প্রসিকিউশনের তথ্য : প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা

Prothom Alo

ঢাকা

গত বছরের ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়
গত বছরের ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়ফাইল ছবি

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র–জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সেই নির্দেশের দালিলিক প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।

এই দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে চায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর (শেখ হাসিনা) সরাসরি সম্পৃক্ততা পেয়েছি। তাঁর আদেশ-নির্দেশের সরাসরি ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (দালিলিক প্রমাণ) পেয়েছি। মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশের ডকুমেন্টারি এভিডেন্স পেয়েছি।’

এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা (মিস কেস) হয়েছে ২৩টি। এর মধ্যে তিনটিতে শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে।

আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে অন্তত চারটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার। তিনি বলেন, চারটি মামলার মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া মামলাটিও রয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা (মিস কেস) হয়েছে ২৩টি। এর মধ্যে তিনটিতে শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। এই তিন মামলার মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। আরেকটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। আর তৃতীয় মামলায় ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা–নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা তিনটি মামলাতেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তাঁকে দেশে ফেরাতে ভারতের কাছে ইতিমধ্যে আবেদন করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছেও আবেদন করেছে সরকার।

‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’

গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, বিগত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম–খুন এবং ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এখন গুরুত্ব পাচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। এই তিন ধরনের অপরাধেই শেখ হাসিনা অভিযুক্ত।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, কোনো একটি অপরাধ তদন্ত করার সময় তাঁরা দেখছেন সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধ কি না। মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে হলে তা ব্যাপক পরিসরে ও পদ্ধতিগতভাবে সংঘটিত হতে হয়। সেখানে একজন ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ থাকে, যার সরাসরি নির্দেশে ব্যাপক পরিসরে ও পদ্ধতিগতভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়। অথবা কেউ ব্যাপক পরিসরে ও পদ্ধতিগত অপরাধ হতে দিয়েছেন বা থামানোর চেষ্টা করেননি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’র দায়ে অভিযুক্ত।

তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আক্রমণের মধ্য দিয়ে অপরাধ শুরু হয়। এরপর গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রামে আরও একজনকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশব্যাপী অপরাধ সংঘটিত হয়। একপর্যায়ে তা মানবতাবিরোধী অপরাধে রূপ নেয়। যেসব ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হচ্ছে, সব কটিতেই ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ না থাকলে সাধারণত মানবতাবিরোধী অপরাধ হয় না।

মামলার অগ্রগতি কত দূর

গণ–অভ্যুত্থানের সাত মাস পর ট্রাইব্যুনালে এখনো কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দায়িত্ব ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার। তদন্ত সংস্থা প্রথমে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে। এরপর যাচাই–বাছাই করে তা ট্রাইব্যুনালে জমা দেবে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরই মূলত আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়।

প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, আগামী এপ্রিলের মধ্যে যে চারটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে চায় তারা, এর একটি হলো গণ–অভ্যুত্থানের সময় হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই মামলায় ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। গত অক্টোবরে এ মামলা করার সময় শুধু শেখ হাসিনাই আসামি ছিলেন।

প্রসিকিউশন সূত্র বলছে, আগামী এপ্রিলের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা ওই মামলার পাশাপাশি আরও তিনটি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজ চলছে। এই তিন মামলা হলো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে সাতজনকে হত্যা এবং সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মামলা।

প্রসিকিউশন সূত্র বলছে, ট্রাইব্যুনালের ২৩টি মামলায় এখন পর্যন্ত ১৪২ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনের মতো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ফারুক খান, শাজাহান খান, আব্দুর রাজ্জাক, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামরুল ইসলাম, জুনাইদ আহ্‌মেদ, কামাল আহমেদ মজুমদারের মতো সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা রয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের মামলায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন ও মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। এ ছাড়া পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মহিউদ্দিন ফারুকী, জসিম উদ্দিন মোল্লা, আবদুল্লাহিল কাফী, মইনুল ইসলাম, আলেপ উদ্দিন।

ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান খান ও মোহাম্মদ এ আরাফাতের মতো বিগত সরকারের প্রভাবশালী অনেক মন্ত্রী ট্রাইব্যুনালে হওয়া বিভিন্ন মামলার আসামি। এই আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া হওয়ায় এবং অনেকে দেশ ছেড় পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’-এর সাধারণ সম্পাদক ও শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, বিচার দৃশ্যমান করতে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। একটি হত্যাকাণ্ডে একজন লোক জড়িত থাকলে দুই হাজার হত্যাকাণ্ডের জন্য দুই হাজার গ্রেপ্তার করার কথা। এ পর্যন্ত কয়জন লোক গ্রেপ্তার হয়েছে? আসামি না ধরলে বিচার করবে কার?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here