চাহিদামতো টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে না পারায় দণ্ডসুদ বা জরিমানা দিতে হচ্ছে ইসলামি ধারার ছয় ব্যাংককে। এসব ব্যাংকের তারল্যসংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দণ্ডসুদের টাকাও পুরোটা জমা দিতে পারছে না। তাই তারল্য পরিস্থিতির উন্নতির জন্য এসব ব্যাংককে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে জরিমানার টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে।
তারল্যসংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ছয়টি হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। এসব ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তারল্যঘাটতিতে রয়েছে।
ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআরের টাকা জমা করছে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শুধু ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে দায় সেরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোও অনিয়ম বন্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে।
‘যেসব ব্যাংক নিয়মানুযায়ী সিআরআর ও এসএলআর রাখতে পারছে না, ওই ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক বসানো হয়েছে। আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নেওয়া হচ্ছে।’
মেজবাউল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র
এদিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের আমানত কমছে—এই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে ১০টি। এসব ব্যাংকে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সর্বমোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের সর্বমোট বিনিয়োগ বা ঋণ ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১০১ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি গ্রুপের মালিকানাধীন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটের কারণে জরিমানা দিচ্ছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাত গুটিয়ে বসে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতি ব্যাংক খাতকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। এমন সংকট হলে ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসিয়ে দেওয়া উচিত। যাতে আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদে থাকে। তাতে গ্রাহকের আস্থা বাড়ে।
জরিমানা কেন
ব্যাংকগুলোতে মানুষ যে টাকা জমা রাখেন, দৈনিক তার সাড়ে ৩ শতাংশ হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। প্রতি দুই সপ্তাহ শেষে রাখতে হয় ৪ শতাংশ অর্থ। নগদ এ জমা সিআরআর নামে পরিচিত। কোনো ব্যাংক চাহিদার যে পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে পারে না, তার ওপর ৯ শতাংশ হারে প্রতিদিন দণ্ডসুদ আরোপিত হয়।
এ ছাড়া গ্রাহকের জমা টাকার ১৩ শতাংশ নগদ, বন্ড, বিল বা বৈদেশিক মুদ্রা আকারে জমা রাখতে হয়। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য এ হার সাড়ে ৫ শতাংশ। এটি বিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআর নামে পরিচিত। কোনো ব্যাংক এসএলআর চাহিদার যে পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে পারে না, তার ওপর দৈনিক সাড়ে ৮ শতাংশ হারে দণ্ডসুদ আরোপিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ও ব্যাংক কোম্পানি আইনে এই দণ্ডসুদ মওকুফ করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে যেসব ব্যাংকের জরিমানা হচ্ছে, সেসব ব্যাংককে জরিমানা পরিশোধে সর্বোচ্চ বাড়তি সময় দিতে পারছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে পদ্মা ব্যাংককেও এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
কার কত জরিমানা
জানা গেছে, ইসলামি ধারার ছয় ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত চলতি বছরের আরোপিত দণ্ডসুদ পুরোটা আদায় করতে পারছে না। তাতে গত জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের জরিমানা বা দণ্ডসুদ হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আদায় করেছে ৭৫ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জরিমানা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের জরিমানা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৭ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের জরিমানা হয়েছে ২০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৬ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের জরিমানা হয়েছে ৮ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের জরিমানা হয়েছে ১ কোটি টাকা, জরিমানার কোনো অর্থ আদায় করা যায়নি। ব্যাংকগুলোকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জরিমানার বাকি টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তারল্য পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যে জরিমানা হয়েছে ও ঘাটতি আছে, তা পূরণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করছি, এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারব।’
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি জাফর আলমও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
কেন সংকট
ইসলামী ব্যাংকের তারল্যসংকটের বড় কারণ ঋণ অনিয়ম। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। ব্যাংকটির ঋণ অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের আমানত তুলে নেন গ্রাহকেরা।
ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের আমানত আগের বছরের চেয়ে ১৭ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা কমে যায়। আমানত কমলেও গত বছর ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকটি। ফলে তারল্যসংকট দেখা দেয়। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়।
কিন্তু ব্যাংকটির বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের দায়িত্বে থাকা মিফতাহ উদ্দিনকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি টেরাকোটা টাইলস রপ্তানির নামে অর্থ পাচারে জড়িত থাকার দায়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি কাজী রেজাউল করিমকে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি করা হয়েছে।
উল্লিখিত ব্যাংকটির এসব অনিয়মের সময় চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপ মনোনীত প্রতিনিধি নাজমুল হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটির যেসব অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। পরিচালনা পর্ষদকে এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। তাই অনিয়মের দায়দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের।
একই ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকেও। মূলত ইসলামী ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা দেওয়ার পর তার প্রভাব গিয়ে পড়ে শরিয়াহভিত্তিক অন্যান্য ব্যাংকেও।
কারণ, বেশির ভাগ শরিয়াহ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে তাদের সংকট সমাধান করত। তারল্যসংকটে পড়ায় ব্যাংকগুলোকে তারল্যসহায়তা দিতে গত আট মাসে নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।