বারিধারায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে সহকর্মী মনিরুল হককে হত্যার উদ্দেশ্যে সর্বমোট ৩৮ রাউন্ড গুলি ছুড়েন কনস্টেবল কাওছার আলী। এরমধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৩৪ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। কাওছার গুলি করার আগে মনিরুলের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে মনিরুলকে খুব কাছ থেকে গুলি করে কাওছার। প্রথম গুলি শরীরে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মনিরুল। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এসময় কাওছারের এলোপাতাড়ি গুলিতে পথচারী জাপান দূতাবাসের এক গাড়িচালক গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত হয়ে তিনি গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মর্মান্তিক এ ঘটনায় রোববার নিহতের ভাই বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেছেন। মনিরুলের এমন নির্মম মৃত্যুতে তার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীতে তার সহকর্মীরাও শোকাহত।
কনস্টেবল কাওছার সহকর্মী মনিরুলকে কেন এভাবে গুলি করে হত্যা করেছেন তার কারণ এখনো বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাওছারকে গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো এমন নির্মম ঘটনার কারণ জানা যায়নি। তবে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য বের করা হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে গুলিতে নিহত কনস্টেবল মনিরুল হকের সঙ্গে অভিযুক্ত কনস্টেবল কাওছার আহমেদের তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। তর্কাতর্কির পর উত্তেজিত হয়ে কনস্টেবল কাওছার সহকর্মী মনিরুলকে গুলি করে। দুই পুলিশ সদস্যের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল এমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। কাওছারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি কিন্তু বিরোধের কোনো তথ্য পাইনি। পাশাপাশি অভিযুক্ত কাওছারের গত এক-দুই মাসের ডিউটির রেকর্ড দেখেছি। রেকর্ডে দেখা গেছে কাওছার যথাযথভাবে ডিউটি করেছেন। গুলি করার আগে তাদের মধ্যে কোন বিষয়ে তর্ক হয়েছিল এখনো তা নিশ্চিত হতে পারিনি। সেটি পরে তদন্তে জানা যাবে। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে অভিযুক্ত কনস্টেবল কাওছার আহমেদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। গুলি করেই সে হতভম্ব। এ কারণে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল সেÑ এটা কীভাবে হয়ে গেল। আমি জানি না। নিজের সহকর্মীর সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর সে মানসিকভাবে নার্ভাস হয়ে পড়ে। যে কারণে ঘটনা ঘটার পরও অস্ত্র রেখে কনস্টেবল কাওছার সেখানে হাঁটাহাঁটি করছিল। কারণ সে হয়তো স্ট্রেস নিতে পারছিল না। ঘটনার পর সে বুঝতে পেরেছে, হয়তো কতো বড় অন্যায় ও অমানবিক কাজ করে ফেলেছে। এক-দুদিন গেলে বোঝা যাবে গুলি করার কারণ। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ডিউটির কারণে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। আর এখন কোথাও ডিউটির অতিরিক্ত চাপ নেই। স্বাভাবিকভাবেই ডিউটি করছেন সবাই।
ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, অভিযুক্ত ও নিহত দুই কনস্টেবল ফিলিস্তিন দূতাবাসের উত্তর-পূর্ব কোনায় পুলিশ বক্সে অবস্থান করছিলেন। বক্সের বাইরে ঝগড়া করতে দেখা যায় তাদের দুজনকে। বাক-বিতণ্ডার একপর্যায়ে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনের ফুটপাত দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে কাওছার পুলিশ বক্সে ঢোকে। কাওছারের পেছনে পেছনে আসেন মনিরুল। বক্সের দরজার বাইরে মনিরুল এবং ভেতরে কাওছার। তখনো বাকবিতণ্ডা চলছে। একপর্যায়ে মনিরুল দক্ষিণ পাশের দরজার সামনে থেকে পূর্ব পাশের জানালার পাশে আসেন। এর কয়েক সেকেন্ড পর কাওছার ভেতরে এবং মনিরুল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। তখনো চলছে বাকবিতণ্ডা। এর কয়েক সেকেন্ড পর পুলিশ বক্সের ভেতর থেকে জানালা দিয়ে প্রথম গুলি ছোড়ে কাওছার। এতে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন মনিরুল। তখন ভেতর থেকে কাওছার বেরিয়ে এসে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মনিরুলের দেহ লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। বেশ কয়েকটি গুলি মনিরুলের শরীরে লাগে।
