেষ্ঠতম উপায়। মূর্তি বানালে মূর্তি পূজার রীতি চালু করলেই তিনি অমর হবেন না ।
আমরা বঙ্গবন্ধুকে অমর রাখবো এমন শপথ নিলে আামাদেকে আগে শপথ নিতে হবে আমরা কোন আগ্রাসী শক্তির শক্তির ভাড়াটে হবো না। আমরা কোন বিদেশী শক্তির গোলামী করবো না। বিদেশী শোষণ ও শাসনের ইতি ঘটিয়ে একটি স্বনির্ভর স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গড়ে তুলবো এই প্রত্যয়েই আমাদের সহযোদ্ধাসহ লাখ লাখ দেশবাসী শহীদ হয়েছে। সেই দেশকে আগ্রাসী হায়েনার থাবা থেকে রক্ষা করতে না পারলে শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, আমাদের দেশ ও জাতির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। মূর্তি-ভাস্কর্য তাকে অমর করতে কিংবা আমাদের দেশকে রক্ষা করতে পারবে না।
অন্যদিকে মূর্তি কাদের প্রতীক, তা সবার জানা আছে। আমাদের ধর্মে মূর্তি-ভাস্কর্য সম্পূর্ণরূপে হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। আমরা এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী । আল্লাহ একক ও অদ্বিতীয় । তার কোন শরীক নেই। মূর্তিপুজারীদের নাকি ৩৩ কোটি দেব-দেবী রয়েছে। এদের নাম রয়েছে। সাপ, বিছু গরু, হনুমান, ময়ুর, গাছ, নদী, কতো লিখবো কট্টর হিন্দুরাও এদের নাম জানে না।
বঙ্গবন্ধু মুসলমান ছিলেন। তিনি মুসলিমদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তানে আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তাকে কেন হিন্দুদের মূর্তি-ভাস্কর্যে বন্দী করবো? এগুলোতে হিন্দুত্বের প্রতীক, অমুসলিমদের কালচার।
মূর্তি-ভাস্কর্য’কে যারা অভিন্ন কিংবা ইসলামসম্মত বলে দাবি কিংবা প্রচার করেন, তারা ভারতের আশা-আকাঙ্খার প্রতিধ্বনি করছেন। হিন্দুদের কালচারকেই আমাদের মধ্যে চালু করতে চান। ভারত এটাই চায়। তারাই বলে বেড়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নাকি অভিন্ন। এমন দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা। যেদিন কোন হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেছেন তখনই তিনি হিন্দুত্ববাদী বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার, ইবাদত, খাবারের উপকরণ, জীবনযাত্রা প্রণালী ত্যাগ করে মুসলিম রীতি অনুসরণ ও অনুশীলন শুরু করেন। কোন মুসলিম নিজেকে কিংবা অন্য মুসলিমকে মূর্তি-ভাস্কর্যে সঁপে দিতে পারেন না।
হঠাৎ মূর্তির মধ্যে বঙ্গবন্ধু অমরত্ব নিহিত এমন ভুয়া জেদ তুলে ভারত মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিতর্ক ও বিভাজন তৈরি করতে চায়। রাজনৈতিকভাবে মুসলমানরা বিভক্ত থাকলেও আমরা একই মসজিদে একই ইমামের পেছনে নামায পড়ি। অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোন বিভাজন-বিতর্ক ছিল না। মূর্তি-ভাস্কর্য বিতর্ক উসকে দিয়ে এখন মধ্যে ধর্মীয় ঐক্যেও ফাটল ধরানোর প্রকল্প নিয়ে ‘র’ মাঠে নেমেছে। এটা হলো ভয়ঙ্কর চক্রান্তের আরেক অধ্যায়। আমরা আরেকটি বিভক্তির মুখে পড়েছি।
সারা দুনিয়ার মানুষ বাংলাদেশের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছেন। ইস্পাতকঠিন ঐক্যে বলিয়ান হয়ে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, এমনকি ৯২ শতাংশ অধিবাসী একই ধর্মের অনুসারী এই দেশ কেন এবং কার কারসাজিতে ৫০টা বছর ধরে একই অনৈক্য, হানাহানি আত্মকহলে লিপ্ত, আর এই অনৈক্যের বলি হচ্ছে আমাদের দেশ । আমাদের মধ্যে কেন আত্ম জাগৃতি আসে না? এই স্বদেশকে স্বাধীন রাখতে সবল-সক্ষম নিরাপদ রাখতে কেন ঐক্যবদ্ধ হই না? কেন দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেই? কেন আমরা বুঝি না আমাদের যতো বাহাদুরি, ক্ষমতা, অস্তিত্ব বিলাসিতা-ফুটানি সবকিছু এই স্বাধীন স্বদেশের অবদান। এই দেশ বেহাত হয়ে গেলে আমরা সব হারাবো। তখন আমাদের ঠিকানা হবে হিন্দুদের পায়ের তলায়, যেমনটি ব্রিটিশ আমলে ছিল। ওরা আমাদেরকে আবার তাদের মুটে-মুঝুরে, ঝি-চাকরে পরিণত করবে। তারা তা-ই চায়। ১৯৪৭ সনে নেহেরুরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে: উপমহাদেশ ভাগ হলে পাঞ্চাব ও বাংলা ভাগ করতে হবে, যাতে পাঞ্চাব ও বাংলার যে অংশ পাকিস্তানে যাবে সেগুলো অচিরেই ভারতে ফিরে আসতে পারে। ১৯৭১ সনে ভারত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাখার জন্য নয়, ভারতের সাথে মিশে যাবার জন্য।
ভারত সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে । অজানা শর্তে অজানা সংখ্যক চুক্তি করে বাংলাদেশকে ‘সাতপাকে’ বেধে ফেলার পরেও ভারত তার মূল লক্ষ্য অর্থাৎ ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনো কুলদীপ নায়ার, অমত্যিসেন, সুব্রামনিয়াম সোয়ামী থেকে শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে কিংবা পরোক্ষভাবে বার বার যা বলেছেন সেগুলোর মূল সুর হলো: বাংলাদেশকে ভারতের ভিতরেই যেতে হবে।
এই তো সেই দিন কুমিল্লার মুরাদ নগরে মহানবী (সাঃ)কে অবমাননার কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের শংকর দেবনাথের ও তার প্রতিবেশির বাড়ির ৫টি বাড়ি ও একটি মন্দির ভাঙচুর করাকে আরএসএস-বিজেপির কট্টর সাম্প্রদায়িক ভারতের সাবেক মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারক সুব্রামনিয়াম সোয়ামী বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ৯২% মুসলমানের দেশ দখলের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ ভারতে এমন দিন যায় না, যেদিন কোন না কোন মুসলিম খুন-জখম কিংবা চড়-লাথির শিকার হন না। অথচ বাংলাদেশে হিন্দুরা রাজার হালে রয়েছে, যাদের সম্পূর্ণ আয় বাংলাদেশের বাইরে ভারতে কিংবা অন্যত্র চলে যায়। তাদের ভয়ে মোট জনসংখ্যার ৯২% মুসলিম অসহায় অভিভাকহীন। তারা জানেন না তারা কখন কোন মিথ্যা অভিযোগ গ্রেফতার এমনকি খুন হন। এই বিতর্ক তেমন কিছুর আলামত।
বাংলাদেশে হঠাৎ মূর্তি-ভাস্কর্য নিয়ে এমন অশান্ত পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্য কী? অনেকেই মনে করেন বঙ্গবন্ধুকে অমর করার অজুহাতে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি তৈরির প্রকল্প সামনে আনা হয়েছে দেশে হানাহানি ও গোলযোগ সৃষ্টি করে দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে। মূর্তিপূজারী দেশ ভারত জানে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা নির্ঘাত এর বিরোধিতা করবেন। আর তখনই দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে মৌলবাদী সন্ত্রাসী জঙ্গী হিসেবে আরেক দফা কচুকাটা করা যাবে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ভারত-সমর্থিত বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে রাখার কৌশল নিয়েছে। তাদের মতে বাংলাদেশ যেন নড়াচড়া করতে না পারে, তার অগ্রগতি যেন ব্যাহত হয়। ভাঙ্গচুর, জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। বাংলাদেশ নাকি পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনছে। ওই উদ্যোগ ব্যাহত করার জন্যই গত এক মাসে ভারতের ‘হাতিয়ার’ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ জঙ্গীমিছিল বের করে দেশ ও শাসনতন্ত্রবিরোধী, এমনকি আলেম-ওলেমাদের ‘জবাই করার’ শ্লোগান তোলে। সুব্রামনিয়াম বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাঠানের হুমকি দেয়। আর মূর্তি নির্মাণের নামে মুসলমানদের মধ্যে পক্ষ/বিপক্ষ বিরোধ তৈরি করে মুসলমানরাই যেন আরেক দফা নিজেরা নিজেদেরকে খুন করে।
