today-is-a-good-day

ফরহাদ মজহার – তরুণরা ‘জান ও জবান’-এর স্বাধীনতা চায়। ভাল।  

তরুণরা ‘জান ও জবান’-এর স্বাধীনতা চায়। ভাল।

কিন্তু ‘জান’-এর স্বাধীনতার কথা বলতে তারা কী বোঝাচ্ছে বোঝা গেল না। অর্থাৎ জান বা জীবনের স্বাধীনতা কথাটা অস্পষ্ট। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা দেওয়াই আছে: “আইনানুযায়ী ব্যাতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না”। কিন্তু ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা নাগরিকদের এই সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে নিয়মিতই। মুশতাক আহমেদ ও কিশোর যেমন। কিন্তু রাষ্ট্র যাদের এই সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের সবার জন্য আমরা আন্দোলন করি না। এই মুশকিল গভীর ভাবেই আমদের চেতনায় আছে। বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটা বড় ধরণের বাধা।

রাষ্ট্রের সংবিধান বিরোধী অপরাধ জনগণকে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। সেই দিক থেকে জানের স্বাধীনতা চাই শ্লোগান থেকে কিছুই বোঝা যায় না। এই রণধ্বণি বিদ্যমান রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে সজ্ঞান ও শিক্ষিত করে না। তাহলে তরুণরা — বিশেষত যারা পরিচিত বাম দলে সক্রিয় — তারা ঠিক কী চাইছে সেটা তারা সাধারণ মানুষের কাছে মোটেও পরিষ্কার করতে পারছে না। আন্দোলনকারীদের হোম ওয়ার্ক দুর্বল।

মুশতাক ও কিশোরের মূল ইস্যু হচ্ছে নির্যাতন এবং পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। শুধু তারা নয়, এর আগে আরও অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা ও আইন অনুযায়ী এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এটা বুঝতে হলে জাতিসংঘের Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment-এর মর্ম বুঝতে হবে। অর্থাৎ সংবিধানে জানের স্বাধীনতা দেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ মনে করে সেটা যথেষ্ট না। টর্চার এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য অমানবিক কার্যকলাপের জন্য স্বতন্ত্র মানবাধিকার আইনের দরকার আছে। টর্চার বা নির্যাতন গুরুত্বপূর্ণ আইনী ক্যাটাগরি, স্রেফ মানবিক আবেগ নয়। তাহলে জনগণকে টর্চার কনভেনশানের গুরুত্ব বোঝানো দরকার। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে আছি।

জবানের স্বাধীনতা চাওয়াও সমান অস্পষ্ট এবং এই আওয়াজের পেছনে শাহবাগী ভূত আসর করে আছে। কেন? শাহবাগিরাই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার দাবীতে লাঠি মিছিল নিয়ে কাওরান বাজারে পত্রিকাটির অফিস অভিমুখে যাত্রা করেছিল। এই শাহবাগ থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবীতে শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ আজ যারা জবানের স্বাধীনতার কথা বলছেন তাদের অনেকেই এর আগে ভিন্ন মতের জবান হরণ করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।

নিজের জবানের স্বাধীনতা চাই কিন্তু যার মতের সঙ্গে মিল নাই তার জবান হরণ করব — এটা কোন নীতি হতে পারে না। ঠিক আছে। আগে আমরা ভুল করতেই পারি। কিন্তু এখন যদি ভুল শুধরাতে চাই তাহলে আমার দেশ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, আমার দেশ পত্রিকার প্রেস খুলে দেওয়া ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট দাবিও তুলতে হবে। তাছাড়া বন্ধ করে দেয়া টেলিভিশান চ্যানেল যেমন দিগন্ত টেলিভিশনও খুলে দেয়ার দাবী করতে হবে। বিমূর্ত, আসমানি আর আবেগী দাবি তুললে জনগণ সম্পৃক্ত হবে না।

কথাগুলো বলছি জান ও জবানের স্বাধীনতার বিরোধিতার জন্য নয়। বরং যারা জাতীয় ইস্যুকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে শাহবাগে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান করার জন্য।

আশা করি অতীতের ভুল থেকে আমরা শিখব।