স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতার যুদ্ধকে আমরা প্রায়শই গুলিয়ে ফেলি। সেজন্যেই সকল বিভ্রান্তি ও বিড়ম্বনার শুরু। স্বাধীনতার জন্যে অনেক জাতিকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে কিন্তু সবাইকে যুদ্ধ করতে হয় নাই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস থাকলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি সামরিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকেই আসে। আর এই গৌরব ও গর্ব নিয়েই আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম। নিজেদের গৌরব ও গর্বের এই কথাটি উচ্চারণ করতেও আজ কুণ্ঠিত, সংকুচিত, দ্বিধান্বিত ও ভীত আমাদের কলিজার সেই সেনাবাহিনী ! ফ্যাসিবাদের নানা চকোলেট আহরণের প্রতিযোগিতায়ও তারা নাকি মত্ত !
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা অংশ নিজেদের শপথ ভঙ্গ করেই সেদিন বিদ্রোহ করেছিল। এদেশের গণমানুষের চাওয়া পাওয়া থেকে সেদিন ঐ সেনাবাহিনীর আমাদের অংশ দূরে সরে থাকে নাই। বিশ্বের একটি অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে নেয়া শপথ ভঙ্গ করে এই বিদ্রোহের পেছনে কিছু রাজনৈতিক ভিশন বা আকাঙ্খা কাজ করেছিল। নিজেদের এই ভূখন্ডে সাম্য,মানবিক অধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই সেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন সামরিক নেতৃত্ব। পাশের দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে এবং এদেশে একজন রাজা সৃষ্টি করার মানসে আমাদের বীর সেনানীদের সেই সব কীর্তি ম্লান করে দেয়া হয়েছে।
সবচেয়ে বড় অপমান, অবমাননা বা বঞ্চনাটি হলো পাক বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ককে উপস্থিত হতে দেয়া হয় নি। কে বা কারা সেদিন তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটিতে গুলি করে শপথ অনুষ্ঠানটি থেকে দূরে রাখে, সেই প্রশ্নটির যথাযথ জবাব খোঁজা হয় নি। সেই গোড়া থেকেই প্রতিপক্ষের সামনে নিজেদেরকে কম বুদ্ধিসম্পন্ন জীব হিসাবে তুলে ধরেছি। একজন চিমটি কেটেছে, অন্যজনের দিকে আঙুল তুলে তৃপ্ত থেকেছি। জাতির ঘৃণার কামানটি সেদিকেই তাক করে রেখেছি । ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে। এখনও বলদের মত এক দিকেই তাকিয়ে রয়েছি !
দিবসটি উপলক্ষ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবী থেকে তিন বাহিনীর তিনজন মুখপত্রের একটি সাক্ষাৎকার সময় টিভিতে প্রচার করা হয়েছে। কন্ঠে এবং শরীরে উভয় জায়গায় তৈলের পরিমাণ আর্মি স্ট্যান্ডার্ডে মাত্রাধিক ঠেকেছে ! মুক্তিবাহিনীতে জেড ফোর্স, কে ফোর্স এবং এস ফোর্সের নাম বললেন। কিন্তু কোন্ তিনজন সমরনায়কের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে সেগুলো গঠিত হয়েছিল, সেই নামগুলি উচ্চারণের সাহস করলেন না !
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীত্বের সেই অমর কাব্যটি শোনাতে এই তিন বাহিনীর তিন জনের একজনও ভুল করলেন না। মনে হলো এরা আমাদের গৌরব ও গর্বের সেনা সদস্য নয়-এদের উচ্চারণ,বাচনভঙ্গী এবং ভাষার লালিত্য দেখে মনে হলো ইনারা আওয়ামীলীগের চাপা সর্বস্ব কোনো বড় নেতা। হিসাবে টানেন হাজার বছরের কিন্তু ইতিহাস শুরু করেন ১৯৪৭ সাল থেকে। টিয়া পাখির মত যে চেতনাটির কথা বললেন সেই চেতনাটি এদেশের মানুষ ও সেনাবাহিনীকে সত্যিই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ! এমন ‘মাইনকা চিপায়’ এই জাতি হাজার বছরেও পড়ে নাই ।
সেই চিপায় পড়ে এই চ্যাম্পিয়নরা এখন ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও যথাযথ আদবলেহাজ মেইনটেইন করে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন। ইন্ডিয়ান এমবাসেডর ও সেনাপ্রধানের এরকম একটি ছবি দেখে জাতির বুকটি সত্যিই ‘ফাইট্যা’ যাচ্ছে। এর আগের মহিলা রাষ্ট্রদূতের সামনে নতজানু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি ছবিও ভাইরাল হয়েছিল। এই সব ছবিই বলে দেয় যে এই প্রভুদের নেক নজর এবং আশীর্বাদ ছাড়া প্রমোশন এবং চেয়ারে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। কিছুদিন আগে বিজিবি কম্যাণ্ডার মুখে হাসি দিয়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত এক হতভাগা স্বদেশীর লাশ গ্রহন করেন। নিহতের চেয়েও হতভাগা হয়ে পড়েছে জীবিত দেশবাসী , যাদেরকে এই সব দৃশ্য দেখতে হয় !
Wikipedia তে সশস্ত্র বাহিনী দিবসটি সম্পর্কে বলা হয়েছে – Armed Forces Day is observed in Bangladesh on 21 November. This signifies the day in 1971, when the members of the Bangladesh army, navy and air force were officially united and launched joint operations along with the people against the Pakistan occupation forces.
এখানে ‘launched joint operation along with the people’ এই শব্দ কয়টি বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। আমরাও কথায় কথায় তা বলে থাকি। কিন্তু কথাটির গুরুত্ব তেমন করে অনুধাবন করি না। এদেশে সিপাহী জনতার মাঝে সংহতির এই বীজটি সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম দিনেই রোপিত হয়েছে। ২১শে নভেম্বর ১৯৭১ এর পর সিপাহী জনতার পরবর্তি সংহতিটি সংঘটিত হয়েছে ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫। এরপর সিপাহী জনতার মাঝে তৃতীয় সংহতিটি হয়েছে ১৯৯০ সালে, যার কথাও আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম । শ্রদ্ধেয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে তা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আজ জেনারেল মার্ক মিলি ট্রাম্পের মুখ বন্ধ করতে যে কথা বলে সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছেন , সেই একই কাজ করেছিলেন আমাদের হিরো জেনারেল নুরুদ্দিন ১৯৯০ সালে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারি এরশাদকে সমর্থন না জানিয়ে তিনি জনগণের আশা ও আকাঙ্খাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। তখন তিন দিন খুঁজেও এরশাদ নাকি সেনাপ্রধানকে পান নি। ফলে স্বৈরাচারি এরশাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই স্বৈরাচারি এরশাদ বলে গেছেন, বর্তমান সরকার আমার চেয়েও বড় স্বৈরাচার ! জেনারেল নুরুদ্দিন পরবর্তি সময়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এমপি ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই সময়টিতে (১৯৯৬-২০০১ ) অবশ্য আওয়ামীলীগ সবচেয়ে গণতান্ত্রিক আচরণ দেখিয়েছে বা তা দেখাতে বাধ্য হয়েছে। আওয়ামীলীগের গণতান্ত্রিক সরকারে যোগ দিয়েছেন বলে এই বীরের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা একটুও কমে নাই। আমাদেরকে যারা আওয়ামী বিদ্বেষী বলে চিহ্নিত করতে চান তারা মূল বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না।
সিপাহী জনতার মাঝে চতুর্থ সংহতিটি এখন সামনে অপেক্ষা করছে যার মাধ্যমে বর্তমান ফ্যাসিবাদের পতন হবে বলে মাহমুদুর রহমান সহ অনেকের বিশ্বাস। সেই সময়টি কখন আসবে জানি না। কিন্তু তাকে আসতেই হবে ।
ক্ষমতা ছাড়তে ট্রাম্পের ‘টালবাহানা’ দেখে সেই দেশটির সেনা প্রধানের উক্তিটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে , প্রশংসিত হয়েছে। তার সেই মন্তব্য স্বৈরাচারী ট্রাম্পের ‘তিড়িং-বিড়িং ‘( শব্দটি কর্ণকূহরে প্রবেশ করেছিল একজন বিশ্বনেত্রীর মুখ থেকে, বিনোদিত হলে কৃতজ্ঞতা তারই প্রাপ্য) অনেক কমিয়ে এনেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমেরিকার বর্তমান জয়েন্ট চীফ অব স্টাফের নিয়োগ হয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় এবং তারই হাত দিয়ে। নিয়োগদাতার প্রতি সেই কৃতজ্ঞতায় জাতির প্রতি নিজের শপথ থেকে বিচ্যুত হন নাই , নীরব থাকেন নাই। দেশ ও জাতির স্বার্থে যা বলার তা বলে দিয়েছেন । দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে ঠিক ট্র্যাকে রেখেছেন কিন্তু নিজে রাজনীতি করেন নাই। এতে কোন্ দল বা কোন্ ব্যক্তি লাভবান হয়েছে সেটি গণনায় নেন নাই ।
একটি আদর্শিক গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকাটি কী হবে বা কী হওয়া উচিত জেনারেল মিলি মার্ক তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন । বিপরীত ক্রমে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভালো নির্বাচন বলে প্রশংসা করেছিলেন আমাদের সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ ! তার সেই সাফাই গাওয়া আঠার কোটি মানুষের কলিজায় আঘাত দিয়েছে। সেই নির্বাচনটিতে তারা কেউ ভোট দিতে পারে নাই। জনগণ করুণ চোখে দেখছে যে দেশটি এক ডাকুরাণীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এবং তাদের কলিজার সেনাবাহিনী সেই ডাকুরাণীর চৌকিদার সেজে বসেছে ! একটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর শৃঙ্খলা ও স্পর্শকাতরতা এমন যে পুরো কম্যান্ডের বিরুদ্ধে যাওয়া পুরো ট্রুপের কারও পক্ষেই সম্ভব নহে। অথচ সেই কম্যান্ডের কাজের দায় সকলকে বহন করতে হয় !
আমাদের দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে খোলামেলা আলোচনা স্পর্শকাতরতার চাদর টেনে বন্ধ করে রাখা হয়েছে । এক সময় পুলিশ নিয়ে নাটক সিনেমা বানাতে হলে শুধু তাদেরকে সৎ পুলিশ অফিসার হিসাবে দেখানো অতি আবশ্যকীয় রেওয়াজ ছিল। পুলিশের ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ে কিছু দেখানো যেতো না। ফলে সংবিধিবদ্ধ ভাবনা হিসাবে উপরে পুলিশকে যত ফিটফাট বা সৎ দেখানো হয়েছে ভেতরে তত সদরঘাট বনে গেছে। আমাদের গর্বের ও গৌরবের সেনাবাহিনীর পরিস্থিতিও সেরকম পর্যায়ে পৌছে গেছে। বিষয়গুলি নিয়ে একাডেমিক আলোচনার সুযোগ থাকলে আমরা একটি গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়তে পারতাম ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সম্মুখে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কয়েকজন প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন এবং অল্প দিনেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে পড়েছেন। এর একটি পজেটিভ প্রভাব সেনাবাহিনীতে পড়বেই ইনশাআল্লাহ ।
গণতন্ত্র একটা জাতির জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ। সেই আশীর্বাদটি জনগণকে মনে প্রাণে চাইতে হবে। গণতন্ত্র এমন জিনিস যেটি কেউ কাউকে উপহার হিসাবে দেয় না। নিজেদেরকেই তা আয়ত্ত্ব করতে হয়। জনগণের একটা অংশ নিয়েই সেনাবাহিনী । জনগণের ক্ষোভ, হতাশা সেনাবাহিনীতেও ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব নহে । স্পর্শকাতরতার কথা বলে তাদেরকে এই বোধ ও ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না ।