- খন্দকার হাসনাত করিম
- ০৭ মে ২০২৩, ২০:১১
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একটি সত্য উপলব্ধি সবসময়ই প্রকাশ করেন যে, ‘নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার নয়।’ বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য ও গণতন্ত্রের কারণে। তাই নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া বাংলাদেশের জন্মশর্ত অর্থহীন হয়ে পড়ে। জাতির দুর্ভাগ্য যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এ দেশে শুধু সুদূর পরাহতই নয়, নিদেনপক্ষে নির্বাচিত সরকারের অধীনে শাসিত হওয়ার সুযোগটুকু থেকেও এ দেশের মানুষ অর্ধ শতাব্দী ধরে বঞ্চিত।
আমাদের সন্তান এবং তাদের সন্তানরা এখন ভাবতেই পারছে যে, বিশ্বজনীন স্বীকৃত প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় আইনসভা (সংসদ), নগর করপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের অপর সব সংস্থার পরিচালনায় ভোটার জনগণের গরিষ্ঠ সংখ্যকের সম্মতির কোনো প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা আছে। ভারতের মুসলিম শাসনের বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ বাবর বলেছিলেন, ‘ঘোড়ার পিঠে বসে দেশ জয় করা যায়, কিন্তু দেশ শাসন করতে হলে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসতে হয়।’ কিন্তু ক্ষমতায় সমাসীন থেকে বা ঘোড়ার পিঠে বসে জনগণের সম্মতির তোয়াক্কা না করে মনগড়া ও দলগড়া নির্বাচনী ফলাফল দিয়ে শাসনের ধারাবাহিকতাকে ‘বৈধতা’ দেয়ার অভ্যাস থেকে আমাদের দেশের শাসকরা কি সরে আসতে পেরেছেন? তারা কি প্রকৃত অর্থে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসেছেন? ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।
আমাদের দেশে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের শেষ অভিজ্ঞতা ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। পাকিস্তান আমলের অন্য নির্বাচনগুলোও সুষ্ঠু হয়েছিল। তা না হলে ১৯৫৪ সালে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি ঘটেছিল কিভাবে? সত্তরের নির্বাচনটি ছিল ব্যতিক্রমী। এটি ছিল ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মহা-গণভোট। আমরা অবশ্য প্রায়ই একটি বড় ভুল করে বসি। আমাদের অনেকেরই ধারণা, ১৯৭০ সালের ভোট ছিল শাসনক্ষমতা অর্জনের ভোট। আসলে ওটি ছিল আইনি কাঠামো অধ্যাদেশ (Legal Framework Order, LFO-Gi-এর) অধীনে তদানীন্তন অবিভক্ত নিখিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য বিধায়কমণ্ডলী (Constituent Assembly) নির্বাচন। সেই ঐতিহাসিক অধ্যাদেশ বা Legal Framework Order প্রণয়ন করেছিলেন যাকে আমরা ইতিহাসের প্রধান খলনায়ক বলি, সেই সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পণ্ডিত সংঘকে দিয়ে এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন, যেখানে পাঁচটি প্রদেশের (পূর্ববাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান) বিশাল ও বিচিত্র ভূ-খণ্ডের কথা ভেবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট (Bicameral) আইনসভা সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ওই আইনসভার উচ্চকক্ষকে বলা হতো জাতীয় পরিষদ, যার সদস্যরা হলেন- এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা ছিলেন এমসিএ। (Members of Council Assembly). এই এমসিএরাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হয়ে গেলেন এমপি (Members of Parliament). সত্তরের ভূমিধস বিজয় (Landslide Victory)- পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা মেনে নেয়নি বলেই বাংলাদেশ গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তথা পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তদ্রুপ ১৯৫৪ সালেও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ‘যুক্তফ্রন্ট’ বিজয়ী হয়। এই যে নির্বাচনী রায়, এটি সম্ভব হয়েছিল ১৯৫৪ সালে বা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মানুষ যার ভোট তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দিতে পেরেছিলেন এবং ফলাফল নিরপেক্ষ হয়েছিল বলেই। নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রশাসন বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মানুষ ভাবতেও পারত না। বাংলাদেশও স্বাধীন হলো আর ভোট দানে বাধা দান, ব্যালট ছিনতাই, ফলাফল ঘোষণায় কারচুপি ((Manipulation)) এগুলোও শুরু হলো। এমনকি ব্রিটিশ আমলে ভোটে শাসক ব্রিটিশদের বা প্রভাবশালী কংগ্রেস পার্টি বা মুসলিম লীগের হস্তক্ষেপের কথা এ দেশের মানুষ ভাবতেও পারত না। দেশ ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে যে প্রাদেশিক পরিষদের ভোট হয় তাতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কার্যত বন্যার স্রোতের মতো ভেসে যায়। শাসকরা নির্বাচন ব্যবস্থায় হাত ঢুকালে কি এটি হতে পারত?
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী পূর্ববাংলা প্রাদেশিক আইনসভায় আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯টি। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা বা দেশ বিভাগের পর এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এর আগে ব্রিটিশ শাসনাধীনে শেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৪৬ সালে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় পূর্ববাংলা আইনসভায় ২২৮টি ছিল নির্ধারিত মুসলিম আসন; ৩৬টি ছিল তফসিলি সম্প্রদায়ের এবং ১২টি ছিল মহিলা আসন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে ২৩৭টির মধ্যে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয় ২২৩টি আসনে; ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ জেতে মাত্র ৯টি আসনে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনসহ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সব বড় নেতাই জনসমর্থন হারান। শেরেবাংলা দু’টি আসনে জেতেন। খেলাফত রব্বানী পার্টি জেতে একটি আসনে। আর চারটি আসনে জেতেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্বতন্ত্রভাবে জিতেও চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে যোগ দেয়ায় মুসলিম লীগের আসন দাঁড়ায় ১০টি, যা দ্বারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ একটি সংসদীয় গ্রুপ গঠনের সুযোগ পায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশের মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়।
তেমনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় দেখেও তারা এই নির্বাচনে প্রতিফলিত বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান বুঝতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশের একটি গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব ও পর্যায়ক্রমে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কটের সামরিক সমাধানের পথ বেছে নেয়। দেশের ঘুমন্ত মানুষের ওপর ২৫ মার্চের মধ্যরাতে তারা শুরু করে দেয় নির্বিচার জাতিগত নির্মূল অভিযান তথা পৈশাচিক গণহত্যা। বাংলাদেশের মানুষের তখন স্বাধীন হওয়ার জন্য হাতিয়ার নিয়ে গর্জে ওঠা ছাড়া আর কোনোই বিকল্প ছিল না। দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু দেশ শাসনে নির্বাচিত সরকার বা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র সোনার হরিণই হয়ে রইল।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ধারাবাহিকতাই ঘটত। তবে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ১৯৪৬ বা ১৯৫৪-এর নির্বাচনের মতো অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল এমন দাবি করা যাবে না। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর কেটেছে উপর্যুপরি সামরিক শাসনে। সেই সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৭৯ সালের নির্বাচন মোটামুটি নিরপেক্ষ ও অহিংস ছিল। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা যাতে সরকারি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নির্বাচনে ব্যবহার করতে না পারে এ জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা এ দেশের রাজনীতিবিদরাই এনেছিলেন এবং এই ব্যবস্থার সুফলও জাতি পেয়েছে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৭ সালের নির্বাচন চারটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় এবং সেই সময়কার প্রতিটি ‘অনির্বাচিত’ সরকারকে এখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থন করে এসেছে। এই দল ১৯৯৬ সালে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বও দিয়েছে। বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তাতে একটি দলের বেশির ভাগ কারচুপি করে জেতার প্রবণতাকে আর যাই বলা হোক নির্বাচিত বৈধতা বা নির্বাচিত সরকার বলে গণ্য করা যায় না।
নির্বাচন হলো জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সর্বজনীন ব্যবস্থা। যদি নির্বাচনই না হয়, আজকের ভোট যদি গত রাতেই বাক্সে বোঝাই হয় এবং রাষ্ট্রীয় সেবকরা যদি ক্ষমতাসীনদের মেশিন-টুলে পরিণত হয়, বিরোধী দলকে যদি নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রিসীমানার মধ্যেই আসতে দেয়া না হয়, তাহলে সেটি কি নির্বাচন নামের প্রহসন হয়ে যায় না? ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ‘নির্বাচন’ বলার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? ১৯৫৪ বা ১৯৭০-এর নির্বাচনী ফলাফলে শাসকদলের ‘প্রকৌশল’ ছিল না বলেই সেগুলোতে প্রতিফলিত গণরায় ঠাহর করা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর জন্য সম্ভব হয়েছিল। এখনকার তথাকথিত ‘নির্বাচনে’ জনমত ও ভোটারের পছন্দ প্রতিফলিত হয়েছে বলে দাবি করলে তা হবে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বলে দাবি করার মতোই। নিজেদের শাসক নির্বাচন করার জনগণের যে অধিকার তা কেড়ে নেয়া হলে তো গণতন্ত্রই লুট হয়ে যায়! তাহলে আমাদের রাজনীতিরই ভবিষ্যৎ কী? গণতন্ত্রেরই বা ভবিষ্যৎ কী?
গণতন্ত্র ও রাজনীতির এই ঘনঘোর দুঃসময়ে লাভবান হয় আমলা বা রাষ্ট্রীয় সেবকরা আর লাভবান হয় ব্যবসায়-বাণিজ্য-অর্থনীতিসহ সমাজের আর সব ক্ষেত্রের অসৎ, অসাধু, দুর্নীতিবাজ ও দৌরাত্ম্যবাজ খলনায়করা। ব্রিটিশরা এ দেশে ছিল ঔপনিবেশিক প্রভু ও জবরদখলবাজ। তাই তারা তাদের সুবিধার্থে জগৎশেঠ, উমি চাঁদ, রায়দুর্লভদের মতো দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা বণিকদের তাদের সহযোগী হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু দেশে সুষ্ঠু ও বিধান মানা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈধতা এবং সম্ভাবনা থাকার অপরিহার্যতা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশ নেতৃত্বে কেন আমলা-গোমস্তা-শেরেস্তাদারদের হাতে ক্ষমতা ও সুযোগ এত অবারিত করে দিতে হবে? রাজনীতিবিদরা যে দলেরই সমর্থক হোন না কেন, তাদের বিবেকে কি এই প্রশ্নের দংশন ক্ষত টের পান না? নাকি দলানুগত্যের জন্য তারাও বিবেককে জমা দিয়ে রেখেছেন দলের অফিসে বা ক্ষমতাকেন্দ্রের দুর্গে?
রাজনীতিবিদরাই ব্রিটিশদের হাত থেকে পাকিস্তান এনেছিলেন এবং সেই পাকিস্তানের শোষণ-বৈষম্য ও অগণতান্ত্রিক নীতির প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। সেই দেশ গণতন্ত্রের এমন মরু-খরা ও অনার্দ্র শুষ্কতায় এ যুগের ধনিক-বণিক-আমলাগোষ্ঠীর কাছে বর্গা দিতে হবে, এটি কি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ অনন্তকাল মুখ বুঝে মেনে নেবে? এটিই যদি চলতে থাকবে তাহলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়েছিল কেন? গণতন্ত্রের জন্য শহীদ নূর হোসেনের অতৃপ্ত আত্মাকে কী জবাব দেবেন এ দেশের রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকর্মীরা? আর কতকাল অধরা সোনার হরিণ হয়ে থাকবে এ দেশের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
[email protected]