হেফাজতে ইসলামের নবনির্বাচিত আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের মঞ্চেই গুলি করে মারার পরিকল্পনা ছিলো। এমনকি হেফাজতের এই নেতাকে র্যাব অফিস নিয়ে ঝুলিয়ে নির্যাতন এবং দুই পা পঙ্গু করার পরিকল্পনাও ছিলো। আর তাকে মঞ্চে হত্যা করতে শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা হয়েছিলো ভারতীয় এজেন্টদের চাপেই। একজন র্যাব কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য আগেই প্রকাশ করেছিলেন প্রবীন এই আলেম। বিষয়টি তখন যথাযথভাবে প্রচার হয়নি। সম্প্রতি ইউটিউভে প্রচারিত একটি বক্তব্যে বিষয়টি সামনে আসে।
গত জুন মাসে ইউটিউবে ১০ মিনিটের এই বক্তব্য প্রচার করা হয়। প্রথম সাড়া না ফললেও, সম্প্রতি বাবুনগরীর চাঞ্চল্যকর সেই সাক্ষাতকারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
অত্যন্ত সাবলীলভাবে ২০১৩ সালের মে মাসে ১৩ দিনের রিমান্ড এবং কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তিনি। র্যাব কর্মকর্তার দ্বারা হত্যা ও নির্যাতনের হুমকি, ডিবি কার্যালয়ে তাকে রহস্যজনক ইনজেকশন পুশ করা, বিএনপি-জামায়াতের সাথে সম্পর্ক আছে কি নেই তা জানতে গোয়েন্দাদের চাপের কথাও বর্ণনা করেন হেফাজতের আমীর।
ডিবি অফিসে নেয়ার পর প্রথমে তাকে ধমক দেওয়া ও বেয়াদবি করার কথাও জানান এই শীর্ষ আলেম।
এমনকি রিমান্ড শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নিয়ে কটূক্তি করতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডিবির এক কর্মকর্তা। কিন্তু, চাপের মুখেও তাতে রাজি হননি তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের গণহত্যার সময় সেখানে উপস্থি বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি অফিসে নেয়ার পর সেখানে ছুটে যান বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের কর্মকর্তারা। ডিবির শীর্ষ কর্মকর্তার সামনেই সেই র্যাব কর্মকর্তা বাবুনগরীকে জানান যে তাকে মঞ্চেই হত্যার নির্দেশনা ছিলো।
আমার দেশ পত্রিকার বানান ও ভাষারীতিতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর সাক্ষাতকারটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। বাবুনগরী ইউটিউবে সাক্ষাতকারে যা বলেছিলেন:
আমাকে প্রথমে নিয়ে যায় মতিঝিল থানায়। সেখান থেকে নেয়া হয় ডিবি অফিসে। ডিবি অফিসে নেয়ার পর আমাকে বড় বড় অফিসারদের কাছে নেয়া হয়। তারা আমাকে প্রথমে খুব ধমকায়। বেয়াদবিও করে।
প্রথমে একজন অফিসার বলেন, কোরআন অবমানাকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা ফাঁসির দাবি করছেন। এই আইন যদি পাস হয় সর্বপ্রথম ফাঁসি দিতে হবে আপনাকে।
(আমি জিজ্ঞাসা করলাম) কেনো?
(জবাবে সেই কর্মকর্তা বলেন) কারণ আপনিই তো গতকাল বায়তুল মোকাররমের সামনে কোরআন পুড়িয়েছেন। আপনি ছেলে মেয়েদের চেহারা আর দেখবেন না। ১৭ টা মামলা হয়েছে। এখান থেকে লাশ যাবে (আপনার)।
বাবুনগরী বলেন, তারা তো প্রথমে আমাকে আসামি বলতো। দুইদিন পর্যন্ত আসামি বলেছে। এরপর আলহামদুলিল্লাহ হুজুর হুজুর বলা শুরু করেন তারা।
প্রথমে আমার রিমান্ড ছিলো ৯ দিন। রিমান্ডে আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর বস (শীর্ষ ডিবি কর্মকর্তা। নাম বলেননি বাবুনগরী) এর অফিসে আমাকে ডাকে একদিন। সেখানে র্যাবের একজন ম্যানেজার (কর্মকর্তা বুঝিয়েছেন বাবুনগরী) যায়। সাথে আরো অফিসাররা ছিলো।
র্যাবের ম্যানেজারের চেহারা দেখতে একটু চাকমার মতো। কিন্তু সে ছিলো বেশি রাগী। সে (র্যাবের কর্মকর্তা) আমাকে বলেন আমি আপনাকে মঞ্চে টার্গেট করেছিলাম। অর্ডার ছিলো ওইখানেই আপনাকে গুলি করা। কিন্তু, ২ মিনিটের মধ্যেই আপনি সরে গেছেন। এখন কিন্তু ছাড়াছাড়ি নাই। এখন আমি ডিবি অফিসে আপনাকে রাখবো না। এখান থেকে আমাদের র্যাব অফিসে নিয়ে যাবো। বসের (ডিবি কর্মকর্তা) কাছে আমি অনুমতি চাই। উনি যেনো আমাকে অনুমতি দেন। আপনাকে র্যাবের অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর আপনার প্রথম ব্যায়াম হবে। ব্যায়াম হলো পা উপরের দিকে আর কল্লা নিজের দিকে। এভাবে আপনাকে ঘুরাবো। এরপর আপনার দুইটা লুলা করে দেবো। এটা আমাদের উপরের নির্দেশ।
এসময় ডিবির বস তাকে থামিয়ে দেন। ডিবি কর্মকর্তা র্যাব কর্মকর্তাকে বলেন, ‘একটু থামো.. একটু থামো’। উপরের নির্দেশ এখন একটু ব্যতিক্রম। এই আসামি আমার কাছেই থাকবে। তোমাকে দেব না। এখানেই রাখবো। আল্লাহর রহমত আর কি! র্যাবে নিয়ে গেলে অবস্থা কী হতো আল্লাহ তায়ালাই জানে। ওইখানে আমার ওপর একটা প্রেসার ছিলো।
এরপর ডিবির দুইজন অফিসার আমাকে বলেছে, হুজুর আপনার ওপর বেশি প্রেসার ছিলো বামপন্থীদের। বামদের, শাহবাগীদের। আলহামদুলিল্লাহ এইটা কেটে গেছে। তাদের প্রেসার ছিলো যে (র্যাবের মাধ্যমে) আপনার দুই পা লুলা করা আর পা উপরে বেঁধে কল্লা নিচে দিয়ে ঘুরানো।
এরপর অন্যান্য অফিসাররা সেরকম কিছু করে নাই। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অনেক রকমের জিজ্ঞাসাবাদ। আফগানিস্তানের মোল্লা ওমরের সঙ্গে আমার কয়টা বৈঠক হলো। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়বার বৈঠক। লেনদেনের সম্পর্ক কী? সবকিছুর জবাব আমি দিয়েছি।
কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করেছে যে, খালেদা জিয়া কীরকম।
তারা আমাকে প্রস্তাব দেয় যে, আপনি এক কাজ করেনৃ আপনার রিমান্ড শেষ আজকের জন্য। এখান থেকে উঠার সময় খালেদা জিয়াকে একটু গালি দেন। একটা শব্দে গালি দেন। তারপর চলে যান। আমি মুখটা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে এসেছি। কেন গালি দেব? গালি দেয়ার কোনো অর্থ আছে?
বাবুনগরী বলেন, প্রথম দফায় ৯ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিলো। এরপর ৪ দিন রিমান্ড। মোট ১৩ দিন। রিমান্ডে আমার কিছু চিকিৎসা করানো হয়েছে। ইনজেকশনও দিয়েছে। কিন্তু, আমি বুঝতে পারি নাই এটা ভালো হওয়ার জন্য না খারাপ হওয়ার জন্য। এটাও বুঝা কঠিন ছিলো আমার জন্য। তারা আমাকে বাতের ওষুধ দিয়েছে বেশি। বাতের ওষুধের জন্য কিডনির একটু সমস্যা হয়ে গেছে আমার।
এরপর আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে ছিলাম একদিন ও এক রাত। সেখান থেকে নেয়া হয় কাশিমপুর কারাগারের হাসপাতালে। এরপর জেল হাসপাতালের প্রধান বোর্ড বসান। তারা সরকারের কাছে সুপারিশ করেন যে এই রোগী এখানে থাকলে মারা যাবে। সরকারের অনুমতি পাওয়ার পর ২৬শে মে আমাকে রাতে বারডেমে পাঠানো হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তারা আমাকে প্রশ্ন করেছে যে, আপনাদের ডাকে ত্রিশ/চল্লিশ লক্ষ মানুষ কীভাবে জমায়েত করলেন? কত কোটি খরচ হয়েছে? আমি জবাবে বলেছি, আপনাদের নিয়ম আর আমাদের নিয়ম এক না। মানুষ নিজের উদ্যোগে, নিজের খরচে এসেছে। ঈমানী দায়িত্ব পালন করার জন্য। আমরা কাউকে আনার জন্য গাড়ী পাঠাই নাই। ইনশাআল্লাহ ঈমানী আন্দোলন চলতে থাকবে।
একজন বড় গোয়েন্দা অফিসার নাম বলবো না তিনি এসে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেন যে, আবার যদি আপনারা ডাক দেন এরকম কিছু হবে? আমি বললাম, এর চাইতে আরো ডাবল হবে।
সেই কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করেন যে, বিএনপির ও জামাত-শিবিরের সাথে আপনার লেনদেন কেমন? আমি বললম.. আল্লাহ কসম ৫ টাকাও কারো থেকে আমি গ্রহণ করি নাই। আমরা কোনো লেনদেন করি নাই। ওদের সঙ্গে আমাদের লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নাই। সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক নাই। যেকোনো দলের মুসলমান হেফাজতের সঙ্গে থাকতে পারবেন। তবে কোনো দলীয় এজেন্ডা দিয়ে নয়।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আল্লাহতায়ালা অনেক সময় জালেমকে কিছু সুযোগও দেন। যেমন ফেরাউন ও নমরুদকে সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন ধরার টাইম আসবে আল্লাহতায়ালা ধরবেন।
ইনশাআল্লাহ হেফাজতের ইসলামের অগ্রগতি আরো বাড়বে। আরো চাঙ্গা হবে। আরো মজবুত হবে। হেফাজতের ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ এই দেশে ইসলামকে টিকিয়ে রাখবেন।