গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দলটির একজন সমর্থক নিহত, বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী এবং পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বেশ কয়েকজনকে আটক করে। এরপর ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত তিনটায় পুলিশ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। পরের দিন বিকেলে তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ডিবি পুলিশ। আদালতে হাজির করলে তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ফখরুল কারাগারে আটক আছেন। এর মধ্যে একাধিকবার তাঁর জামিনের আবেদন করা হলেও তা নাকচ করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হলো, মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো এবং বারবার তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করা হচ্ছে, সেটা কি আইনানুগ হচ্ছে? নাকি রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্যই তাঁকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে!
৭ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের ঘটনায় মোট পাঁচটি মামলা হয়। পল্টন, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানায় একটি করে মামলা হয়েছে। আর রমনা থানায় হয়েছে দুটি মামলা। এসব মামলার এজাহারে ফখরুলের নাম ছিল না। এমনকি ৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে যখন তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা বা তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, পুলিশ তা জানায়নি। প্রায় সারা দিন ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করে বিকেলে তাঁকে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ফখরুলের রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন না করেও এটি স্বীকার করা যায় যে, তিনি তাঁর দলের অনেক শীর্ষ নেতাদের থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম। একজন প্রৌঢ় রাজনীতিক এবং সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই তিনি পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি বা ওই ধরনের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তিনি কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, এ রকম কিছুর প্রমাণও মেলেনি। এরপরও ফখরুলের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে একের পর এক মামলা হয়েছে। গত ১০ বছরে তাঁর বিরুদ্ধে ৯২টি মামলা হয়েছে এবং ৩৫০ দিনের মতো জেল খেটেছেন তিনি। এর মধ্যে ‘গায়েবি’ মামলা অর্থাৎ অস্তিত্বহীন ঘটনাতেও মামলা হয়েছে। তাই ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা, তাঁকে গ্রেপ্তার এবং বারবার জামিন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টিকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। যেকোনো অজুহাত বা সুযোগে সরকার যে তাঁকে কারাগারে আটকে রাখতে চায়, এটা স্পষ্ট। কিন্তু এর কারণ কী?
বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়রাপারসন তারেক রহমান রাজনীতিতে পুরোপুরি ‘সক্রিয়’ নন। তাঁদের মধ্যে একজন অসুস্থ এবং অন্যজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এ রকম অবস্থায় মহাসচিব ফখরুলই মাঠের রাজনীতিতে কার্যকরভাবে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো মনে করছেন, ফখরুলকে কারাগারে আটকে রাখতে পারলে বিএনপি নেতৃত্বশূন্যতায় পড়বে, একইভাবে সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনও গতি হারাবে। সরকারের এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পর মহাসচিবও যদি ‘অনুপস্থিত’ থাকেন, সেটা বিএনপি কেন, অন্য যেকোনো দলের জন্যই চ্যালেঞ্জের বিষয় হওয়ার কথা।
পল্টন থানার যে মামলায় ফখরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আমানউল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন জামিন পেয়েছেন। কিন্তু ফখরুলের জামিনের আবেদন তিনবার নাকচ হয়ে গেছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিকে জামিন দেওয়া আর এজাহারে নাম না থাকা ব্যক্তির জামিনের আবেদন নাকচ করে দেওয়া কোনো ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা না। কিন্তু আদালতে এমন ঘটনাই ঘটছে।
ফখরুলের জামিন নামঞ্জুর হওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন
পল্টন থানার যে মামলায় ফখরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আমানউল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন জামিন পেয়েছেন। কিন্তু ফখরুলের জামিনের আবেদন তিনবার নাকচ হয়ে গেছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিকে জামিন দেওয়া আর এজাহারে নাম না থাকা ব্যক্তির জামিনের আবেদন নাকচ করে দেওয়া কোনো ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা না। কিন্তু আদালতে এমন ঘটনাই ঘটছে।
জামিনের আবেদনের সময় ফখরুলের আইনজীবীরা আদালতে বারবার বলেছেন, তিনি অসুস্থ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী, জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও ১৬ বছরের কম বয়সী, নারী এবং অসুস্থ ব্যক্তি জামিন পেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জামিন দেওয়াটা আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আদালতের ‘বিবেচনা’ আর সরকারের ‘মনোবাসনা’–এর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফখরুলের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে।
বিরোধী দলকে মোকাবিলায় সরকারের নানা রকম পরিকল্পনা থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে তখনই, যখন পুলিশ ও আদালতের ভূমিকাকে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অংশীদার বলে প্রতীয়মান হয়। আইন-আদালতের এ রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে আরও বেশি দুর্বল করছে, ঝুঁকিতে ফেলছে। ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা, তাঁকে গ্রেপ্তার এবং বারবার তাঁর জামিন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টিকে সেই প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করতে হবে।
- মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক