প্রথম পাতা: নির্বাচন-অর্থনীতি কী ভাবছে মানুষ

logo

১১ অক্টোবর ২০২২, মঙ্গলবার

করোনা পরবর্তী সময়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক অস্থিরতা। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন মূল্যে নাভিশ্বাস অবস্থা। সীমিত আয় দিয়ে বেঁচে থাকার নানা কৌশল খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। তার ওপর জীবন আর চলছে না। সামনে আসছে নির্বাচন। এ নিয়ে অন্তহীন ভাবনায় মানুষ। কী হবে? কেমন হবে সেই নির্বাচন? নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বা কেমন হবে? এমন নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন সাধারণ মানুষ। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, স্থিতিশীল পরিবেশ তাদের প্রত্যাশা। চলমান পরিস্থিতি, রাজনীতি, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

তারা জানিয়েছেন, তাদের ভাবনার কথা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েছেন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার তামান্না মোমিন খান, এমএম মাসুদ, আল-আমিন, রাশিম মোল্লা, ফাহিমা আক্তার সুমি, মো. আল আমিন, নাজমুল হুদা ও নাইম হাসান। 

মুহাম্মদ সৈকত হাসান, শিক্ষার্থী: লোডশেডিংয়ে পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আগে ভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তাম এখন সেটা একদম পড়তে পারছি না। এতে পড়াশোনার ওপর একটা প্রভাব পড়ছে। একদিকে গরম অন্যদিকে অন্ধকার। তিন দিন ধরে আমার ফুফুর ডেঙ্গু জ্বর। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি সেখানেও সমস্যা। ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকছে না। তাকে অক্সিজেন দেয়ার যখন প্রয়োজন ছিল তখন কিন্তু দিতে পারছি না। দেশে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে সেটিতে নিজের নিরাপত্তা কোথায়? রাস্তা দিয়ে যে নিরাপদে বাসায় ফিরবো সেটিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে খুবই খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। আগে ১০ কেজি চাল কিনলে এখন ৫ কেজি কিনতে হচ্ছে। ঠিকমতো কোনোকিছু খেতে পারছি না। সকালে একটা রুটি খেলে আমাকে চিন্তা করতে হয় বিকালে কী খাবো। আমি একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও এখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে হচ্ছে। বাজারে গেলে চিন্তা করতে হয় আমাদের সামনে আরও কতো ভয়াবহ দিন আসবে।

সাজেদুল ইসলাম সাজু, বেসরকারি চাকরিজীবী: মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক চাপটা সবার ওপরে পড়ছে। আমার যে হারে ব্যয় বাড়ছে সেই হারে বেতন বাড়ছে না। এতে নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আগে কিছু টাকা জমা করে রাখা যেত এখন মাস শেষ হওয়ার আগে টাকা শেষ হয়ে যায়। পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে যেকোনো জিনিস স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারতাম এখন সবকিছুতে যে দাম তাতে অনেক সময় বাজারে গিয়ে ফিরে আসতে হয়। অর্থনৈতিক যে সংকট এটি দুর্নীতি কমিয়ে আনলে সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বাংলাদেশে দুইটা বড় দল আছে। বাকিগুলো তারা ওই রকমভাবে তাদের এক্টিভিটিজ দেখায় না। তারা যেদিকে যায় সেই দলটিই একটু শক্তিশালীর দিকে যায়।

মোহাম্মদ মাইদুল ইসলাম, আইনজীবী: ইউক্রেন-রাশিয়ায় যুদ্ধের কারণে বা দেশে বৈশ্বিক একটা অস্থিরতা কাজ করছে। লোডশেডিংটা হয়তো সাময়িক সমস্যা। এটির হয়তো দ্রুত একটা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অবশ্যই প্রয়োজন সেটি সবসময় জনগণ চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর যদি কোনো চাহিদা থাকে তাহলে তাকে সংসদে এসে বসতে হবে, কথা বলতে হবে। রাজপথে আন্দোলন করে সমাধান আসে না। এই সরকারের কিছু ভুল আছে কিন্তু ভালো যে কিছু করছে না সেটি কিন্তু নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটা ঠিক। সবাই কমবেশি কষ্টে দিনযাপন করছে। এটা বাজারে গেলে বোঝা যায়। আগে ৮ হাজার টাকায় বাজার করতাম এখন সাড়ে ১০ হাজার টাকা লাগে। সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে এটা ঠিক। সমস্যা সাময়িক, ধৈর্য ধরতে হবে, সরকারের হস্তক্ষেপে দুর্নীতি কমাতে হবে।

রোজী আক্তার, গৃহিণী: লোডশেডিংয়ে অবস্থা খারাপ। এদিকে দুই মাস ধরে গ্যাস থাকে না ঠিকমতো। এসব কী শুরু হলো দেশে। আমরা এই গরমে মধ্যবিত্তরা কীভাবে বাঁচি। অসুস্থ হয়ে যেতে হচ্ছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেশি। আমরা কী না খেয়ে মারা যাবো। রাতে ঠিকমতো ঘুমও হচ্ছে না। কোন মানবতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। না বাঁচতে, না পারি মরতে। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সবকিছুতে আমাদের কষ্ট। দিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হচ্ছে। এদিকে মশার ভয়ে বাইরেও থাকতে পারি না। সরকার আমাদের ভালোবাসলে এসবের দিকে খেয়াল করতো। সে তো দুই বেলা না খেয়ে থাকতে পারে। সরকারের উচিত সন্তানের মতো করে জনগণের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সুখ-দুঃখগুলো বোঝা।

একটা ডিম ১৩ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সাধারণ জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হবে। আমরা যদি আমাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু না পাই তাহলে আমরা কীভাবে ভোট দিবো। নির্বাচন আসার আগেই এত এত সমস্যা জেনেশুনে লোকজন কীভাবে ভোট দিবে।
সৈয়দ আমানত আলী, গণমাধ্যমকর্মী: নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দেশের তো সবকিছু উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। তেল, খাদ্যশস্য, গম, চাল এগুলো আমাদেরকে আমদানি করতে হয়। এই যুদ্ধের কারণে ডলারের মূল্যে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো সমন্বয় না করতে পারলে দ্রব্যমূল্যে নিম্নমুখী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল এগুলো আমদানি করে কিন্তু সরকারের পলিসিটা সে কীভাবে করছে সেটি আসলে বোঝা কষ্টকর। কেন হঠাৎ করে এভাবে লোডশেডিং শুরু হলো। মানুষ বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। বিভিন্ন কলকারখানা সময় মতো রান করতে পারছে না। তাদের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এদিকে বাসাবাড়িতে সমস্যার শেষ নেই। ছোট বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। এগুলো কোনো সমাধান না। সরকারের উচিত বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করে সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো।

বেলাল হাসান, রিকশাচালক: ঢাকায় টিকে থাকা খুবই কষ্ট। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে বাসায় বিদ্যুৎ থাকে না। ডাল-ভাতের পয়সাও ঠিকমতো আয় করতে পারি না। যে টাকা আয় করি তাতে বাজারে গেলে ভয়ে থাকতে হয়। জিনিসপত্রের দাম কমলে সুন্দর করে জীবনযাপন করা যেতো। এখন যে পরিস্থিতি তাতে টিকে থাকা যাচ্ছে না। গত ১০ বছর ধরে ভোট দিতে পারি না। এদিকে ভোটকেন্দ্রে গেলে বলে আপনার ভোট হয়ে গেছে। দুইবার ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে এসেছি। এখন তো রাস্তায় বেরোনো যায় না। রাস্তায় বের হলে মারামারি। সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে গরিব মানুষ কী হবে আমার।

বাবলু হাসান, ব্যবসায়ী: সবকিছুর দাম তো বাড়তি। বিক্রি কমেছে অনেক। আমাদেরও বাড়তি দামে ক্রয় করতে হয়। পণ্যের দাম বাড়লে ব্যবসায়ে কিছু প্রভাব পড়ে। দেশের মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। লোডশেডিং যে পরিমাণ হচ্ছে তাতে অন্ধকারে বেচাকেনা করতে সমস্যা হচ্ছে। দিনে তিন-চার বার করে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে দেশে। সবকিছু অনেকটা মন্দা যাচ্ছে। রাজনৈতিক অরাজকতার প্রভাব আমাদের ব্যবসায় অনেক প্রভাব ফেলে। প্রতিদিন যেভাবে হামলা-সংঘর্ষ হচ্ছে তাতে করে আমরাও আতঙ্কে থাকি। দেশে অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়ে। সামনে নির্বাচন এটিকে ঘিরে যদি রাস্তাঘাটে অবরোধ ডাকে, হরতাল হয় তাহলে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাবে।