মনে রাখতে হবে মূর্তির বানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অমর নয়, তাকে খাটো করা হবে। কোন প্রকৃত মুসলমান কোন মুসলমানের মূর্তি নির্মাণকে সমর্থন কিংবা প্রশ্রয় দিতে পারেন না। বিশ্বের বহু দেশে এমনকি নিকট অতীতেও অনেকের মূর্তি জনগণ কিংবা জনদাবীর মুখে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আমেরিকার মতো উদার দেশেও এমন উদাহরণ রয়েছে। এমনকি কলম্বাসের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার দাবি উঠেছে। নিউইয়র্কের কলম্বাস স্কয়ারে কলম্বাসের মূর্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিউইয়র্ক পুলিশকে দেয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্ল্যাজিও জনগণের একাংশের দাবির প্রেক্ষিতে কলম্বাসসহ অন্যান্যের র মূর্তি সরানো যায় কী না তা পর্যালোচনা করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন। দাবির মুখে কোন কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তির মূর্তি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কমিউনিস্ট বিশ্বের তথাকথিত চিরঞ্জীব কমিউনিস্ট ছাইদের মূর্তি সাধারণ জনগণ চরম ধিক্কার ও ঘৃণায় পদদলিত ও অপমানিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি যাদের সামান্যতম ভালোবাসা রয়েছে, তারা একজন মুসলিম মুজিবকে মূর্তির মধ্যে সীমিত করবেন না। যারা এই ধরনের মূর্তির পক্ষে কথা বলছেন তা প্রকৃত অর্থে মুজিবকে ভালোবাসেন না। এরা বাংলাদেশবিরোধী শক্তির হয়ে মাঠে নেমেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকলে তাকে ছোট করার হেয় প্রতিপন্ন করার সড়ক মূর্তি তৈরির পরিকল্পনা হতে সরে আসবেন। তাকে বাঁচিয়ে রাখার সবচেয়ে উত্তম উপায় বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখা। বাংলাদেশ বাঁচলে বঙ্গবন্ধু বাঁচবেন।
ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলমান। মুসলিম পরিচয়েই আমাদের অশিক্ষিত বাবা-দাদারা মূর্তিপূজারীদের অত্যাচার অপমান থেকে মুক্তি জন্য মুসলিম আবাসভূমি পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন। আর আমরা পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানিয়েছি। ১৯৪৭ সনে আমাদের পূর্বপুরুষ পাকিস্তানে যোগ না দিলে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ কখনোই হেতো না। বঙ্গবন্ধু নামক কোন নেতারও আবির্ভাব হতো না। আমাদের ক্ষমতা, সুখ, বিলাসিতা, সব অর্জনের মূল আমাদের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার মূল দ্বিজাতি তত্ত্ব। লাহোর প্রস্তাব। মুসলিম পরিচয়ে পাকিস্তান তৈরি। তারই ফলশ্রুতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। এটা ভারতে অবদান নয়। এর মূল আমাদের মুসলিম পরিচিতি এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সুচিন্তিত সিন্ধান্ত Ñ মুসলিম আবাসভূমি বানানো। এর নামই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা হারানো মানে সব হারানো। আবার হিন্দুদের গোলাম হওয়া। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের দিকে তাকান। আর আমাদের দিকে তাকান। আমরা কতো আরামে আছি সুখে আছি। আমরা যেন আত্মঘাতি না হই।
আসুন আমরা শত্রু-বন্ধু চিনি। ভারত আমাদের বন্ধু হতে পারে না। ভারত আমাদেরকে স্বাধীন রাখার জন্য সাহায্য করে নি, বরং আমাদেরকে ব্যবহার করে তার চিরশত্রু পাকিস্তান ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদেরকে ব্যবহার করে ভারত কীভাবে লাভবান হয়েছে তা খতিয়ে দেখলে সহজেই বুঝা যাবে ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় ভারত কতোভাবে উপকৃত হয়েছে। ভারত আমাদের কাছে চিরঋণী থাকা দরকার, আমরা ভারতের কাছে নয়। *
লেখক: বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান সাংবাদিক ও গবেষক