- খন্দকার হাসনাত করিম
- ২৪ জুন ২০২৪, ০৭:১৬
বিশ্ব বিবেক যখন ইহুদিবাদী গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে; তখন ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি চানক্যরা সমানে হামাস তথা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে অনলাইন অপপ্রচারে নেমেছে। ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে এবং হামাসের ‘উগ্রতা’ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য, চিত্র, মতামত ও জরিপ চালানো হচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়া গাজা-ইসরাইল যুদ্ধে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির নৃশংসতাবিরোধী মার্কিন ছাত্র আন্দোলনে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়ন, প্রবাসী মুসলমানদের মদদ প্রভৃতি অভিযোগ এনে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় বৈধতা, হামাস দমনের যৌক্তিকতা এবং সাংবাদিকদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কেও তথ্যস্রোত উজাড় করে বিশ্ববিবেককে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ফিলিস্তিনের সমর্থনে দেয়া পোস্টগুলো গায়েব করে দিচ্ছে।
স্বাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে গাজার সমর্থন দেয়া পোস্ট সরিয়ে মনগড়া ইহুদি-সমর্থিত তথ্য ও চিত্রাবলী পোস্ট করছে। এ ছাড়া মুসলিমবিদ্বেষী, আরববিদ্বেষী এবং গণহত্যার সমর্থনেও তারা হিংসা ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি এ ধরনের কুকীর্তির দেড় হাজার দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করে পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, মুসলিমবিদ্বেষী ও হিংসা ছড়ানো এ ধরনের আরো ৫৭৩টি তথ্যহামলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটাই উদ্দেশ্য; ফিলিস্তিনিদের প্রতি জেগে ওঠা বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করা এবং ইসরাইলের কার্যকলাপে পাশ্চাত্যের নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখতে উদ্বুদ্ধ করা।
সম্প্রতি গুজব রটানো হয়, হামাস নাকি অধিককৃত ইসরাইলিদের ৪০টি শিশুকে খুন করেছে। অথচ খোদ ইসরাইলি সরকার এমন দাবি করেনি। প্রচারণা চালানো হচ্ছে, হামাস নাকি গণহত্যা চালিয়ে সমগ্র অঞ্চলে ও বিশ্বব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তারা নাকি বর্ণবাদ এবং ইহুদিবিরোধী মনোভাব (এন্টি-সেমিটিজম) ছড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথে হামাসই বড় অন্তরায়। এসব তথ্য তারা এর ওর মুখ দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর জনগণকে হামাসের ‘ইমোশনাল ব্লাকমেইলে’ বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। এ ধরনের মিথ্যাচারে কিছু কাজ যে হচ্ছে না এমন নয়। সম্প্রতি একটি নারকীয় ঘটনায় দেখা গেছে, একজন মার্কিন বাড়িওয়ালা তার বাসার ভাড়াটিয়া একটি আরব-আমেরিকান পরিবারের ছয় বছর বয়সী শিশু ওয়াদিয়া আল ফাইউমীর দেহে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করে। এ সময় সারাক্ষণ সে হুংকার ছেড়ে বলছিল, ‘তোরা মুসলিম। তোদের এভাবে মারা উচিত।’ ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের প্লেনফিল্ডে।
প্রধানত, ভারত থেকে জেনারেট হওয়া আরববিরোধী, মুসলিমবিরোধী এবং ইসরাইল সমর্থক এসব অ্যাপ প্রচারণার উৎসস্থল ভারত। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ‘মিডল ইস্ট মনিটর’ পত্রিকার মন্তব্য, ‘এসব কুচক্রীর উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনের বিপক্ষে তথা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ইতোমধ্যে বিশ্বের বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে ইসরাইলি হানাদারের বিরুদ্ধে জাগ্রত বিশ্ববিবেককে বিভ্রান্ত করতে ইসরাইলবিরোধী কনটেন্ট বা মতামত গায়েব করে দেয়ার এবং হামাসকে মানবতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী হিসাবে তুলে ধরার অভিযোগ করতে শুরু করেছেন। বেলজিয়াম নিবাসী একজন চিত্রনির্মাতা থমাস ম্যাডেন অভিযোগ করেছেন এই বলে যে, তিনি সম্প্রতি ‘টিকটকে’ ফিলিস্তিনে ইসরাইলি গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে যে কনটেন্টটি পোস্ট করেছিলেন কোনো রহস্যময় সূত্র থেকে তা ডিলিট করে দেয়া হয়েছে।
এ ধরনের ফিলিস্তিনি-সংহতিমূলক পোস্ট ও কমেন্ট মুছে দেয়া হচ্ছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স, ইউটিউব এবং টিকটকের মতো জনপ্রিয় প্লাটফর্ম থেকে। গাজা, রাফা বা পূর্ব জেরুসালেমে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বেপরোয়া গণহত্যা, ধর্ষণ, শিশু বধ এবং রোগীদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার সংবাদ ও ছবিও মুছে দেয়া হচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাদের পোস্ট করা কনটেন্ট ও লাইভ বা স্থির ছবি এমনভাবে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে, শিরোনাম দেখা গেলেও সেখানে ছবি দেখা যাচ্ছে না।
গত কয়েক মাসে আটটির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করেছে, ফিলিস্তিনিদের সর্বজনীন ডিজিটাল অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এটা বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের গালে চপেটাঘাত। এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পরই ইসরাইল কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশনকে নিষিদ্ধ করে।
আরবদের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে এমন একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক অভিযোগ করেছেন, তাদের প্রতিদিনের অনলাইন পাঠক সংখ্যা গাজা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ছিল ১২ লাখ, যেটা এখন দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ১১ লাখ পাঠকের মতামত, নিউজফিড, ব্লগ বা সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়াও সাইবার গুপ্তচরেরা গায়েব করে দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাভিত্তিক একটি সাইবার অপরাধ বিরোধী টেক-রিসোর্স প্রতিষ্ঠান নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি ‘পেজ’ খুলে সেখানে সাইবার অপরাধের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগে অপারগ ও কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যবহারকারীদের অভিযোগ জানাতে অনুরোধ করেছে। বিগ-টেকদের সাইবার অপরাধমূলক বিষক্রিয়া থেকে সাধারণ ব্যবহারকারীদের যুক্তি দেখাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সম্প্রতি ‘ডিজিটাল সার্ভিলেন্স অ্যাক্ট’ নামে একটি নতুন আইন পাস করেছে। এক্স (সাবেক টুইটার) এবং ‘মেটার’ মতো বিগ টেক-জায়ান্টদের বহু কর্মস্থান থেকে কর্মচারীরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মচারীদের দলে দলে অন্য কর্মস্থলে চলে যাওয়ার কারণ হিসাবে বেতন-ভাতা বেশি বলে যত ব্যাখ্যা দিক না কেন, টেক-পর্যালোচকদের ধারণা, মূলত ডিজিটাল জোচ্চুরি এবং সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য দিয়ে প্রলেপ দেয়ার চাতুর্য ও শঠতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে তারা এসব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাচ্ছে। এটিও মার্কিন ছাত্রছাত্রীদের মতো এক ধরনের নৈতিক ও মানবিক প্রতিবাদ। পরিতাপের বিষয়, এ প্রতিবাদ ইউরোপ, কানাডায়, যুক্তরাষ্ট্রে হলেও কোনো প্রতিবাদের ধ্বনি উঠছে না সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, মিসর, জর্দান কিংবা আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরঘিজিয়া, তুর্কমেনিস্তানে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় এলাকা এবং মধ্য