রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অবশেষে জামিন মিলেছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। একাধিকবার জামিন আবেদন বাতিল হলেও উচ্চ আদালত মঙ্গলবার ৬ মাসের জামিন দিয়েছেন মির্জা ফখরুলকে। উল্লেখ্য ৮ ডিসেম্বর কোনো পরোয়ানা ছাড়াই মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের রাতের গভীরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক করে পুলিশ। পরবর্তীতে, পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
যদিও ওই মামলায় তিনি এজেহারভুক্ত আসামি ছিলেন না বলে গণমাধ্যমে জেনেছি। সরকার সম্প্রতি বিএনপিসহ বিরোধীদের নামে হাজার হাজার অজ্ঞাত উল্লেখ করে মামলা দেয়। মির্জা ফখরুলকেও কি তাহলে সেই অজ্ঞাতদের একজন হিসেবে আটক করা হয়েছিল? বিষয়টি যথেষ্ট হাস্যকর ও অনভিপ্রেত। প্রথমত, মির্জা ফখরুলের মতো একজন নম্র ও ভদ্র নেতা মারামারি ও ভাঙচুর করছেন এবং সেটাও করেছেন ছদ্মবেশ ধারণ করে বা গোপনে—গল্পের নাটক আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজন। না হলে পাঠক ও দর্শকেরা এসব নাটক দেখে মজা পান না।
মির্জা ফখরুলের আটক ও জামিনের তামাশা নিয়ে এখানে খুব বেশি এখানে বলব না। একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাই। এটা হচ্ছে মির্জা ফখরুলের জামিনের দাবিতে ডিসেম্বরের শেষ দিকে এক বিরল ও ইতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তি চেয়ে বিভিন্ন মত ও পথের ৬০ জন বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তারা বলেছেন দেশের গণতন্ত্রকে আরও বেগবান ও শক্তিশালী করার জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লড়াই করছেন। কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য বুদ্ধিজীবীদের এ ধরনের বিবৃতি আমাদের দেশে একেবারেই বিরল এক উদাহরণ। এটা শুধু বিরলই না। একদম নতুন রাজনৈতিক আচরণও বটে।
আমাদের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা হরহামেশাই জেলে যান। সব সরকারের আমলেই বিরোধীদের জেলে যেতে হয়। তাদের মুক্তির জন্যও নানাজন বিবৃতি দেন।
তবে মির্জা ফখরুলের জন্য ৬০ জনের বিবৃতিটা কিছুটা ব্যতিক্রম। সাধারণত রাজনৈতিক দল ঘেঁষা বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে থাকেন। মির্জা ফখরুলের জন্য যারা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের অনেকেই বিপরীত রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। অনেকের আবার রাজনীতির সঙ্গে একেবারেই সংযোগ নেই। এ কারণেই বিবৃতিটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া বিভিন্ন ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। আওয়ামী এই বিবৃতি ভালোভাবে নেয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে বিএনপি কূটনৈতিক ও ডান-বাম সবাইকে মাঠে নামিয়েছে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিবৃতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ এ বিবৃতি আওয়ামী লীগকে ক্রমশ একঘরে করার ইঙ্গিত দেয়।
বিবৃতিদাতারা দাবি করেছেন তারা মির্জা ফখরুলের শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু। নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে অতিক্রম করো তারা মির্জা ফখরুলের মুক্তির দাবিতে একমত হয়েছেন। এই বিবৃতিতে বিএনপিপন্থী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা যেমন আছেন তেমনি বামধারা, দলনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও স্বাক্ষর করেছেন। তাদের অনেকেই বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ বা কর্মসূচির সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু তারা মনে করেন, মির্জা ফখরুল অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়েছেন। এর প্রতিবাদেই তারা একবিন্দুতে মিলিত হয়েছিলেন। এটাই উদারপন্থী রাজনীতির সৌন্দর্য। রাজনীতিতে মতভিন্নতা থাকবেই। কিন্তু যে কোনো অন্যায়, নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক কাতারে শামিল হওয়াই গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বয়স এখন ৭৬ বছর। তিনি অসুস্থ। অনেকগুলো রোগে ভুগছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে একাই বিএনপিকে তিনি গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে অনেকটা পথ টেনে এনেছেন। আজকে ঢাকা, কালকে চট্টগ্রাম, এরপর রাজশাহী দৌড়াচ্ছেন তিনি বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে দলকে চাঙা রাখতে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে। এই অবস্থায় তিনিই কার্যত দলটির ডি ফ্যাক্টো নেতা ও মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে অগণিত মানুষ অপেক্ষা করেছেন। আওয়ামী লীগের পেটোয়া কর্মীবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে সমাবেশগুলোতে দলে দলে সাধারণ নাগরিকেরা উপস্থিত হয়েছেন।
প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে মির্জা ফখরুলের অবস্থান। তিনি অসহনশীল কথার রাজনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন জাতীয় পর্যায়ে সুস্থ ধারার রাজনীতি করেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পর তিনিই বর্তমানে একমাত্র নেতা যার কথা শোনার জন্য লাখো মানুষ সমবেত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতির তাৎপর্যময় দিক হচ্ছে মির্জা ফখরুলের নেতা হয়ে উঠা। তিনি মোটামুটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে রাজনীতিকে একটা সহনীয় পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এই সময়ে মির্জা ফখরুল দেশি ও বিদেশি চাপকে শক্তভাবে মোকাবিলা করেছেন। শোনা যায় বিএনপি ভেঙে নতুন বিএনপি বা রাজনৈতিক দল করার জন্য তার উপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। সঙ্গে প্রলোভনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজপথকেই যাবতীয় চাপ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও নেতাকর্মীরা তার উপর আস্থা রেখেছিলেন। তিনি সবাইকে খুশি বা তৃপ্ত করতে না পারলেও আস্থার প্রতিদান দিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বলেই মনে হয়েছে। মির্জা ফখরুলের রাজনীতির বয়স স্বাধীন বাংলাদেশের সমানই। তিনি অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে তিনি রাজনীতি ময়দানে নেমেছিলেন। মাঝে শিক্ষকতা ও সরকারি চাকরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পরে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন।
রাজনীতির এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বরাবরই তিনি ছিলেন নম্র ও মিষ্টভাষী। পরিশীলিত, মার্জিত ও পরিমিতিবোধ দিয়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিরোধী মতের প্রতি তিনি কখনো হুমকিমূলক বা অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিয়েছেন বলে শুনিনি। এ হিসেবে সমসাময়িক প্রচলিত রাজনীতির মাঠে তিনি অনেকটাই বেমানান। যেখানে মিথ্যাচার, কুরুচিপূর্ণ অশ্রাব্য কথাবার্তা, কুৎসিত মন্তব্য নিত্য চর্চা করা হয় সেখানে মির্জা ফখরুলের মতো রুচিশীল রাজনীতিবিদ এক বিরল চরিত্র। এসব কারণে দলের ভেতরেই তিনি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন। কারণ আমাদের সমাজে স্রোতে গা ভাসানো মানুষের সংখ্যাই বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আলগা কথায় মুখর রাজনীতিবিদদেরই আমাদের সমাজ ঝানু রাজনীতি বলে বিবেচনা করেন।
এই প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে মির্জা ফখরুলের অবস্থান। তিনি অসহনশীল কথার রাজনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন জাতীয় পর্যায়ে সুস্থ ধারার রাজনীতি করেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পর তিনিই বর্তমানে একমাত্র নেতা যার কথা শোনার জন্য লাখো মানুষ সমবেত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতির তাৎপর্যময় দিক হচ্ছে মির্জা ফখরুলের নেতা হয়ে উঠা। তিনি মোটামুটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে রাজনীতিকে একটা সহনীয় পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সম্ভবত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে কারাগারের আটকে রাখা হয়েছিল। এমনকি প্রথমদিকে তার পরিবার ও পরিজনকে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। রাজনীতির এতটা পথ মোটামুটি স্বচ্ছভাবেই পাড়ি দেওয়ার পর এই ধরনের নির্মমতা মির্জা ফখরুল প্রত্যাশা করেন না। উদারতান্ত্রিক রাজনীতি দিয়ে মির্জা ফখরুল প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিপক্ষের নির্মমতার শিকার হচ্ছেন।
তবে আশার কথা হচ্ছে এ ধরনের রাজনীতিবিদেরাই শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ায়। অনেকেই হয়তো বলবেন, এত নীতি নৈতিকতার উপর ভর করে মির্জা ফখরুল রাজনীতি থেকে কী অর্জন করলেন। গুম, খুন, হামলা, মামলাসহ চরম নির্যাতনের পরও এখনো যে বিএনপি দল হিসেবে শক্ত ভিত্তির ওপর টিকে আছে তার অন্যতম কারণ মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলের ভাবমূর্তি। যদি ঠিক এই মুহূর্তে জনসাধারণকে প্রশ্ন করা হয় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা হিসেবে কাকে বেছে নেবেন? সম্ভবত মির্জা ফখরুল নামটিই সবার ওপরেই থাকবে। আর জনপ্রিয়তার দিক থেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরেই অবস্থান করবেন বলে মনে হয়।
খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ার পর নিজেকে হারিয়ে খোঁজা বিএনপিকে মির্জা ফখরুল মহাসচিব হিসেবে একটি উদারপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক আদর্শে গড়ে ওঠা বিএনপির একটি উদারপন্থী দলই হওয়ার কথা। আর এ কারণেই হয়তো প্রথমবারের মতো বহুদলীয় একটি বিবৃতি আমরা লক্ষ্য করলাম বিএনপির মহাসচিবের জন্য। আওয়ামী লীগ যাকে বলছে ডান ও বামের সম্মিলন।
আওয়ামী লীগের ভাষায় রাজনীতিতে এই ডান ও বামের সম্মিলন নতুন দিনের ইঙ্গিত দেয়। দলীয় রাজনীতির পরিচয় ছাপিয়ে মির্জা ফখরুল নিজেকে সর্বজনীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। রাজনীতি নিয়মিত অনুসরণ করেন এমন কয়েকজনকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম অতীতে এই ধরনের বিবৃতি এসেছে কিনা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। অনেকেই জানিয়েছেন, এর আগে সমমনা দল নিয়ে গঠিত জোটের পক্ষে বিবৃতি এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে দূরবর্তী অক্ষে অবস্থান করা বুদ্ধিজীবীদের এ ধরনের বহুপক্ষীয় বিবৃতি কখনো আসেনি আগে।
- ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক