এক সাথে রাজনীতির অনেক ট্রাম্পকার্ড খেলছেন দখলদার ফ্যাসিবাদি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পরিচিত শেখ হাসিনা। ভাস্কর্যের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মাণ নিয়ে রাজপথে হুঙ্কার-পাল্টা হুঙ্কারে ঢাকা মহানগর পুলিশ সভা সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। লাউড স্পীকার নিয়ন্ত্রণের নামে ওয়াজ মাহফিল বন্ধের সিদ্ধান্তও জারি করা হয়েছে জেলা প্রশাসন থেকে। এর মাধ্যমে মানুষের কথা বলার অধিকারকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদি চরিত্রের বহি:প্রকাশ ঘটেছে। এই সাথে খরব বের হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে ইসলামিয়াত ও নৈতিক শিক্ষা পাঠ্য বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করছে সরকার। এই সিদ্ধান্তটিও মানুষের ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রনের জন্যই নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ দিন থেকেই আইসোলেশনে থাকা বিরোধী জোট এনিয়ে নীরব। তারা মনে করছে এটা আওয়ামী লীগ ও হেফাজত এবং আলেমদের বিরোধ। দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিষয়েও যেন তাদের বলার কিছু নেই।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পূর্ব অনুমতি ছাড়া সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পর প্রতিবাদ জানিয়েছে আইসোলেশনে থাকা বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়- অনুমতির নামে সরকার রাজনীতিকে বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আটকে মানুষের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, জনগণের অধিকার হরণ করছে। রাজনীতির স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ও সংকুচিত করছে। মূলত: প্রশাসনকে অপব্যবহার করে জনরোষ ও গণআন্দোলন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সরকার সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, মিটিং, মিছিল করতে হলে পুলিশের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আওয়ামী ও ভারতপন্থি টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে দেখা গেছে সরকারকে কঠোর হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন আওয়ামী সাংবাদিকরা। তাদের ভাষা ছিল, ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনকে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যার মত করে প্রতিহত করতে হবে। সরকারের দালাল হিসাবে পরিচিত এসব সাংবাদিক নামধারীদের মুখ থেকে ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন দমনে কঠোর হওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শের পাশাপাশি রাস্তায় নামে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে ইসলাম বিদ্বেষী বিভিন্ন সংগঠন। তারাও ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের মোকাবেলা করার হুশিয়ারি দিয়েছে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কার্য বিরোধীদের রাজপথে দেখে নেওয়ার হুঙ্কার দিচ্ছেন। সরকারের মন্ত্রীদের কেউ ঘাড় মটকে দেয়ার হুঙ্কার ছুড়ছেন। কেউ হুঙ্কার দিয়েছেন ফাইনাল খেলার।
রাজনৈতিক আইসোলেশনে থাকা বিএনপি মহাসচিবের প্রতিবাদ
সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজনৈতিক আইসোলেশনে থাকা বিরোধী জোটের প্রধান দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকা মহানগরীতে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিএনপি’র মহাসচিব বলেছেন, সংবিধান ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ডিএমপি-কে দিয়ে পূর্বানুমতি ছাড়া রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার আবারও সংবিধান লংঘন করলো। অথচ ক্ষমতাসীন দল বা তাদের সমর্থক সংগঠন কোনো পূর্বানুমতি বা শর্ত ছাড়াই যখন তখন রাস্তা বা লোকালয় দখল করে সভা-সমাবেশ করছে। বুধবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স সাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব বলেন, সংবিধানে অবাধে সভা-সমাবেশ করার অধিকার যেকোনো নাগরিক ও সংগঠনের আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংবিধান স্বীকৃত জনগণের এই অধিকার বিভিন্ন সময় কেড়ে নিয়েছে অথবা সংকুচিত বা নিয়ন্ত্রিত করেছে, যা সংবিধানের লংঘন।
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল আরো বলেন, অনুমতির নামে সরকার রাজনীতিকে বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আটকে নিয়ন্ত্রণ করছে, জনগণের অধিকার হরণ করছে। রাজনীতির স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ও সংকুচিত করছে। মূলত: প্রশাসনকে অপব্যবহার করে জনরোষ ও গণআন্দোলন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সরকার সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
জাসদ (রব)-এর প্রতিবাদ
ঢাকায় সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জে এস ডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ছানোয়ার হোসেন তালুকদার। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবান্বিত বিজয়ের মাসে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করে ৭১ এর বিজয় কে উদযাপন করে থাকেন। অথচ এই সময়ে সরকার মিছিল সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কালিমা লেপন করেছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ভিন্নমত ও পথকে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা বল প্রয়োগ করে রুদ্ধ করার মানসিকতা থেকেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রাজনীতিবিহীন সমাজ জনমনে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, জনগণকে আত্মউপলব্ধি থেকে বঞ্চিত করে এবং ব্যক্তির আত্মবিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
জননিরাপত্তার অজুহাতে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশকে নিষিদ্ধ করা রাষ্ট্রকে আরো দুর্বৃত্তায়ন করার অপচেষ্টা। গণতন্ত্রহীনতা সমগ্র সমাজকে ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থাৎ সমাজকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্থবির করে মধ্যযুগের দিকে ধাবিত করছে। ভয়াবহ দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ ও চরম অব্যবস্থাপনা এই গণতন্ত্রহীনতারই ফসল যা সরকার উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সংবিধান বহাল রেখে প্রতি ক্ষেত্রেই সংবিধান লংঘন করে সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের যে বয়ান দিচ্ছে তা জাতির সাথে নিম্নমানে একটি তামাশামাত্র। জনবিচ্ছিন্ন সরকার জননিরাপত্তা নয়, বৈধতা সংকটে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রায়শ’ই সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার বাহানা খোঁজে।
সেই ধারাক্রমেই সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধকরণে সরকারের সর্বশেষ এ পদক্ষেপ। দেশকে গণতন্ত্রহীন করে সরকার তাদের যে ‘স্বপ্ন রাজ্য’ গড়ে তুলেছে জনরোষের কারণে তা ক্রমাগতই অরক্ষিত হয়ে পডছে এবং সরকারের জন্য তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের কুফল বয়ে আনবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিবাদ
অনুমতি ছাড়া রাজধানীতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সভা, সমাবেশ ও গণজমায়েত না করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দেয়া নির্দেশনা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আজ বৃহস্পতিবার সকালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃক ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সামনে সম্প্রতি ঢাকায় মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহম্মদপুরে জহুরী মহল্লায় বস্তি ও মিরপুরের কালশীর বস্তিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ বস্তিবাসীদের মাঝে কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচি উদ্বোধনকালে তিনি এ আহ্বান জানান।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশের এই কান্তিকালে, এই দুর্যোগের মুহূর্তে ডিএমপির একটি নোটিশ মর্মাহত করেছে। মানুষ চলাফেরা করতে পারবে না, সভা সমাবেশ করার জন্য অবশ্যই পুলিশকে অবহিত করা হবে। কিন্তু অনুমতি নিতে হলে আপনারা তো অনুমতি দেন না, এটা সবার জানা কথা। কাউকে সংবর্ধনা দিতে দিবেন না, বক্তব্য রাখতে দিবেন না, সমালোচনা করতে দিবেন না, এটা ভালো কাজ না। তাই আমি ডিএমপিকে অনুরোধ করছি এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করার জন্য। তিনি বলেন, সভা সমাবেশের জন্য আপনাদেরকে জানানো হবে যাতে আপনারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেন।
যতগুলো বিশৃংখলা হয়েছে তার জন্য সরকারই দায়ী। আজকে ভাষ্কর্য- মূর্তির ঝামেলা তৈরি করতে সরকার এক দিকে মদত দিয়েছে, অন্যদিকে যখন দেখছে সামাল দেয়া যাচ্ছে না তখন এই অবস্থা।
তিনি বলেন, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবেন না। মিছিল মিটিংয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না।
ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতিবাদ
ঢাকা মহানগরীতে অনুমতি ছাড়া যেকোনো ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদেও বিবৃতিতে বলা হয়- সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে সংবিধান পরিপন্থী কাজ করছে সরকার।
সংগঠনটির আহ্বায়ক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রাশেদ খাঁন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই ঢাকা মহানগর পুলিশের জারি করা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, বিজয়ের মাসে ডিএমপি কর্তৃপক্ষের এ ধরণের সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক, জন-বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। একইসঙ্গে সভা,সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে সংবিধান পরিপন্থী কাজ থেকে ডিএমপি কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত হলো – জনগণকে মত-প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনগণের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ করেছে। দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি, করোনা মহামারিতে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, লুটপাটসহ সাম্প্রতিক সময়ের নানা অপকর্মের কারণে সরকারের প্রতি যে জনরোষ তৈরি হয়েছে সেটা রুখতেই সরকার ও প্রশাসন এমন মানবতাবিরোধী ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বিজয়ের মাসে সংবিধান বিরোধী যে কোন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।