এশিয়ায় হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ আছে। কোনো একটি মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কলাম্বিয়া, জর্জটাউন, উইসিএলএ, ব্রাউন, নর্থওয়েস্টান, কিংবা বোস্টনের এমআইটির ছাত্রদের মতো লেখাপড়া শিকেয় তুলে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সংহতি-প্রতিবাদ তাঁবুতে অবস্থান করে প্রতিবাদ জানানোর এমনকি গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান ত্যাগ আর কারাবরণের মতো প্রতিবাদের ভূমিকায়ও দেখা যায়নি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, লোহিত সাগর থেকে যে তেলের পাইপলাইন মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া সমুদ্রবন্দরে সংযুক্ত হয়েছে সেই ডিপো থেকে মিসর আজও নিয়মিতভাবে ইসরাইলকে তেল সরবরাহ করে যাচ্ছে। মিসর ১৯৭০ সালে এ তেলপথ করেছিল সুয়েজ খালের বিকল্প হিসাবে। তখন থেকে মিসরের মতলব ছিল ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটিকে মদদ জোগানো। ইসরাইলের রোজ তেল লাগে ২ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল। এ তেলের ৬০% জোগান আসে মুসলিম রাষ্ট্র(?) আজারবাইজান এবং কাজাখস্থান থেকে।
ইরানই একমাত্র দেশ যে গত অক্টোবর (২০২৩) জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির জরুরি সভায় সব মুসলিম রাষ্ট্রকে ইসরাইলকে তেলের জোগান বন্ধ করতে উদাত্ত আহ্বান জানায়। যাদের বিবেক তেল আবিবের শুঁড়িখানায় বন্ধক দেয়া, কেন তারা শুনবে ইরানের এ মানবিক আহ্বান? নিকারাগুয়া একটি খ্রিষ্টান দেশ। এ দেশটিও যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার পথ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার প্রতিবাদে মামলা ঠুকছে সেখানে মিসর, জর্দান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান ইসরাইলী যুদ্ধ মেশিনে তেল, মবিল জোগাচ্ছে! শত্রু পক্ষে মিত্ররা ঢুকছে এসব স্বধর্মী, স্বজাতি রাষ্ট্রগুলো শত্রুকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এবার বুঝে নিন, ইসরাইলের বন্ধু কি কেবল আমেরিকা-ব্রিটেন? রাফা থেকে আরব নাগরিকদের সরে যাওয়ার ইসরাইলি নির্দেশের মতলব: গাজা ও পশ্চিম তীরে দখল কায়েম। ইহুদিবাদের অপকর্মে ইন্ধন জোগাচ্ছে আরব রাজতন্ত্র এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্রগুলো যারা কথার কথায় হিটলারের নাৎসিবাদের সমালোচনা করে। কোন মুখে তারা হামাস, দ্রুজ, হুতি কিংবা হেজবুল্লাহর সমালোচনা করে?
এরা তো পৃথিবীর দ্বিতীয় হিটলার বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর নব্য নাজীবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন। ৩৬ হাজার গাজাবাসী ২০০ দিনের যুদ্ধের বলী হয়েছেন। এ গণহত্যার প্রতিবাদে গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন বিবেক দংশনে ভুগছেন আরব বাদশাহরা এবং জবরদখল করে ক্ষমতা লুণ্ঠনকারী মিসরীয় হানাদার সিসি তখন ইসরাইলিদের আরব গণহত্যায় সমর্থন জোগাচ্ছেন। যে জর্দানের থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল পশ্চিম তীর সেই জর্দানি বাদশাহ হোসেন তখন জো বাইডেনের চেয়েও পরম ইহুদি-মিত্র!
গাজায় যে পাপ ইসরাইল করছে, তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বিশ্বাসঘাতক জর্দানের এবং আশীর্বাদ রয়েছে কায়রো-দুবাই শাসকচক্রের। এবার আশা করি পরিষ্কার হয়ে গেলো, কেন ইসরাইলের ইহুদিবাদ এত বেপরোয়া এবং অপ্রতিহত? কেন জাতিসঙ্ঘের ৮০ শতাংশ সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সর্বসম্মত সমর্থনের পরও ওয়াশিংটন-তেলআবিব কোথাও কেন কারো মুখে ‘টু-স্টেট সল্যুশনের’ নামগন্ধ পর্যন্ত নেই? কেন একের পর এক এলাকা ধ্বংস করে ইহুদিবাদীরা সেখান থেকে আরব অধিবাসীদের ভেগে যেতে বলছে? আসলে ইসরাইল গণকবরের ওপর গড়ে তুলতে চায় ‘জুইশ সেটেলমেন্ট।’ বড় করতে চায় ইসরাইলের মানচিত্র!
লেখক : সাংবাদিক