শেখ ফাহিম ফয়সাল, শিক্ষার্থী: বর্তমানে রাজনৈতিক অসহিষ্ণু মনোভাব পরিবর্তন প্রয়োজন। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ হওয়া চাই। তবে রাজনীতি, নির্বাচনের নীতি পরিবর্তন করা একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে সহজ নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে একাডেমিক উন্নয়নসহ শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না।
নুরুল হক, রিকশাচালক: আমরা ভোট সেন্টারে যাওয়ার আগেই ভোট কাউন্ট হয়ে যায়। কি কারণে হয়, আমাদের ভোট কারা দেয়? সেন্টারে গেলে বলে তোমার ভোট হয়ে গেছে। তখন কে দিলো, কীভাবে দিলো তা আমরা জানি না। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আমি চাই, আমার ভোট আমি দিতে।

মামুন ব্যাপারী, চাল ব্যবসায়ী: দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বেচা-বিক্রিও অনেক কমে গেছে। মানুষের সীমিত আয়ে যেভাবে চলার কথা তারা সেভাবে চলতে পারছে না। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মিলছে না। আমাদের কর্মীদের বেতন বাড়াতে পারছি না। কিন্তু তাদের সাংসারিক খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

মাহফুজ আমিন, বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা: নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জনগণের প্রতি সরকারের জবাবদিহিতা থাকবে। সরকার তখন জনগণের জন্য কাজ করার চেষ্টা করবে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর একত্র হয়ে কাজ করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে কখনই তা দেখা যায় না। আমাদের দেশে যে সরকার নির্বাচিত হয় শুধু তারাই সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই সরকার যেন জনগণের পক্ষ হয়ে কাজ করে। দেশে যেন ভোটের অধিকার প্রতিফলিত হয়।

মানিক মুনতাসীর, সাংবাদিক: একই সরকার যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে তখন নানা সুবিধার মধ্যেও অসুবিধা থাকে। আমাদের দেশেও তাই হচ্ছে। রাজনৈতিক সুশাসন, কমিটমেন্টের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হতে পারে এবং সঠিক অবস্থানে দাঁড়াতে পারে তাহলে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারচেয়ে বেশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে হয়েছে। জ্বালানি তেল, স্বর্ণ এসবের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুরবস্থার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। এ জন্য আমাদের ডলার খরচ অনেক বেশি হয়ে যায়। এ জন্য আমদানিতে কড়াকড়ি করলেও তা তেমন কাজে আসেনি। আমাদের এখনো ডলার ক্রাইসিস রয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারে দাম ৪-৫ টাকা বেশি। আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও ঠিক মতো কাজ করছে না। বর্তমানে বৈশ্বিক কারণে যে খাদ্য দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে তার জন্য আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণভাবে যারা খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে তারা সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা আমাদের দেশের জন্য কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কৃষককে সুবিধা দিতে হবে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনাসহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে।

শাহ আলম, সবজি ব্যবসায়ী: গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না আসলে ভোট দিতে যাবো না। গণতন্ত্রের কথা বাস্তব না হলে আমরা কারও পক্ষেই যাবো না। আমরা চাই আমার দেশ উন্নত হোক। কিন্তু এই পর্যন্ত কেউ কিছু করতে পারলো না।
মেহেদী হাসান, রাইড শেয়ারিং চালক: রাজনীতি নিয়ে আমার চিন্তা করে কী লাভ। আমরা কামাই করি আর খাই। কিন্তু এখন আমাদের জীবন অনেক কষ্টে চলছে। ভাড়া পাই না। সারাদিনে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু জিনিসপত্রের যে দাম এই আয়ে কিছুই হয় না। আমি রাজনৈতিক কিছু বুঝি না, কোনো দলেও নাই। কিন্তু আমার ভোট আছে। আগামী নির্বাচনে যাকে পছন্দ করবো তাকেই ভোট দিবো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে ভালো হয়। তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।

ফয়সাল, ওষুধ ব্যবসায়ী: দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে ওষুধ বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। মানুষ  এখন আর  ওষুধ কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এত দাম বেড়ে গেছে যে মানুষ আর আগের মতো ওষুধ কিনতে পারে না।
মাহাবুব হোসেন, চাকরিজীবী: তেলের দাম, চালের দাম, ডিমের দাম, সব কিছুই তো বাড়তি- আমাদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে টিকে থাকাই তো মুশকিল। বিদ্যুতের দাম বাড়ে কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না। দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। দেশে তো এখন আর বিরোধী দল নাই। এ কারণে সরকার যা খুশি তাই করে। কেউ প্রতিবাদও করে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে মানুষ ভোট দিবে তা না হলে আমরা ভোট দিবো না। আমি মনে করি বর্তমান সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে নির্বাচন আয়োজন না করাই ভালো।

রূপালী, নিরাপত্তাকর্মী: আগের চাইতে টাকা বেশি খরচ হচ্ছে কিন্তু জিনিস কিনতে পারছি না। আমরা খুব কষ্টে আছি। আমাদের  মত গরিবদের যে অবস্থা তাতে তো মনে হয় সরকারের আমাদের ভোটের দরকার নাই। এই জন্য ভাবছি আমি আর ভোট দিবো না। আর যে ধরনের ভোট হয় এই ভোট দিয়া তো কোনো লাভও নাই।
নুর মোহাম্মদ, মুদি দোকানি:  কেনাবেচা খুব খারাপ। আগে যেখানে মানুষ পাঁচ কেজি তেল কিনতো একন কিনে তিন কেজি। বিক্রি কমে যাওয়ায় মূলধনও কমে গেছে।  দোকানে মাল উঠাতে পারছি না। এদিকে আবার কোম্পানিগুলোও মাল সাপ্লাই দিতে পারছে না। সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে এই সরকার যদি সঠিকভাবে নির্বাচন দেয় তাহলে জীবনেও আসতে পারবে না। এ জন্য তারা সঠিক নির্বাচন দেয় না।

আনিস, নিরাপত্তা কর্মী: আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যায়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, সংসারের খরচ সব মিলিয়ে আর কুলাইতে পারছি না। আগে যে বাজার করতাম তারচেয়ে এখন অর্ধেক করি। তারপরও টাকা বেশি লাগে। আমাদের মতো মানুষের চলাই কষ্ট হয়ে গেছে।

রুহুল ইমতিয়াজ, শিক্ষক: রাজনীতি হতে হবে দেশের কল্যাণের জন্য। যেখান থেকে উপকৃত হবে পুরো জাতি। কিন্তু বর্তমান রাজনীতিবিদরা দেশ এবং জাতির কল্যাণের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে। তারা রাজনীতিকে বানিয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের পথ। বর্তমান রাজনীতিতে জনগণও গৌন হয়ে পড়েছে। তাদের অবস্থান এখন রাজনীতির ময়দানের সাইডলাইনে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির মন্দা অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এ ছাড়া অধিকাংশ দলই চাচ্ছে না যে ইভিএমে ভোট হোক। এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম ব্যবহার করলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট আরও বাড়বে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। মূল্যস্ফীতি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ হারে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। এজন্য আমাদের মতো মানুষের দিন চলছে অনেক কষ্টের মধ্যদিয়ে।
খাইরুল বাশার, সাংবাদিক: স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দেশের স্বার্থে আমাদের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল এক হতে পারেনি। বরং বিভাজনের রাজনীতিতে তারা বেশ এগিয়ে। যে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, গেল দুই সংসদ নির্বাচনে জনগণ সেই ভোট দেয়ার অধিকার হারিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশ কয়েকটি নির্বাচন শক্ত হাতে শেষ করলেও আস্থার সংকট রয়েই গেছে। সুষ্ঠু ভোটের দোহাই দিয়ে তারা অধিকাংশ রাজনৈতিক দল না চাইলেও সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতি সংকট মোকাবিলা করছে সেখানে ইভিএম কিনতে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় করা গরিবের ঘোড়া রোগের মতো মনে হয় আমার কাছে।

মো. তরিকুল ইসলাম, চাকরিজীবী: দেশের রাজনীতি জনবান্ধব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কথা ভাবে না। এ ছাড়া ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে চায় না। পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করার মতো পরিবেশও থাকে না। তিনি বলেন, ইভিএমে যে ভোট কারচুপির সম্ভাবনা নাই এটি এখনো নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই ইভিএম চাচ্ছে না। এটি ব্যবহার করলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য ভোটে ইভিএম ব্যবহার হোক এটা আমি চাই না।

সুমন হোসেন, ফল বিক্রেতা: আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। মানুষ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা এক কেজি ফল কিনতো তারা এখন আধা কেজি কিনছে। আমাদের আয় কমলেও ব্যয় অনেক বেড়েছে। বাজারে গেলে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতি এখন আর ভালো নেই। সব রাজনৈতিক দলই খারাপ। নির্বাচনই ঠিকমতো হচ্ছে না। ভোটারদের আর ভোট দেয়া লাগে না।

রূপলাল, জুতার কারিগর: আয়-রোজগার অনেক কমেছে। কিন্তু জিনিসের দাম অনেক বেড়েছে। বাজারে গেলে দুই-একটি জিনিস কিনতে গিয়েই সব টাকা খরচ হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না। নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, দেশের নির্বাচন নিয়ে আমার আগ্রহ নেই।

মুসা, রিকশাচালক: জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা অনেক কষ্টে আছি। সংসার চালাতে পারি না। ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে পারি না। তাদের ঠিকমতো খাওয়াতেও পারি না। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না। নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারে না। ভোট দেয়ার আগেই বলা হয় আপনার ভোট হয়ে গেছে।

বাসের মিয়া, দর্জি: বর্তমান নির্বাচনে ভোটারের প্রয়োজন হয় না। ভোটার ছাড়াই প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যায়। ভোট সেন্টারে যাওয়ার আগেই দেখা যাচ্ছে আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। এজন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা প্রয়োজন। তাহলে সব দলই সমান সুযোগ পাবে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। ইভিএমে ভোট হোক এটা আমরা চাই না। কারণ এটা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তিনি বলেন, আমাদের আয় আগের মতোই আছে। কিন্তু ব্যয় অনেক বেড়েছে। বিশ্বের সব দেশই অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে। তবে আমাদের দেশে এর প্রভাবটা বেশি।

ওসমান গণি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি: আগের থেকে আয় কমেছে কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ঘর ভাড়াও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা চাই সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে আমরা তাকে গ্রহণ করবো। বিনা ভোটের নির্বাচন আর চাই না।

বাবুল আক্তার, দোকান কর্মচারী: আমরা অর্থনীতি বুঝি না। আমরা বুঝি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় আগের মতোই আছে। যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। সন্তানকে ভালো খাবার খাওয়াতে পারছি না। খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি। আমরা চাই ভোট সুষ্ঠু হোক। তবে ইভিএমে ভোট হলেই ভালো হবে। ভোটে মারামারি কমে আসবে।

আনিসুর রহমান খান, বেসরকারি চাকরিজীবী: রাজনীতি এখন তার সঠিক ট্র‍্যাকে নেই। রাজনীতি চলে গেছে আমলা ও ব্যবসায়ীদের হাতে। যাদের কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই, জনগণের প্রতি কোনো রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নেই। রাজনীতিকে তার সঠিক ট্র‍্যাকে আনতে হলে মত ও পথের পার্থক্য ভুলে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গলদ বা গ্যাপ আছে। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ তথা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল সেই গ্যাপ বা দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ফলাফল পরিবর্তন, ভোটকেন্দ্র দখল বা ব্যালটে সিল মারা একটা নির্বাচনী অপকৌশল বা প্রক্রিয়ামাত্র।

হরগোবিন্দ সরকার অনুপ, চিকিৎসক: অনেক বাবা-মা তাদের ছেলে-মেয়ে রাজনীতি করুক- তা চান না। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে এখনো অনেক ভালো মানুষ রাজনীতি করে। কিন্তু ভালো মানুষগুলো দুষ্ট চক্রের কারণে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। যারা জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য তারা মনোনয়ন না পেয়ে অন্যরা মনোনয়ন পান। যারা পেশী শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন, কালো টাকার মালিক অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই দলীয় মনোনয়ন পান।

দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সিন্ডিকেটে আবদ্ধ। হঠাৎ করে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়া, লংজাম্পের মতো মরিচের দাম বৃদ্ধি- কেন? এর মূলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী। শক্ত হাতে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি।

শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন, আইনজীবী: রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, নির্বাচনে অনিয়ম, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে মামলা-মোকদ্দমা করতে হয়। তবে দিন দিন আদালতে এসব মামলা বাড়ছে। দেশে এখনকার মতো এতো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল না। দেশের রাজনীতি খুব খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে।  যে কোনো সময় দেশে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদেরকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। যে যার মতো করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছে। পঙ্গু করছে দেশের অর্থনীতি। আর এর জের টানতে হয় জনগণকে। এক শ্রেণির রাজনৈতিক, কথিত ব্যবসায়ী গরিবের পকেট কেটে বেগম পাড়ায় বাড়ি করে। ছেলে-মেয়েদের বিদেশে রেখে দেশে সুযোগ মতো একটি দলের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরপর কোনোক্রমে যদি পেয়ে যান ক্ষমতা, তখন তারা আর এদেশের কথা, খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভ্রƒক্ষেপ করেন না।
রানা ভূঁইয়া, ব্যাংকার: বাংলাদেশের অর্তনীতি চাঙ্গা করতে হলে প্রবাসী রেমিটেন্সের প্রণোদনা বাড়াতে হবে। তাদের সুযোগ সুবিধাও আরও বাড়াতে হবে। সরকার অনেক সময় বিভিন্ন সেক্টরে ভর্তুকি দেন। এই বিষয়টা মাথায় নিয়ে সময় সময় প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রণোদনা বাড়ানো গেলে খুব সহজেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব।

আবু বক্কার সিদ্দিক, গণমাধ্যম কর্মী: পাচার করা টাকা যেকোনো উপায়ে ফেরত আনতে হবে। খরচ কমানোতে সরকারকেই সামনে থেকে পথ দেখাতে হবে। সরকারি খাতে খরচ কমানোর অনেক জায়গা এখনো বিদ্যমান। আর সব থেকে বড় প্রয়োজন, দল-মত নির্বিশেষে এক হয়ে, বিভিন্ন শিল্প বিশেষজ্ঞ আর একাডেমিশিয়ান দিয়ে কমিটি গঠন করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করা। দেশে নির্বাচন আসন্ন। আর আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দৃশ্যমান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিকট ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে কম-বেশি সবাই চিন্তিত। সম্ভাব্য সেসব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হলে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক এবং শাসন পরিস্থিতি থেকেই আলোচনার শুরু করতে হবে।

নাহিন বিন মাহমুদ, শিক্ষার্থী: অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা তৈরি করা। সেটা কেবল কথার কথা হিসেবে নয় বা তার দায়িত্ব কেবল নির্বাচন কমিশনের নয়। বিরোধী দল এবং জোটগুলোকে এ অবস্থা উপলব্ধি করে এই সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ অবস্থার মোকাবিলা করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

সুলতানুল আম্বিয়া টনি, চাকরিজীবী:  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে এরশাদ সরকার আসার আগ পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো যেমন ছিল তা আর নেই। সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট জনসমষ্টির ১ শতাংশ হওয়ার পরও সরকার তাদেরকেই মূল্যায়ন করে থাকেন। তার প্রভাব মোট জনসংখ্যার উপরই পড়ে। চাল, তরকারি, ডিম, গ্যাস-বিদ্যুৎ, গাড়ি ভাড়া, বাসা ভাড়া, ওষুধসহ এখন দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তে বাধ্য।

আল-মামুন, ব্যবসায়ী: সকাল ১০টায় শুরু করি, রাত ১০টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখলে আমাদের কোনো রকমে চলে। এখন আবার রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হচ্ছে। আমরা কি ব্যবসা করবো আর কি বাণিজ্য করবো। ছেড়েও দিতে পারি না আবার অনেক কষ্টে করতে হচ্ছে। এখন দিন-দিন মানুষ সবাই আপডেট হচ্ছে। আমি না চাইলেই ইভিএম বাদ যাবে না। সরকার যেহেতু চাচ্ছে আর তারা যদি মনে করে দেশ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবে তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। আমরা চাই সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে যেন নির্বাচন হয়।

মন্টু মিয়া, রিকশাচালক: আগের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম অনেক বেশি হওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাসায় দুই ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের লেখাপড়ার একটা খরচ রয়েছে। আমি গাইবান্ধার বাসিন্দা। গ্রামে কাজ কম। আমাদের এলাকায় ৬ মাস ফসল হয়, তখন গ্রামে কাজ করি। বাকি ৬ মাস কোনো কাজ থাকে না, এ সময়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালাই। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অনেক কষ্টের মধ্যে জীবন চালাচ্ছি।

আব্দুর রহিম, ফল বিক্রেতা: আমার জীবনে দুইবার ভোট দিয়েছি। তারপর আর ভোট দিতে পারিনি। ভোট দিতে যাওয়ার আগেই তো ভোট হয়ে যায়। তাহলে ভোট দিয়ে কী হবে? ইভিএম বা ব্যালট পেপার কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। দুই বড় দলেরই ক্ষমতা ওলট-পালটের দরকার আছে। কেউ বেশিদিন থাকলে আর জবাবদিহিতা থাকে না। তাই সুষ্ঠুভাবে ভোট হওয়া জরুরি।

ইসরাফিল আলম, নিরাপত্তাকর্মী: আমাকে মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। এর বিনিময়ে আমাকে ১৮ ঘণ্টা গার্ড দিতে হয়। গ্রামে আমার স্ত্রীসহ বাচ্চা আছে। তাদের খরচ আমাকে চালাতে হয়। বাজারে সবকিছুর দাম অনেক চড়া। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বাড়তি। এভাবে আমাদের মতো নিম্নœ আয়ের মানুষের চলা অনেক কষ্টের।

গোপাল চন্দ্র, জুতা মেরামতকারী: সবকিছুর দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষ এখন আর জুতা কালি করাতে চায় না। তারা এখন বাসায় বসে নিজেরাই জুতা কালি করে। শুধুমাত্র জুতা-সেন্ডেল ছিঁড়ে গেলে আমাদের কাছে  আসে। এতে আর কতো টাকাই বা লাভ হয়। সুষ্ঠুভাবে ভোটের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসুক তারা যেন আমাদের জন্য কাজ করে এই কামনা করি।

গৃহিনী মোছা. লুৎফুন্নাহার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বাড়তি। বাসা ভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পর দৈনন্দিন বাজারের জন্য ৮ হাজার টাকা ব্যয় করতেন জোহরা। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ওই একই বাজার এখন ১১-১৫ হাজারে ঠেকেছে। এভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতাম। সব কিছুর ব্যয় বাড়ায় এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। এরমধ্যে ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় চতুর্মুখী সমস্যায় পড়েছি। ভ্যাপসা গরম। আমরা বড়রা সহ্য করতে পারলেও বাচ্চাদের সামলানো কঠিন। আগে তো দিনের বেলায় বিদ্যুৎ যেতো, এখন তো রাতেও যায়। বিদ্যুৎ পাচ্ছি না কিন্তু ঠিকই মাস শেষে বিল দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাচ্চারা ভালোভাবে পড়াশুনাও করতে পারছে না। তিনি বলেন, সংসারের খরচ বহন করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে সরকার আছে বলে মনে হয় না। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজারে গেলে অনেককিছু বাদ দিয়ে খরচ করতে হয়।

হাতিরঝিলে কথা হয় পাঠাও চালক রব্বানির সঙ্গে। তিনি জানান, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ভালো খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা তখন করছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, খরচ কমিয়েও ঢাকায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বাচ্চা ও স্ত্রীকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি। বলেন, বাসা ভাড়া কম বলে মিরপুরে থাকি। সম্প্রতি অনেকেই তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারাও তাদের আয়ে সংসার চালাতে পারছেন না। এসব টানাটানির মধ্যে হেলমেট হারিয়েছে। একটু ১৯/২০ হলেই পুলিশের মামলা তো আছেই। সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতার মধ্যে আছি। অসুস্থ অবস্থায়ও কাজে বের হতে হয়। শান্তি নাই। একপর্যায়ে তিনি বলেন, এলাকায় পলিটিকস করতাম। কিন্তু মামলা আর হামলার কারণে ঢাকায় এসে পাঠাও চালাই। কবে এলাকায় যাবো সেই দিন গুনছি এখন।

রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা ও এসএসসি পরীক্ষার্থী এল আর সাব্বির বলেন, এখন তো দিনে-রাতে লোডশেডিং চলছে। সেই হিসেবে আমি ভাগ্যবান যে, বর্তমানের এই লোডশেডিংয়ের আগেই সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে। তাই খুব একটা উদ্বিগ্ন নই।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাবিব বলেন, সরকার বলছে দাম কমেছে। মূলত কাগজে-কলমে কমছে। বাস্তবে তো দেখছি না। বাজার মনিটরিং কোথায় করা হচ্ছে? আমার প্রশ্ন হলো- বাজার মনিটরিং কি শুধু খুচরা বাজারে করতে হবে? কোম্পানি, ডিলার, পাইকাররা কী দামে বিক্রি করছে, সেটা কে দেখবে?’ তিনি বলেন, যখন দাম কমায় সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করা হয় না। আর যখন বাড়ানোর ঘোষণা আসে, তখন নির্ধারিত সময় থেকেই তা কর্যকর করা হয়। এসব দেখবে কে? আসলে দিন শেষে আমাদের মতো কম আয়ের মানুষের বেঁচে থাকা অর্থহীন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, সরকারের পরিবর্তন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকরপন্থিরাই আরামে আছে। আমরা যারা কোনো দল করি না, তারা ধুঁকে ধুঁকে মরছি। সব জায়গায় ক্ষমতার দাপট। আমরা দাপট দেখাতে পারি না। তাই কাজও হয় না।

হাতিরঝিলের পাশের এলাকা বেগুনবাড়ী। এখানেই দীর্ঘদিন ধরে চা বিক্রি করেন মাজেদ সরকার। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক খরচ কমিয়েও পারিবারিক ব্যয় বেড়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে শুধু চাল আর সবজি কিনতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, সরকার আমাদের দিকে তাকায় না। এরমধ্যে পুলিশের হয়রানি তো আছেই।

রাজধানীর মীরবাগে ভ্যানে করে পোশাক বিক্রি করেন খালেক মিয়া। ৫ সদস্যের পরিবারের বড় ছেলের বউ ব্যতীত সবাই-ই ছোটখাট কাজ করে। এরপরেও মাসের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধির পরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব বেলায় শাকসবজি খেয়েই দিন পার করছেন তারা। বলেন, এক ছেলে লেবারি কাজ করে। সপ্তাহে ১ দিন কাজ পেলে ২ দিন বসে থাকতে হয়। দৈনিক হাজিরা ৬০০ টাকার বেশি দেয় না। আমার স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকার মতো উপার্জন করে। এ টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া, বিদ্যুত বিল, গ্যাস, চাল-ডালেই চলে যায় সব টাকা। মাঝে মাঝে ডিম খেতাম কিন্তু এখন ডিমও খেতে পারছি না। শাক-সবজি আর আলু দিয়েই খাচ্ছি।

মধুবাগ শেরেবাংলা স্কুলের সামনে ফুটপাথে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন মজিবর মিয়া (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, বয়স হয়েছে আর পারছি না। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাই এখন কঠিন। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০০০ টাকার স্থলে ৮০০০ হাজার টাকা লাগছে। কিন্তু আমার আয় আগের চেয়ে কমেছে। একদম বাধ্য না হলে, এখন আর আগের মতো কেউ কাপড় সেলাই করার জন্য আসে না। ফলে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হয়েছে। তিনি বলেন, ছেলের প্রাইভেটের জন্য ৩০০০ টাকা ব্যয় হতো সেটি বন্ধ রেখেছি। ছোটখাটো রোগে ওষুধ কেনাও বন্ধ করেছি। তবুও ধার-কর্জ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় রিকশাচালক আতর আলীর সঙ্গে। ময়মনসিংহ থেকে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন কয়েক বছর আগে। থাকেন বেগুনবাড়িতে রিকশা গ্যারেজে। চলমান নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নিদারুণ কষ্টে ভুগছেন তিনি। সংসারে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৪ জন সদস্য। চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে আয় কমে যাওয়া ও সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অনুকূলের বাহিরে চলে যাচ্ছে তার। বলেন, আর কত খরচ কমিয়ে চলা যায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষও আগের মতো আর রিকশায় ওঠে না। হেঁটেই চলে যায়, ফলে আমাদেরও আয় কমে গেছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দামে তো আগুন। ঢাকায় মেসভাড়া, খাওয়া খরচ ও গ্রামে পরিবারকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। সংসারের বাড়তি ব্যয় মেটাতে আতর আলী বাধ্য হয়ে স্কুল পড়–য়া মেয়ে এবং স্ত্রীকে পোশাক কারখানায় কাজে পাঠিয়েছেন।

বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা ও ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রেতা মো. বায়েজিদ বলেন, যা আয় হয় তার অর্ধেক টাকা গ্রামের বাড়ির অসুস্থ পিতামাতার জন্য পাঠাতে হয়। বাকি টাকা ঢাকায় বাসাভাড়া-খাবারের পেছনে ব্যয় করেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় টিকে থাকতে এখন টিসিবি’র পণ্য কিনছেন বায়েজিদ। তিনি বলেন, আমার জীবনে টিসিবি’র পণ্য কিনতে হয়নি। কিন্তু এখন বাধ্য হচ্ছি কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে আরও বেশি টাকা পাঠাতে হচ্ছে। আর এদিকে এই টাকা দিয়ে ঢাকায় চলাও সম্ভব হচ্ছে না।

রাজধানীর একটি ব্যস্ততম এলাকার রাস্তায় জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন ৪৫ বছর বয়সী মদন চন্দ্র শাহা (আসল নাম নয়)। চলমান করোনা আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সারাদিনে তার আয় কমে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আগের মতো কেউ আর জুতা পলিশ করে নেয় না। এই টাকায় সংসার খরচ বহন করা কঠিন হয়ে উঠেছে তার। শাহা বলেন, বাসাভাড়া ও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৬ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই চোখে-মুখে কোনো পথ না দেখে বাধ্য হয়ে ছেলেকে সংসারে বাড়তি কিছু টাকা আয়ের জন্য অন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। আয়-ব্যয়ের এই অসামঞ্জস্য নিদারুণ যন্ত্রণায় তার সংসারে শান্তি নেই বললেই চলে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ জিসিনপত্রের দামটা যেন কমায়।