‘প্রতিবিপ্লবের’ ঝুঁকির মধ্যে কেন এই অস্থিরতা

গণ-অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পার হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রদের কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেল

বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়েছে? অনেকে শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলেছেন। তবে বিপ্লবের পর সরকার ও রাষ্ট্রে যে ধরনের বদল দেখা যায়, এখানে তা ঘটেনি। সেদিক থেকে দেখলে এই পরিবর্তনকে ‘বিপ্লব’ বলা কঠিন। তা ছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেটিও ‘বিপ্লবী সরকার’ নয়। এই পরিবর্তন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছে।

তবে এই গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকেই ক্ষমতা থেকে সরায়নি, জনগণের অনেক চাওয়াকেও সামনে নিয়ে এসেছে। বলা যায় ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ এখন একটি সর্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়েছে। ‘বিপ্লব’ না বললেও ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের যে অনেক বিপ্লবী চাওয়া রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৫ আগস্ট দেশে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান যা–ই ঘটুক, সেই পরিবর্তনকে উল্টে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রকে আমরা ‘প্রতিবিপ্লব’ বলতেই পারি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিবিপ্লব কারা করতে পারে? প্রথমত, পতিত রাজনৈতিক শক্তি। এর বাইরেও কিছু শক্তি থাকতে পারে, যারা বিপ্লব–পরবর্তী একটি নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। রাজনৈতিকসহ নানা ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে নিজেরা ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি করতে পারে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ এখন এই দুই দিক থেকেই ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে দেশের রাজনীতি যে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে এই ধারণা জোরদার হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হয়েছে অনেক জীবনের মূল্যে, আহত হাজার হাজার মানুষকে এখনো এক বিভীষিকাময় সময় পার করতে হচ্ছে। এমন আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান অনেক প্রত্যাশার জন্ম দেয়। দ্রুত ফল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়। অথচ একটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান বা এর পরের বাস্তবতা সামাল দেওয়াই এমন পরিস্থিতিতে এক কঠিন কাজ। এখন এর সঙ্গে যদি বাড়তি আশা ও দ্রুত ফল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়, তখন হতাশার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক।

ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত এখন তেমনই একটি সময় পার করছে। গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী এমন পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় পতিত শক্তি। প্রতিবিপ্লবের সুযোগ নেওয়ার জন্য এটাই হচ্ছে সবচেয়ে উর্বর সময়।

গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব শক্তি ও জনগণকে এই বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। ছাত্রসমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনী—গণ-অভ্যুত্থান সফলকারী এই তিন পক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ন্যূনতম কিছু ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ ও একই ধারায় থাকতে হবে। এই চার পক্ষের মধ্যে কোনো বিভক্তি ও বিভ্রান্তি প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

‘সরকার কি তাহলে প্রতিবিপ্লবের মুখোমুখি?’ এই শিরোনামে ১৬ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে মানবজমিন পত্রিকায়। পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি লিখেছেন।

সরকার ‘প্রতিবিপ্লবের’ কোনো ঝুঁকিতে আছে কি না, তা নিয়ে ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। ড. ইউনূস বলেছেন, ‘এটা নতুন কোনো খবর নয়। আমরা সবাই জানি এবং দেখছি। নানাভাবে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। চোখ-কান খোলা রেখেছি, যা ব্যবস্থা নেওয়ার, নিচ্ছি।’ বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব কি তাহলে অবশ্যম্ভাবী? ইউনূসের জবাব ‘ইতিহাস তো তাই বলে। আমরা আমাদের কাজ করছি। কিছু ভুলত্রুটি তো আছেই।’

বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব নিয়ে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী সি রিট মিলের একটি উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তিনি বলেছেন, প্রতিবিপ্লব প্রমাণ করে যে বিপ্লব দরকারি হয়ে পড়েছিল এবং সমাজে যে আসলেই বিপ্লব ঘটেছে, তা–ও নিশ্চিত করে। এখন ৫ আগস্টের পর প্রতিবিপ্লবের যে ঝুঁকির কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে আমরা এটা ধরে নিতে পারি যে দেশে সত্যিই বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং এই পরিবর্তন জরুরি ছিল।

বাংলাদেশ এখন ৫ আগস্টের পরিবর্তন-পরবর্তী প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকির পর্ব পার করছে। কিন্তু এই বিপদের মধ্যে এখন যুক্ত হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা। পরিস্থিতি এখন বেশ জটিল রূপ নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কোনো একক দল বা কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনে রেখে ৫ আগস্টের পরিবর্তন ঘটেনি। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশের নানা রাজনৈতিক আদর্শের দল ও মত-পথের মানুষ এক হয়েছিল স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে।

সেই লক্ষ্য অর্জনের পর রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলো এখন নিজেদের লক্ষ্য পূরণে মনোযোগী হয়েছে। এর জন্য সবারই রয়েছে নিজ নিজ কৌশল, মত ও পথ। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি প্রতিরোধে রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে যে ঐক্য দরকার, সেখানে ফাটল দেখা যাচ্ছে। অথবা এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কোনো একটি গোষ্ঠী বিভক্তি তৈরি করে প্রতিবিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করছে।

দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের আমলের রাষ্ট্রপতিকে রাখা না বিদায় করা, সংবিধানের পথে থাকা বা না থাকা, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনপ্রক্রিয়া ভুল না শুদ্ধ—এসব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে বা তোলা হচ্ছে। এসব কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী, ভাবুক, জনপ্রভাব আছে এমন ইউটিউবার বা সাধারণ মানুষ—অনেকেই বিভ্রান্ত ও বিভক্ত।

৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হয়েছে, এমন দাবি ও আলোচনার জবাব দিতে হচ্ছে সরকারের আইন উপদেষ্টাকে, ‘যদি সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হয়ে থাকে, তাহলে সেটা আন্দোলনে থাকা সবার ভুল।’ তিনি আরও প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ তো তখন বলেনি যে আমরা কেন শপথ নেব, সাংবিধানিক পথে যাব, চলেন, বিপ্লবী সরকার গঠন করি।’ একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর যেখানে সামনে তাকানো দরকার, সেখানে শুরু হয়েছে কে কোন ভুল করেছে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হঠাৎ করে ২২ অক্টোবর পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে সরকারের প্রতি সময়সীমা বেঁধে দেয়। অথচ অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তারা সরকারের অংশ। তাদের একটি দাবি অর্থাৎ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার দাবিটি নিয়ে রাজনীতি এখন বেশ সরগরম রয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির অনাগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর এখন তারা এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।

ছাত্রদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে, ‘অভ্যুত্থান ও জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করা। এই দাবি অস্পষ্ট। এখানে আরও একটি মনোযোগের বিষয় হচ্ছে ‘জুলাই বিপ্লব’ শব্দবন্ধের ব্যবহার। অন্যদিকে আদালতে দুটি রিট করে পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা। এগুলো অস্থিরতার লক্ষণ।

গণ-অভ্যুত্থান সংগঠনের আড়াই মাস পার হওয়ার পর নতুন করে কেন পুরোনো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ছাত্ররা হঠাৎ কেন কঠোর অবস্থানের দিকে গেল বা এই অস্থিরতার কারণ কী, এই প্রশ্ন এখন অনেকের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

ইতিহাসে যেসব বড় পরিবর্তন বা বিপ্লব সফল হয়েছে, সবগুলোকেই প্রতিবিপ্লবের চাপ সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিবিপ্লবের ঢেউ সামলাতে দীর্ঘ সময় লাগার নজিরও রয়েছে। আমেরিকান মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ হারবার্ট আপথেকার মনে করেন, প্রতিবিপ্লব প্রতিহিংসামূলক এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

আর তা সব সময়ই ষড়যন্ত্রমূলক। বাংলাদেশের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা পরিবর্তনকে পাল্টে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টাও একই সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রতিহিংসামূলক হতে বাধ্য। এবং নিশ্চিতভাবেই তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যাবে।

গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব শক্তি ও জনগণকে এই বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। ছাত্রসমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনী—গণ-অভ্যুত্থান সফলকারী এই তিন পক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ন্যূনতম কিছু ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ ও একই ধারায় থাকতে হবে। এই চার পক্ষের মধ্যে কোনো বিভক্তি ও বিভ্রান্তি প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। পতিত ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি বা অশুভ কোনো পক্ষ এর সুযোগ নিতে পারে।

prothom alo

1 COMMENT

  1. This is a very useless opinion piece. It only talks about generalities and in a disorganized way. For example, it answers its first question “Who will do counter-revolution?” by saying “the group that lost power”. No one will disagree with that. But, the next question should have been, “how can they do it?” In other words, what paths are available to them to do it. That is what would have really given this article some practical meaning, but it is totally silent on that point. So, here, let me write it for him.
    One easy path available is: A military coup organized by the current Army Chief, in cahoots with the current President, both of whom are AL appointees and clearly beholden to SH. The proof is in the pudding. For example, why did the Army Chief let SH escape, instead of arresting her and bringing her to justice? At that point, she clearly was totally helpless and the Army Chief could have done anything he wanted, but didnt. Doesnt that call his motivations into question? I wont even go into the movitations of the President given his recent claim that SH id not actually resign.
    What should be the next practical step for Dr. Yunus CG Govt? In my view, FIRE THEM BOTH IMMEDIATELY (and talk later). Get the conspirators out of your house before they can do any damage. DO NOT GIVE ANY FALSE REASONING THAT THIS IS AGAINST THE CONSTITUTION. After a (any) revolution, the old constitution is DEAD. Germany did not keep the Nazi constitution after Hitler’s fall. In any case, that is a tainted constitution, manipulated by the AL already a number of times. If you believe the constitution has to be upheld, than doen’t that mean that the CG government itself is unconstitutional and has no authority? So, stop this BS of upholding the constitution and follow a revolutionary path – FIRE Army Chief and President, BAN AL PARTY, Totally reorganize the police force and Bring SH and all her top honchos and police officers responsible for the killings to justice. Then, do the longer-term things like reorganizing the govt, rewriting the constitution, etc. THE PATH IS CLEAR, BUT UNLIKE THIS AUTHOR, WE FIRST HAVE TO ACKNOWLEDGE THAT THIS WAS INDEED A REVOLUTION. It is not just a game to call it anything you want, but not a revolution, and then sit back and do nothing.

Comments are closed.