প্রবাসীদের অবদান : পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা

  • ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  •  ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৫৩

জীবনমান উন্নয়নের জন্য এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করে বৈদেশিক রিজার্ভ সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। এসব বিদেশগামী শ্রমিককে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো হলে তারা আরো ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পাবেন। দেশও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে। প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের প্রধান রেমিট্যান্স আয়কারী দেশ। এর পরই রয়েছে চীন। এসব দেশ থেকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ লোকজনকে বিদেশে পাঠানো হয়।

বিদেশগামীদের বেশির ভাগই অদক্ষ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা হাড়ভাঙা খাটনি করেও ন্যায্য বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির কর্মকাণ্ডকে গতিশীলতার সাথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এতে করে কর্মসংস্থান তৈরি হবে প্রবাসীরাও তাদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে বেশি লাভবান হতে পারবে। অথচ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে চাইছে, তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রবাসীদের জন্য যত বেশি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে তত বেশি রেমিট্যান্স আসবে দেশে।

বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলো দারিদ্র্য দূর করতে পারে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পর একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ে। প্রবাসীদের পরিবার পরিজন অধিকাংশ গ্রামে বসবাস করেন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বাড়ছে। তবে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে।

বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের বিশাল অংশের গন্তব্য মূলত সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইরাক, লিবিয়া, বাহরাইন, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ব্রুনাই, মরিশাস, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রবাসীরা নানাভাবে বঞ্চনা, শোষণ, অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো নির্যাতিত হচ্ছে, আবার অনেকেই ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। কোনো কোনো দেশের কারাগারে বাংলাদেশীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হয় সেজন্য সরকারের দেশে-বিদেশে তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা আবশ্যক। অনেক সময় অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যেতে নৌকাডুবির ঘটনায় অনেক বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। টেকসই উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য কমাতে হলে বৈশ্বিক অভিবাসন বাজারে অব্যাহতভাবে লোক পাঠানো এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে দেশে বিদেশে সরকারি মনিটরিং প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পণ্য রফতানি খাত সবার শীর্ষে থাকলেও সার্বিক বিচারে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান তথা মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ পণ্য রফতানি বাবদ যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রফতানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। একই সাথে জনশক্তি রফতানি খাত দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। এরা যদি বিদেশে কর্মসংস্থানে যেতে না পারত তাহলে দেশের বেকার সমস্যা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করত। বিশ্ব শ্রমবাজারে আজ আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কা। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের দেশের তুলনায় বেশি দক্ষ। বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে এগুতে হবে। যার মাধ্যমে আরো অধিক সংখ্যায় শ্রমিক কেবল মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজারে প্রবেশের চেষ্টা করলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের জনশক্তি রফতানি বাজার মসৃণ করতে পারে। করোনাকালে বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতিতে প্রতিদিন প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা দেশে ফেরত এসেছে। এসব বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকাংশ দেশে আটকে থাকার কারণে তাদের সঞ্চিত অর্থ খরচ হয়ে যায় এবং অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আর বিদেশে ফেরত যেতে পারেনি।

প্রবাস জীবনের নানা যন্ত্রণা-কষ্ট, পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনা নিয়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসাকে তারা ত্যাগ করে হাজার মাইল দূরে থেকে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রেখেছেন আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। তারা সব সময় নিজেদের স্বাদ-আহ্লাদ সবকিছু বিসর্জন দেন শুধু পরিবারের কথা চিন্তা করে। অনেক ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে জমানো অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে জীবন কিংবা ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে চলেন কেবলই একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায়। এদিকে মাস শেষ না হতেই পরিবারের সদস্যরা নানা বায়না নিয়ে অপেক্ষায় থাকে প্রবাসে থাকা মানুষটি টাকা পাঠাবে। সবার চাহিদা মেটাবে। বিদেশে যাওয়ার সময় ধারদেনা করে পাড়ি জমাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলো। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে পরিবারের খরচ পাঠানোর পরে নিয়মিত ভিসা পাসপোর্ট নবায়ন করাতে তারা হিমশিম খেয়ে যান। দালালের খপ্পরে পড়ে এক সময় ভিসা পাসপোর্ট সবই হারাতে হয়। আবার আমাদের দূতাবাসের পক্ষ থেকেও ঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ায় ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে প্রবাসীদের। অনেক সময় দূতাবাসের অসহযোগিতার কারণে কাঙ্খিত সুযোগ-সুবিধা ও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের আমলে প্রবাসীদের কল্যাণে ও তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবাসী কল্যাণ শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রবাসীরা হয়রানির শিকার হলে এই শাখার মাধ্যমে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেসব প্রবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করে তাদের উত্তরাধিকারীরা যাতে সহজে আর্থিক সুবিধা পেতে পারে সে বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ শাখা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। এ ছাড়াও প্রবাসীদের কল্যাণে প্রবাসী কল্যাণ শাখা নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই শাখার কার্যক্রম আরো গতিশীল করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রবাসীদের সচেতন করাও অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন খাতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর অভিঘাতে টালমাটাল অবস্থায় দেশে-বিদেশে শিল্প কারখানা, অফিস আদালত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলেও একমাত্র প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স প্রবাহে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্ব মন্দার প্রভাব তেমনভাবে পড়েনি।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা মোট ১৭৩ কোটি ডলার অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। কিন্তু আগের অর্থবছরে একই মাসে এসেছিল ২১৫ কোটি ডলার। তুলনামূলক রেমিট্যান্স কমেছে ৪২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার বা ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স বিগত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে অবস্থায় রয়েছে। রেমিট্যান্স কমার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কমে আসায় বর্তমানে সারা বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে পূর্বে করোনাকালে যারা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠিয়েছে তাদের অনেকেই হুন্ডি কারবারিদের মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে যে হারে প্রবাসীরা দেশে এসেছেন, সে তুলনায় কম সংখ্যক লোক বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

জনশক্তি রফতানি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারিভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসংখ্যার সমস্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে দেশের বেকার সমস্যার নিরসনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বিকাশের বিশাল সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশ গমনেচ্ছুদের জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে বিশেষায়িত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার জন্য সহজ শর্তে সরকারিভাবে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দেয়া যায়। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো, যারা বিদেশে যেতে চায় তাদের টাকার অভাব। এ সমস্যা দূরীকরণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়নও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রচুর দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। যে নীতিমালায় প্রবাসীদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী হবে বলে অভিমত অনেক বিশেষজ্ঞদের।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক