প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর, তিস্তা নিয়ে টু-শব্দও করেনি বেইজিং

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর, তিস্তা নিয়ে টু-শব্দও করেনি বেইজিং

নির্ধারিত সময়ের একদিন আগে চীন সফর শেষ করে বুধবার (১০ জুলাই) রাতে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সফরকে ঘিরে ইতোমধ্যে রাজনীতিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। তিস্তাসহ বেশকিছু বিষয়ে পূর্বেই ভারতের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ায় চীন বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহ হারিয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র। এ কারণে প্রতিশ্রুতি থাকলেও চীন বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়নি মনে করছেন কেউ কেউ।

জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগদানের পর জুনের ২১ তারিখ ফের নয়াদিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় দেশটির সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে কথা হয়। পরে ঢাকায় ফিরে তিস্তায় ভারতীয় বিনিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই মূলত বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে পড়ে ঢাকা। তারপরও দেশের রিজার্ভ বাড়াতে চীনের ৫ বিলিয়ন অর্থ সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিতই ধরে নিয়েছিলো সরকার। তবে বুধবার দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সেটি হয়নি। তারা বাংলাদেশকে মাত্র ১ বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রত্যাশা ছিলো-এমন মন্তব্য করে সফরের একটি সূত্র বলছে, সফরের পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মূলত ভারতের সঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের সম্পর্ক বিবেচনায় চীনের এমন বিরূপ মনোভাব হতে পারে বলে ওই সূত্রটির ভাষ্য।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশী ফয়েজ আহমেদ বাংলা আউটলুককে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে নিয়ে আগে থেকেই নানা মহলে আলোচনা ছিলো। বাংলাদেশ তার রিজার্ভের সক্ষমতা বাড়াতে দেশটির কাছে যে পরিমাণ ঋণ চেয়েছিলো তার পুরোটা পাওয়া যায়নি। তবে যেটি পাওয়া গেছে সেটিও এই মুহূর্তে কাজে দেবে।

তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। চীন এই ঘাটতি দূর করতে প্রুতিশ্রুতি দিয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতে দেশীয় মুদ্রা বিনিময়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এসেছে। তারপরও বাংলাদেশ যে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পেয়েছে সেটি বলছি না। তবে সামনের দিনগুলোতে ঘাটতি দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সফরে ঢাকা-বেইজিং ২১টি সমঝোতা স্বাক্ষর ও সাতটি ঘোষণার মধ্যে রয়েছে- ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার, চায়না ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএফআরএ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকিং এবং বিমা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশ থেকে চীনে তাজা আম রপ্তানিতে প্রটোকল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি সহায়তা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহায়তা, বাংলাদেশে প্রকল্পে চায়না-এইড ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ বিষয়ে আলোচনার একটি সাইনিং অব মিনিটস (কার্যবিবরণী) সই, চীনের সহায়তায় ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু সংস্কার প্রকল্পের চিঠি বিনিময়, নাটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পার্ক প্রকল্পে চায়না-এইড কনস্ট্রাকশনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বিষয়ে চিঠি বিনিময়, চীনের সহায়তায় নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্প বিষয়ে চিঠি বিনিময়, মেডিকেল সেবা এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা শক্তিশালী করতে সমঝোতা স্মারক, অবকাঠামোগত সহযোগিতা জোরদারে সমঝোতা স্মারক, গ্রিন অ্যান্ড লো-কার্বন উন্নয়ন বিষয়ে সহযোগিতায় সমঝোতা,  বন্যার মৌসুমে ইয়ালুজাংবু (ব্রহ্মপুত্র) নদীর হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য বাংলাদেশ দেওয়ার বিধি বিষয়ক সমঝোতা, চীনের জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন প্রশাসন এবং বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বিটিভির মধ্যে সমঝোতা সই, সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি ও বিটিভির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই, চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া এবং বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা বাসসের মধ্যেও একটি স্মারক সই, সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে চুক্তি সই, চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমঝোতা নবায়ন, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক।

এছাড়া সাতটি ঘোষণাপত্রে রয়েছে- চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্তি, চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি ত্বরান্বিতকরণ নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা।ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণের সমাপ্তি, ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্পের সঙ্গে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং এর ট্রায়াল রান সমাপ্তি ঘোষণা, রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু, শানদং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরের মধ্যে সমঝোতা ও বাংলাদেশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণের ঘোষণা।

সফরে চীনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া না পাওয়ার বিষয়ে কূটনীতিকরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা ছিলো চীনের সঙ্গে অন্যতম বার্গেনিং ইস্যু। সেটি আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে সেটেল করায় চীন পুরো সফরে কোনো অংশেই এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই তুলেনি। এছাড়া বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়েও দেশটির পূর্বেকার আগ্রহের বিষয়টিও সামনে আনেনি তারা।

এ বিষয়টি উঠে এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে আসা সফর সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের হঠাৎ ছন্দপতনের বিষটি নিয়ে আলোকপাত করা হয়। এর জন্য ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতাকে ইঙ্গিত করা হয় ওই সব প্রতিবেদনে।

এদিকে, সফর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সেখানে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় চীনের বিশেষ কোনো তদারকি চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের কড়া বেষ্টনী সব সময়ই ছিলো। তাদের দ্বারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীর কেউ কেউ হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলেও জানায় ওই সূত্রটি।

Bangla Outlook