- হামিদ মীর
- ২১ মে ২০২৩, ১৯:৫৫
এ কাহিনীটি শুরু হয়েছে ২০১৮ ও ২০২৩ সালে এসে, সেটি চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছাল। কাহিনীর নাম ‘প্রজেক্ট ইমরান খান’। প্রজেক্ট শেষ হলো কিন্তু ইমরান খান শেষ হননি। ‘প্রজেক্ট ইমরান খান’ ২০১১ সালে আইএসআই প্রধান আহমদ সুজা পাশা শুরু করেছিলেন। ২০১২ সালে তার অবসর গ্রহণের পর জহিরুল ইসলাম এ প্রজেক্ট এগিয়ে নেন এবং নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ইমরান খানকে ব্যবহার করেন। ২০১৪ সালে ইসলামাবাদের দিকে ইমরান খানের মার্চ ও ডি চকে অবস্থান ধর্মঘট আইএসআইয়ের পরিকল্পনার ফল ছিল; কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। জহিরুল ইসলামের অবসরে যাওয়ার পর প্রজেক্ট ইমরান খানের ফাইল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়ার সেনাপ্রধান হওয়ার পর আবার এ ফাইল চালু হয়। বাজওয়া তার শ্বশুর মেজর জেনারেল (অব:) এজাজ আমজাদ ও কিছু পুরনো বন্ধুর সহায়তায় সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য লবিং করেন। নওয়াজ শরিফ যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়; বরং সুপারিশের ভিত্তিতে জেনারেল বাজওয়াকে সেনাপ্রধান বানানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং বাজওয়াকে সেনাপ্রধান বানানোর পর এক বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জেনারেল বাজওয়া ইমরান খানের সাথে মেলামেশা শুরু করলেও ইমরান খান বাজওয়া দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হননি। ইমরান খান তার বাধা সত্ত্বেও বুশরা বিবির সাথে বিয়ে বন্ধনের আবদ্ধ হন। এ নির্দেশ অমান্যতা বাজওয়াকে বেশ মনোক্ষুণ্নু করে। তিনি শাহবাজ শরিফের সাথে চুক্তি চূড়ান্ত করার চেষ্টা করেন। বাজওয়া চাচ্ছিলেন, শাহবাজ শরিফ তার ভাই নওয়াজ শরিফ থেকে রাজনৈতিকভাবে আলাদা হওয়ার পথ অবলম্বন করুন। কিন্তু শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নিজের ভাইকে ধোঁকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। শাহবাজ শরিফের অস্বীকার ইমরান খানের ভাগ্য বদলে দেয়। জেনারেল বাজওয়া অনিচ্ছাসত্তে¡ও আবার ইমরান খানের কাছে ফিরে যান এবং ২০১৮ সালে কারচুপির মাধ্যমে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানান।
২০১৮ সালে প্রজেক্ট ইমরান খান নতুন করে শুরু করার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে বহু আইনি ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আসা। ইমরান খান ওই প্রজেক্টের জন্য শুধু একটি চেনা মুখ ছিলেন। প্রজেক্টের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে পাকিস্তানকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়াও শামিল ছিল। অন্য দিকে ইমরান খান তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। তিনি কিছু সেনা কর্মকর্তার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা বাজওয়া মেনে নিতে পারেননি। ২০১৯ সালে বাজওয়া তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করানোর পর ইমরান খানকে চোখ রাঙাতে শুরু করেন। উভয়ের দ্বন্দ্ব সে সময় তীব্র আকার ধারণ করে, যখন বাজওয়া ফয়েজ হামিদকে আইএসআইয়ের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ইমরান খান এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করেন। বিরোধীপক্ষ সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্বের ফায়দা লুটে এবং অনাস্থা আন্দোলনের মাধ্যমে ইমরান খানকে সরকার থেকে সরিয়ে দেয়।
ইমরান খানের সরকারের বিদায় ঘটে ২০২২ সালের এপ্রিলে। তবে তার বিশ্বাস ছিল, প্রজেক্ট ইমরান খান শেষ হয়নি। অতি দ্রুত তিনি সরকারে ফিরে আসবেন। তিনি প্রজেক্ট ইমরান খানের সমাপ্তির ব্যাপারে ৯ মে ২০২৩ ওই সময় নিশ্চিত হন, যখন কমান্ডো সেনারা তাকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রান্তর থেকে হাস্যকরভাবে গ্রেফতার করে। এমনটি প্রথমবার নয়। অতীতেও বহু রাজনীতিবিদকে আদালতে গ্রেফতার করা হয়েছে; কিন্তু ইমরান খানের গ্রেফতারিতে তার দল যে প্রতিক্রিয়া দেখাল, তার উদাহরণ আগে বিদ্যমান নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়; কিন্তু পিপলস পার্টি জেনারেলদের ঘরে হামলা করেনি। নওয়াজ শরিফ একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন; কিন্তু জেনারেল হেডকোয়ার্টারে কেউ চড়াও হয়নি।
