ফল বাতিলের ক্ষমতা চায় নির্বাচন কমিশন

ইসি

জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কোনো ভোটকেন্দ্রে বলপ্রয়োগ, ভয়ভীতি দেখানো বা কারসাজির কারণে ফলাফল পক্ষাপাতদুষ্ট মনে হলে ওই ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে ইসি। ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় এ সংক্রান্ত একটি নতুন বিধি যুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ইসির আইন সংস্কার কমিটি। বিদ্যমান উপজেলা পরিষদ আইন ও বিধিমালায় এ অভিযোগে ফল বাতিলে এমন ক্ষমতা ইসির নেই। ওই বৈঠকে জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম স্থগিত বা বাতিলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবেও সায় দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার সভাপতিত্বে গত ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ভবনে আইন সংস্কার কমিটির এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার বর্তমান নিয়ম বাতিল ও শুধু অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান যুক্তের প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারণায় আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন হয় কিনা-তা মনিটরিং করার জন্য কমিটি গঠনের এখতিয়ার ইসিকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন বিধিমালার পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচন আচরণ বিধিমালার কিছু জায়গায় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনি প্রচার পরিবেশবান্ধব করতে পোস্টারে পলিথিনের আবরণ ব্যবহার এবং প্লাস্টিক ব্যানার নিষিদ্ধ করা, মাইকের শব্দের মান মাত্র ৬০ ডেসিবেলের নিচে রাখার কথা উল্লেখ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইন সংস্কার কমিটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালার সংশোধনী অনুমোদনের জন্য নির্বাচন কমিশনে সুপারিশ আকারে পাঠাবে। কমিশন সভায় ওই সুপারিশ অনুমোদন দেওয়া হলে তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। বিধিমালা সংশোধনের জন্য সংসদ অধিবেশনের প্রয়োজন হবে না। এসআরও জারি করলেই চলবে। বিধিমালা সংশোধনের এখতিয়ার ইসির রয়েছে। ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, দেশের সাড়ে চারশর বেশি উপজেলায় আগামী মে মাসে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চার ধাপে ৪, ১১, ১৮ ও ২৫ মে এসব উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। ওইসব নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই এ দুই বিধিমালা সংশোধনের লক্ষ্যে কাজ করছে ইসি।

জানতে চাইলে আইন সংস্কার কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা গত বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আইন সংস্কার কমিটির দুই দিনের বৈঠকে ইসি সচিবালয়ের দেওয়া প্রস্তাব পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে। ওই সুপারিশ কমিশনের কাছে তোলা হবে। কমিশন অনুমোদন করার পর আমি নিজেই তা গণমাধ্যমকে জানাব। কমিশন সভার আগে বিধিমালা সংশোধনের বিষয়ে জানাতে রাজি হননি তিনি।

সংসদ নির্বাচনের কিছু বিধান উপজেলায় : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার প্রধান আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর কিছু বিধান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় যুক্ত করতে যাচ্ছে ইসি। এর একটি হচ্ছে-নির্বাচনে ফলাফল বন্ধে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করার ইসির ক্ষমতা আরপিওর ধারা ৯১-এর দফা (কক) এ উল্লেখ রয়েছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালার ৮৮ বিধিতে ওই বিধান যুক্তের সুপারিশ করেছে আইন সংস্কার কমিটি। এ বিধান যুক্ত হলে, নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে বলপ্রয়োগ, কারসাজি, পক্ষপাতের অভিযোগ উঠলে ফলাফল স্থগিত রেখে তদন্তের নির্দেশ দেবে ইসি। তদন্তে তা প্রমাণিত হলে ওই ফলাফল বাতিল করে পুনরায় ভোটগ্রহণ করতে পারবে।

উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের হুমকি, কাজে বাধা দেওয়া বা ভয় দেখালে তা ‘নির্বাচনি অপরাধ’ হিসাবে নির্বাচন বিধিতে নতুন করে সংযোজনের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন সংস্কার কমিটি। নির্বাচন বিধিমালায় বিধি ৮০-এর দফা ‘ক’-তে সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধে সর্বনিম্ন ছয় মাস ও সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বিধান আরপিওর ৮৪ক দফায় সংযুক্ত করে ইসি। এখন তা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও প্রয়োগের চিন্তা করছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাগজে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিদ্যমান বিধান তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে আইন সংস্কার কমিটি। কেবল অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য নতুন সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনে ইসি। ওই নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমায় সাড়া পায়নি কমিশন। এবার উপজেলা নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিধান শিথিলের প্রস্তাব বহাল : জানা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিধান সহজ রাখতে ইসি সচিবালয়ের প্রস্তাব বহাল রেখেছে আইন সংস্কার কমিটি। বর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ২৫০ জনের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে আইন সংস্কার কমিটি। সমর্থনসূচক স্বাক্ষর জমা দেওয়ার ফলে গোপন ভোটের আগেই কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া হয়, যা সংবিধানবিরোধী-এমন কারণ দেখিয়ে এ বিধান বাতিলের সুপারিশ করা হচ্ছে। তবে ভুঁইফোঁড় প্রার্থী ঠেকাতে জামানতের বিধানে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা বর্তমানে রয়েছে ১০ হাজার টাকা। নির্বাচনে যে সংখ্যক ভোট পড়বে ওই সংখ্যার ১৬.৬৬ শতাংশের কম ভোট পাওয়া প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান সংযোজন করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রদত্ত ভোটের ১২.৫ শতাংশের কম ভোট পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ওই ঘোষণার পর নির্বাচনি বিধিতে সংশোধন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিধান শিথিল করতে যাচ্ছে ইসি।

পরিবেশবান্ধব প্রচারণা : জানা গেছে, পরিবেশবান্ধব প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দিয়ে উপজেলা নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ইসির আইন সংস্কার কমিটি। আচরণ বিধিমালায় নির্বাচনি পোস্টারে পলিথিনের আবরণ ও প্লাস্টিক ব্যানারের ব্যবহার নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের মানমাত্রা ৬০ ডেসিবেলের নিচে রাখা এবং জনসভায় একই সঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি মাইক্রোফোন ব্যবহারের বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ইসি আচরণ বিধিমালায় এ সংশোধনী প্রস্তাব এনেছে। এছাড়া নির্বাচনের প্রচারের সময় বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রচারের সুযোগ নেই। তবে আইন সংস্কার কমিটির প্রস্তাবে প্রতীক বরাদ্দের আগেও প্রার্থীরা জনসংযোগ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রার্থীর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ জন সমর্থক থাকতে পারবে।

jugantor