ফরহাদ মজহার
একটা প্রশ্ন: পুঁজির আবর্তন, বিচলনের মধ্যে সকলেই কি পুঁজির দাসত্ব মেনে চলে?
— জ্বি, চলে। চলতে বাধ্য। পুঁজি আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন কোন শক্তি বা সম্পর্ক না। পুঁজি মানুষের হুকুমের অধীন না, বরং আমরা যাকে নিজেদের হুকুম ভাবি সেটা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বহাল রাখার জন্য আমাদের দ্বারাই জারি কোঁড়া পুঁজিঢ় হুকুম, যাতে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বহাল রাখা যায় এবং পুঁজি ‘বর্তমান’ থাকতে পারে। আমরা সতত ‘পুঁজি’ নামক নৈর্ব্যক্তিক কর্তা, শক্তি ও সম্পর্কের অধীন থাকি। মার্কসের ‘পুঁজি’ গ্রন্থে মার্কস এই পুঁজিতান্ত্রিক নৈর্বক্তিক বাস্তবতাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। চিন্তা পাঠ চক্রে ‘পুঁজি’ পাঠের সময় আমরা বারবার এই দিকটার ওপর জোর দিয়েছি। বোঝাতে চেয়েছি আমরা সাধারণভাবে ‘পুঁজি’ বলতে যা বুঝি, মার্কসের ‘পুঁজি’ একদমই তা না।
আমরা পুঁজির আবর্তন, বিচলন বা সার্কিটের মধ্যেই — পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অন্দরমহলে বাস করি। আমরা যখন বেচাকেনা করি, তখন পুঁজির বিচলনকেই জীবন্ত রাখি, যখন পণ্য কিনি ও ভোগ করি পুঁজির মুনাফাই পুঁজির জন্য উসুল বা আদায় করে দেই। আমরা ভোগ করি বলেই পুঁজির মুনাফা আদায় হয়। আমরা নিজেদের পুঁজির কাছে বেচাবিক্রি করি বলেই পুঁজি আমাদের শ্রমশক্তি হিশাবে কিনে নিয়ে বাড়তি মুনাফা উৎপাদন করতে পারে।
পুঁজির বাইরে আমাদের কোন জীবন নাই, পুঁজি আমাদের যে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছে তার মধ্যে বাস করেই আমরা ধর্ম বা ধর্মচেতনার কথা বলি। আমরা দেড় হাজার বছর আগের দাস ব্যবস্থা কিম্বা দাস ব্যবস্থা প্রধান গোত্রবাদী সমাজে বাস করি না, কিম্বা যাযাবর বেদুইন সমাজে্র মধ্যেও নয়। কয়েক শতাব্দি আগের সামন্ত সমাজের অধিবাসীও আমরা নই। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে পুঁজিই আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, কামনা বাসনা নির্ধারণ করে। শুধু তাই নয় সামন্ত বা আরও নানান কিসিমের প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক পুঁজি উচ্ছেদ করেছে বলেই আমরা এখন ‘বুর্জোয়া’ বা ব্যক্তি হিশাবে নিজেদের ভাবতে পারি, ব্যক্তিচেতনা, ব্যক্তির মুক্তি ইত্যাদি নিয়ে গালগল্প করতে পারি। আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত কামনা, বাসনা, ইচ্ছা আছে এই বিশ্বাস একমাত্র পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেই বিকাশ লাভ করে।
”পুঁজি’ একটি নৈর্ব্যক্তিক শক্তি ও প্রক্রিয়া। পুঁজির কারখানায় আমাদের ধর্মচেতনা ততোটুকুই ধর্মচেতনা যে মাত্রায় আমরা ‘পুঁজি’ ও বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী। পুঁজির আবর্তনের মধ্যে থেকে ধর্ম কিভাবে সম্ভব? যেখানে প্রতি মুহূর্তে প্রতি পলে আমরা পুঁজির দাস মাত্র? সত্য জেনেও যখন আমরা সেই সত্য লুকাই ইসলামে তাকেই ‘কুফর’ বা ‘কুফরি’ বলে।
পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অধীনে থেকে আমাদের ধর্ম চেতনার চরিত্র বা রূপও পুঁজির দ্বারাই ঠিক হয়। এমনকি নিজেদের স্বাধীন সত্তা বা ‘ব্যক্তি’ হিশাবে আমরা যা অনুমান করি তা পুঁজির রঙে রঙিন। এই চরম সত্যটাই মার্কসকে পুঁজি বই লিখে বিশ্লেষণ করে দেখাতে হয়েছে। দেখাতে হয়েছে পুঁজি শুধু নৈর্ব্যক্তিক নয়, পুঁজি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’ (world-historical)। ফলে যে ইতিহাসের মধ্যে আমরা বাস করি সেটা মানুষের ইতিহাস নয়, পুঁজির ইতিহাস। এই ইতিহাসের গহ্বর থেকে বের হয়ে গিয়ে মানুষকেই তার নিজের ইতিহাস নির্মাণের শর্ত তৈরি করতে হবে। সেটা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিলোপ ছাড়া অসম্ভব।
এখন মার্কসকে আমরা না মানতে পারি, তাহলে ‘পুঁজি’ গ্রন্থের পালটা তিন খণ্ডে কিতাব লিখে প্রমাণ করতে হবে কার্ল মার্কস ভুল। কিম্বা আমাদের বাস্তবিক জীবনে প্রমাণ করে দেখাতে হবে, পুঁজির ধর্মের বাইরে আসলেই মানুষের ‘ধর্ম’ বলে আলাদা কিছু আছে। এই ক্ষেত্রে ইসলামের দাবি হচ্ছে, আছে। কারণ একমাত্র মানুষের পক্ষেই যা নাই, যা ‘গায়েব’, যা অধরা তার কাছে পরিপূর্ণ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়, অতএব অনাগত ইতিহাসের জন্য একমাত্র মানুষের পক্ষেই আল্লাহর রাহে শহিদ হওয়া সম্ভব। এই জন্যই একালে ইসলামের রাজনৈতিক-দার্শনিক বয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে চরম আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যেনতেন ভাবে ইসলামকে জঙ্গী প্রমাণ করতে ব্যস্ত। এখন বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামকে ‘জঙ্গী’ প্রমাণ করতে তারা পাগল হয়ে গিয়েছে।
পুঁজিতান্ত্রিক জীবনের মধ্যে থেকেও এই উপলব্ধি কি সঠিক যে পুঁজির ধর্ম ছাড়া মানুষের ধর্ম বলে কিছু একটা আছে, থাকতে পারে বা হতে পারে? এটা কি প্রমাণ সম্ভব পুঁজির ধর্ম পালন মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক নয়? সম্ভব কারণ মানুষ বিদ্রোহ করতে জানে। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের শৃংখলে থেকেও মানুষের ভিন্ন ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা আছে সেটা বাস্তবিক অর্থেই প্রমাণ সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। এরই নাম, বিপ্লবী রাজনীতি, পুঁজিতন্ত্রের শৃংখল থেকে নিজেকে এবং সমাজকে মুক্ত করবার এবং মুক্ত রাখবার রাজনীতি। ইসলামের ভাষায় জিহাদি রাজনীতি। যে দ্বীনি রাজনীতি ইতিহাসের পুঁজিতান্ত্রিক স্তর থেকে আমাদের ধর্ম বা দ্বীনের স্তরে উত্তরণের কাজ করে, কারন প্রতিটি জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশই আমাদের লক্ষ্য। এই সেই রাজনীতি যা পুঁজির ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মানুষের ইতিহাস আরম্ভ করার স্তরে আমাদের নিয়ে যায়। সেই স্তরে উন্নীত হতে পারলেই মানুষের ধর্ম পালনের শর্তও তৈরি হয়। কারণ মানুষের ফিতরাত বা নিজের স্বভাবগুণে তার মধ্যে গচ্ছিত রাখা রুহানি কর্তাসত্তাকে মানুষই টের পায়, সেই কর্তাকে পূর্ণ রূপে বিকাশের তাগিদও মানুষ বোধ করে। বিপ্লবী রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সেই ঐতিহাসিক জমিনটুকু বিপ্লবী অর্জন করতে চায় যাতে মানুষের আসল ইতিহাস শুরু হতে পারে।
এই রুহানি কর্তাসত্তা যখন পুঁজির বিপরীতে দাঁড়ায়, তাকে আপনি জিহাদ বলেন কি শ্রেণী সংগ্রাম বলেন তাতে বিশেষ জের জবর পার্থক্য হয় না। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উচ্ছেদের লক্ষ্যে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের জিহাদই প্রমাণ করে পুঁজি নয়, মানুষই দুনিয়ায় আল্লার নির্বাচিত খলিফা বা প্রতিনিধি। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উৎখাতের সংকল্প যাদের নাই তারা পুঁজিকেই খোদা বলে মেনে নিয়েছে। এদের কানে সীসা এবং বুকে মোহর! যারা ‘মানুষ ভজনা’র কথা বলেন, তারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই উপলব্ধি অর্জনের কথাই বলেন। তবে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে তারা ‘বর্তমান’কে পর্যালোচনা করতে না শিখলে প্রান্তিক কাল্ট বা গুহ্যচর্চায় পরিণত হওয়াই তাদের অনিবার্য পরিণতি।
আজ হেফাজতে ইসলামের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেটা জালিম রাষ্ট্রশক্তির দালালদের বিরুদ্ধে রুহানিয়াতের ক্ষমতা সম্পন্ন ধর্ম পালনকারীর লড়াই। কেউ শ্রেণী সংগ্রাম মুখে উচ্চারণ না করলে, শ্রেণী সংগ্রাম দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে যায় না।
তাই পুঁজিতন্ত্রের বর্তমান রূপ দেখে আপনি ‘তাহার চেয়ে হব আমি আরব বেদুঈন’ গান গেয়ে দাস ব্যবস্থা , যাযাবর সমাজ, সামন্ত সমাজ, কিম্বা গোলামদের রাজত্ব কায়েম করবার স্বপ্ন দেখবেন না। আপনি পুঁজির গোলাম হয়েই আছেন। বরং রাসুলে করিম মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে যেভাবে রক্তবাদ, গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, ভূখণ্ডবাদ, জাতিবাদসহ কোরেশদের আভিজাত্য চূর্ণ করে দিয়েছেন, ইসলামের নামে কোরেশ গোত্রের অহংকারী আভিজাত্য ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন, সেটা স্মরণ করুন। মানুষের মহিমা কায়েমই একালের রাজনীতি। রাজতন্ত্র বা প্রাচীন খেলাফত্ কায়েম করবার কায়েমী স্বপ্ন দেখবেন না। পুঁজির ইতিহাস দ্রুত অতিক্রম করবার জন্য কিভাবে নিজের মধ্যে মানুষের রুহানি কর্তাসত্তা আবিষ্কার করবেন ও তাকে মুক্তি দেবেন সেটা ভাবুন। কিভাবে পুঁজির ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটাবার জন্য পুঁজির ধর্ম না, মানুষের ধর্ম কায়েম করবেন সেই চিন্তাই এখন আমাদের প্রধান চিন্তা হয়ে উঠতে হবে।
কিভাবে মানুষ পুঁজির ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মানুষের ইতিহাস শুরুর ক্ষেত্র তৈরি করবে সেই চিন্তা ও রাজনীতিই মানুষকে পথ দেখাতে পারে।