ইমরান খানের গ্রেফতারিতে তার দল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রতিক্রিয়া একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া ছিল না; বরং এমন ফ্যান ক্লাবের প্রতিক্রিয়া ছিল, যা একটি উগ্রপন্থী দলে বদলে গিয়েছিল। এ ফ্যান ক্লাব নিজেদের ছাড়া আর কাউকে সঠিক মনে করে না। তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রতিক্রিয়াতে অততি বাড়াবাড়ি মূলত সেই শিক্ষার ফল ছিল, যা দলের নেতারা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে দিয়েছেন।
যতক্ষণ পর্যন্ত সেনা জেনারেল ইমরান খানের রাজনৈতিক মদদদাতা ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইমরান খান ওই জেনারেলদের গুণ গেয়েছেন। যখন জেনারেলরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন থেকে ইমরান খান তাদের নাম নিয়ে আর ভয় দেখাননি। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তেহরিক-ই-লাব্বাইকের লোকদের ধমকের সুরে বলতেন- খবরদার, রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করো না। নতুবা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আজ তার দল রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করছে। এমতাবস্থায় তেহরিক-ই-ইনসাফের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গায়েব হয়ে গেছেন। রাজনীতিবিদদের গ্রেফতারিতে এমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা উচিত নয় যে, গ্রেফতারিকে জীবন-মরণের ইস্যু বানিয়ে নেয়া হবে। এটি রাজনৈতিক অপরিপক্বতার চূড়ান্তন্তরূপ।
তেহরিক-ই-ইনসাফ আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ দিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে ব্যক্তিগত শত্রুতে রূপ দিয়েছে। এরপর তারা ইমরান খানের গ্রেফতারিতে জ্বালাও ঘেরাওয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দফতরগুলোতে নিজেদের বহু হিতাকাঙ্ক্ষী হারিয়েছে। ইমরান খান চিরদিন জেলখানায় থাকবেন না। আসিফ জারদারি, শাহবাজ শরিফ, মাওলানা ফজলুর রহমান, আখতার মিঙ্গাল ও আলি উজিরসহ বহু রাজনীতিবিদ জেলখানা থেকে ফিরে আসতে পারলে ইমরান খানও বেরিয়ে আসবেন (এবং বেরিয়ে এসেছেন)। কিন্তু জেলখানায় তার এটি ভাবা উচিত যে, তার গ্রেফতারিতে তেহরিক-ই-ইনসাফ যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, তাতে ইমরান খানের উপকার হলো না ক্ষতি হলো?
আজ তেহরিক-ই-ইনসাফের বিরোধীদের এ কথা বলার সুযোগ হয়েছে যে, এটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটি এক সন্ত্রাসী সংগঠন। এটিকে নিষিদ্ধ করা উচিত। আমি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে নই। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার আরোপের আগে ওই সব অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিন, যারা প্রজেক্ট ইমরান খানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সংবিধান ও আইনকে লাঞ্ছিত করেছেন। আহ, যদি ইমরান খান রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ খতমের জন্য সংগ্রাম করতেন! কিন্তু আফসোস, সরকার থেকে বিদায়ের পর তার চেষ্টাই ছিল, সেনাবাহিনী তাকে ফের ক্ষমতায় এনে বসাবে। আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের জন্য তিনি কিছু জেনারেলের নাম নিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। তার একটিই সফলতা, তিনি বেশ সুন্দরভাবে নিজের ব্যর্থতার ওপর আবরণ দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ের নাটক করেছেন।
আশা করা যায়, তিনি এবার তেহরিক-ই-ইনসাফকে ফ্যান ক্লাব থেকে একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তৈরিতে মনোযোগ দেবেন। রাজনীতিবিদদের সেনাসহায়তায় ক্ষমতা অর্জন করা উচিত নয় এবং সেনাবাহিনীরও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। নতুবা সেই ক্ষতিটিই হবে, পাকিস্তানের যে ক্ষতিটি করেছে প্রজেক্ট ইমরান খান।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১১ মে, ২০২৩ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট