ফলাফল আগে নির্বাচন পরে

শহীদুল্লাহ ফরায়জী :

পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারগণ ভোট দেওয়ার পর অর্থাৎ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ফলাফল জানতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারি, অথচ ফলাফল এখনই জানা হয়ে গেছে। কারণ, সরকার নৌকা নিয়ে একাই নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে, একাই প্রতিযোগী হয়েছে, একাই বিজয়ী হবে। দ্বাদশ নির্বাচনে মূলত: একটাই প্রতীক ‘নৌকা’।

নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য ডামি প্রার্থী রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ঘোষণা দিয়ে ডামি প্রার্থী রাখা যায়, এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে বিরল ঘটনা। প্রার্থী আছে অনেক কিন্তু প্রতিযোগিতা নেই। পুরো নির্বাচনটাই সমঝোতা, পাতানো এবং আঁতাতের নির্বাচন। বলা যায় এটা একটা ডামি নির্বাচন। সুতরাং এখানে বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সংবিধানে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘রাজনৈতিক দল বলিতে এমন একটা অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্রসূচক কোনো নামে কার্য করেন এবং কোনো রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসঙ্ঘ হতে পৃথক কোনো অধিসঙ্ঘ হিসেবে নিজেদেরকে প্রকাশ করেন’।

সুতরাং একই সাথে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে আরেক স্বতন্ত্র বা অন্য দলের প্রার্থীকে সমর্থন করলে নিজেদের পৃথক অধিসঙ্ঘ হিসেবে প্রকাশ করার সাংবিধানিক নির্দেশনা লঙ্ঘিত হবে।

একই সাথে দলীয় প্রার্থী এবং একই সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন- গণতান্ত্রিক রাজনীতি বা সাংবিধানিক নৈতিকতায় অনুমোদন দেয় না।

এবারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পর আবার দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার অনুমতি দিয়ে, তাদেরকে ‘ডামি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডামি প্রার্থী নয়, এখন ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবেই তার নামকরণ করা হয়েছে। দলের প্রতীকের বিরুদ্ধে দলীয় লোক নির্বাচন করবে অথচ দল তাকে বহিষ্কার করবে না, এতে রাজনীতির প্রতি এবং আদর্শের প্রতি কারো কোনো আনুগত্য থাকবে না। বর্তমান সরকারের তিনটি সাফল্য ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে থাকবে-
১) ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচন, ২) ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন, ৩) ‘ডামি’ নির্বাচন।

যারা এই সরকারকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও সমর্থন দিবে, যারা জনগণের ভোটাধিকারের দ্বারা নির্বাচনে বিজয় লাভের উপর আস্থাশীল নয়, আস্থাশীল ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দ পেতে কিংবা নৌকার সহযোগিতা পেতে তারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন না হলেও, ব্যালটের গোপনীয়তা রেখে, ব্যালটের নিরাপত্তা বজায় রেখে এবং কোনো রকমের ভোট জালিয়াতি ছাড়া সমঝোতার প্রার্থীদের জয়লাভ করানো সম্ভব হবে না। সুতরাং সরকারকে লোক দেখানো নির্বাচনেও নৌকার বিরুদ্ধে কোনো না কোনো আসনে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হবে। নতুবা সরকার মিত্রহীন হয়ে পড়বে।

নির্বাচন হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা পরিবর্তনের লড়াই। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নয়; ক্ষমতাকে নবায়নের জন্য, পুনরায় সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য। এটা কেবল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। যা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা, প্রতীক বরাদ্দ, ফলাফল প্রকাশ এবং সর্বশেষে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে। ক্ষমতা নবায়নের জন্য এটুকু আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন পূরণ করতে রাজপথে মানুষের রক্ত নিতে হচ্ছে, নির্বিচারে গ্রেফতার করে কারাগার পরিপূর্ণ করতে হচ্ছে, ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের বিরাট অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সবশেষে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনী নাটকের মাধ্যমে পূর্বতন সরকারকেই নতুন করে শপথ গ্রহণ করানোর আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটবে। এটা নির্বাচন নয়; ক্ষমতা নবায়নের ‘উৎসব’ মাত্র। ফলে জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক এটা ক্রমাগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। জনগণের সমর্থন ও সম্মতি ব্যতীত যখন সরকার গঠিত হয় তখন রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা ছিনতাই হয়ে যায়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনের পূর্বেই সরকার গঠন নিশ্চিত হয়ে যায়। একাদশ নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিলো। কিন্তু রাতে ভোট সম্পন্ন করায় সরকারের বিজয় নিশ্চিত হয়। আর এবার মূলত: এক প্রতীকের নির্বাচন, সুতরাং ফলাফল জানা আছে, শুধু গেজেট প্রকাশের অপেক্ষা। সরকার এবার ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বা ‘রাতের ভোটে’ আস্থা স্থাপন করতে পারছে না। ফলে আওয়ামী প্যানেলের একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছে সরকার।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের প্রার্থীরা সবাই নৌকার মাঝি হতে চেয়েছে। কেউ সরাসরি, কেউ কূট কৌশলে। এখানে অন্য ফলাফলের বা বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ২৬৩ জন এবং  আওয়ামী স্বতন্ত্র ২৬৯ জন। ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৫৩২ জন।

একজন সম্মানিত এবং রাজনৈতিক সচেতন পাঠক জনাব আবুল কাশেমের একটি মতামত( মানবজমিনে প্রকাশিত) পাঠকের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন- ‘যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় নির্বাচন হতে হবে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ভোটারদের মধ্যে থাকবে টানটান উত্তেজনা। শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের পাড়া-মহল্লার চায়ের টং দোকানেও হারজিৎ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় ওঠবে। চলবে বিচার বিশ্লেষণ। বিভিন্ন মাধ্যম জরিপ করবে। ফলাফল নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণ হবে। গভীর রাত পর্যন্ত চায়ের দোকানে ভোটাররা জমিয়ে আড্ডা দেবে। টানটান উত্তেজনা, চরম প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও পরিবেশ থাকবে শান্তিপূর্ণ, কিন্তু উৎসবমুখর। আমাদের দেশে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সৌভাগ্যক্রমে যে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে উপরে বর্ণিত চরিত্র ধারণ করেই হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের চিরাচরিত সেই ধারা বা চরিত্র হারিয়ে যায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকে বর্তমানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে। বর্তমান নির্বাচনটি আগের নির্বাচন থেকে ভিন্ন চরিত্র ধারণ করেছে। প্রার্থীর ছড়াছড়ি কিন্তু প্রতিযোগিতা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নেই। ফলাফল নির্ধারিত। তাই প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই। নির্বাচনের কলকব্জা (Mechanism) একটি দলের হাতে বন্দী। মিষ্টির উপর ভোঁ ভোঁ করে উড়া মাছির মতো সেই দলের অনুকম্পা ভিক্ষা করছে সব প্রার্থী মরিয়া হয়ে। প্রধান প্রধান দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা ফলাফল আঁচ করতে পেরে। কারণ বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর পরিবেশে টানটান উত্তেজনার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন এদেশের মানুষের কপালে জোটেনি। সেজন্যই বলেছিলাম সৌভাগ্যক্রমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সকল দলের অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর পরিবেশে। ভোটাররা স্বাধীনভাবে এবং নির্ভয়ে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে গেছে। এবারের নির্বাচনের ফলাফল যেহেতু পূর্বনির্ধারিত তাই বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে। যে দলের মর্জির উপর নির্বাচনের ফলাফল নির্ভরশীল সেই দলের অনুকম্পা পাওয়া নির্ধারিত প্রার্থীদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হবে। তাই এটাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায় না। বলা যেতে পারে পছন্দ করে নির্বাচন করা (to choose by choice) প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার আয়োজন মাত্র’।

সম্মানিত ও সচেতন পাঠক আবুল কাশেমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রের বাস্তবতা হাজির হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলনরত বিরোধী দল বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নাশকতাকারী এবং সন্ত্রাসী চিহ্নিত করে নির্বাচনের বাইরে রাখার কৌশলে সরকার শতভাগ সফল।

৭ জানুয়ারি নির্বাচন, ৯ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ, ১০ জানুয়ারি সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। যদিও ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত একাদশ সংসদের মেয়াদ কিন্তু একাদশ সংসদের মেয়াদ থাকতেই দ্বাদশ সংসদের শপথ এবং সরকার গঠন হয়ে যাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেই। এক সংসদের মেয়াদ থাকতেই আরেক সংসদ শপথ নিয়ে নিবে এবং সরকার গঠন হয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন সরকার অতীতেও তাই করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। ধারাবাহিক সংবিধান লঙ্ঘন প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছে। সংবিধান যেনো সরকারের জন্য কোনো বাধা নয়; বরং সংবিধান সরকারের ইচ্ছাধীন। সংবিধান লঙ্ঘন বা স্থগিত, অসাংবিধানিক নির্বাচনের বৈধতা, জাতীয় নিরাপত্তা, ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সবকিছুকেই সরকার ক্ষমতার খেলনা করে ফেলেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যারা প্রজাতন্ত্রকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে একদিন তাদেরকেই এই দায় বহন করতে হবে।

লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মানব জমিন