ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) বিরুদ্ধে এবার টাকা পাচারের মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে ২০১৮ সালেই সুরেন্দ্র কুমারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছিল। আমেরিকায় অবস্থানকারী সুরেন্দ্র কুমারের ছোট ভাই অনন্ত কুমারের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয় বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে দুর্নীতি দমন কমিশন সিনহাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চায় বলেও জানা গেছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনন্ত কুমার সিনহা ২০১৮ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে একটি বাড়ি কিনেন। এই বাড়ির দাম প্রায় দেড় লাখ ডলার । কাছকাছি সময়ে অনন্ত কুমার সিনহা আরো একটি বাড়ি কেনেন, যার মূল্য প্রায় ৩ লাখ ডলার।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে আসে, ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির ভ্যালি ন্যাশনাল ব্যাংকে অনন্ত সিনহার অ্যাকাউন্টে (৮৫৮০০৩৩৭৫) প্রায় ২ লাখ ডলার জমা হয়। সেই বছরের ৫ মার্চ থেকে ২৮ মে একই ব্যাংকের, একই অ্যাকাউন্টে জমা হয় আরও প্রায় ৬০ হাজার ডলার। এই অর্থ জমা হয় ইন্দোনেশিয়া ও কানাডা থেকে। অনন্ত প্রায় দেড় লাখ ডলারের চেক সংগ্রহ করতে ভাই এসকে সিনহাকে নিয়ে ভ্যালি ন্যাশনাল ব্যাংকে গিয়েছিলেন। দুদক মনে করে এই অর্থ সিনহার, যা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এসকে সিনহার ভাই অনন্ত কুমার সিনহা আমেরিকায় থাকেন। তার অ্যাকাউন্টে এসকে সিনহা বিভিন্ন সময়ে হুন্ডিসহ অন্যান্য মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন। ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ক্যাশ দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছেন ভাইয়ের নামে। মানি লন্ডারিং আইন ৪ (২), ৪ (৩) ধারায় এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় এসকে সিনহা অপরাধ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। তাকে দেশে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
ঋনের নামে ফার্মার্স ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইতোমধ্যেই একটি মামলা হয়েছে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এই মামলাটি দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৪ কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করেছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তাঁর এই দুর্নীতির সহযোগি হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১১ জনকে আসামী করা হয়েছে ওই মামলায়।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহযোগি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক থাকা কালীন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এতে ১/১১-এর জরুরী আইনের সরকার তাঁকে বঙ্গভবনে চা’ খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। এই দাওয়াত পেয়ে ভয়ে তিনি ঘনিষ্ঠজনদের তলব করেন। তাদের পরামর্শে তিনি সুপ্রিমকোর্টের চেম্বারেই রাত্রিযাপন করা শুরু করেন। পাশ্ববর্তী দেশের হাইকমিশনের তদবীরে শেষ পর্যন্ত তিনি চাকুরি বাঁচাতে পেয়েছিলেন।
১/১১-এর ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহযোগি হিসাবে বিচারপতি সিনহা ভুমিকা রাখা শুরু করেন। বিচারকের আসনকে অপব্যবহার করে ভিন্নমতের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক আদেশ দেয়া শুরু হয় তাঁর বেঞ্চ থেকে। এক পর্যায়ে তাঁকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয় আওয়ামী লীগের শাসন শুরুর দিকেই। আপিল বিভাগে গিয়ে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র বিনাসি বিভিন্ন রায়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশ ত্যাগের পর তাঁর লেখা আত্মজীবনিতে (অ্যা ব্রোকেন ড্রিম) নিজেই উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনার সাথে সখ্যতার বিষয়টি। লেখায় স্বীকার করেছেন, কিভাবে মামলা সাজিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দিতে হবে শেখ হাসিনার সাথে তিনি সেই পরিকল্পনার বিষয়টি। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বইতে লেখেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিফল হয়ে ফেরত আসেন। শেখ হাসিনা সায় দেননি। ব্যারিষ্টার শফিক আহমদ তখন সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে অনুরোধ করেন শেখ হাসিনার কাছে যাওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর জন্য অনুরোধ করা হয় সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তখন শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কিভাবে বানোয়াট সাক্ষী তৈরি করে বিচার করা যায় সেটা বুঝিয়ে বলেন। এরমাধ্যমে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই স্বীকার করেছেন শেখ হাসিনার সাথে তাঁর সখ্যতা কতটা গভীর ছিল। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনাকে কিভাবে সহযোগিতা করেছেন, সেটাই প্রমানিত হয়েছে তাঁর লেখায়।
অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে একটি রায়কে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার সাথে বিরোধ তৈরি হয় সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। এই বিরোধের জের ধরে ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশত্যাগ করেন। প্রথমে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমেরিকা থেকে আবেদন প্রত্যাহার করে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাদের ক্ষমতা ও বিচারকের আসনকে অপব্যবহারের কারণে অনেক নির্দোষ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকেকে অন্যায়ভাবে জেল জরিমানা করা হয়েছে।