রোববার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, মনিরুলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তখনো তার পরনে পুলিশের পোশাক ছিল। শার্টের বুক খোলা। পায়ে পুলিশের বুট জুতা, বুকে, মাথায় ও বাম চোখে গুলির চিহ্ন। বুক পকেটে কলমও ছিল। পুরো শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মর্গের বাইরে স্বজনরা অপেক্ষা করছিলেন। স্বজনদের কান্নায় ভারী ছিল মর্গ এলাকা। মর্গের সামনে নিহত মনিরুল হকের চাচাতো ভাই মো. রিয়াদ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনা শুনতে পাই রাত পৌনে ২টায়। শুনেই রওনা দিয়ে চলে আসি। মনিরুলের ১৭ মাস বয়সের একটি ছেলে আছে। তারা তিন ভাই, তিন বোন। মনিরুল সবার ছোট। ২০১৮ সালে সে চাকরিতে যোগদান করে। পরিবার নেত্রকোনা থাকেন। সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করতো। মনিরুল প্রথমে জামালপুর, ময়মনসিংহ চাকরি করে ৩-৪ মাস হলো ঢাকায় যোগদান করে। মনিরুল খেলাধুলা পছন্দ করতো। জামালপুর থাকা অবস্থায় পুলিশের পুরস্কার পেয়েছে ক্রিকেট খেলে। তার বড় ভাইও পুলিশে কনস্টেবল পদে চাকরি করেন।
সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখনো লেগে আছে রক্তের দাগ। রোদে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়েছে। ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনের ফুটপাথে বিভিন্ন জায়গায় রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মনিরুলকে যেখানে গুলি করা হয়েছে সেই জায়গাটি সবসময় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে। কারণ এই জায়গাটি কূটনৈতিক এলাকা। এখানে রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রের দূতাবাস। ঘটনাটি ঘটেছে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে। এর পাশে রয়েছে চীন ও জাপানের দূতাবাস। ঘটনাস্থল থেকে একটু দক্ষিণ দিকে এগোলে রয়েছে তুরস্ক, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। ঘটনাস্থলের উত্তর দিকে রয়েছে যুক্তরাজ্যের দূতাবাস। এমন একটি এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটায় কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ঘটনাস্থলে আমাদের লোক ছিল, ঘটনা যে ঘটিয়েছে সেও আমাদের লোক। ঘটনাটা কী কারণে ঘটেছে সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি।
মনিরুলের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন গুলশান থানার এসআই আব্দুল মান্নাফ। সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মাথার বাম পাশে একাধিক গুলির আঘাতের চিহ্ন। বাম চোখ গুলিবিদ্ধ, নাক ও বাম কান দিয়ে রক্ত বের হয়। বাম ও ডান হাতে গুলির রক্তাক্ত চিহ্ন। গলার নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত বুক, পিঠ ও পেটের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ।
গুলশান থানার মামলার এজাহারে বাদী বলেছেন, কনস্টেবল কাওছার আলীর সঙ্গে নিহত মনিরুল বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনের ফিলিস্তিন দূতাবাসের পুলিশ বক্সে রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত দুইজনেই সশস্ত্র অবস্থায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দায়িত্বরত অবস্থায় রাত আনুমানিক পৌনে ১২টার সময় কাওছারের সঙ্গে নিহত কনস্টেবল মনিরুল হকের বাকবিতণ্ডা হয়। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে কাওছার উত্তেজিত হয়ে মনিরুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাওছার তার কাছে থাকা ‘ঝগঞ-৯’ অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। আসামির গুলির আঘাতে মনিরুল ফিলিস্তিন দূতাবাসের পুলিশ বক্সের সামনে ফুটপাথে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আসামির এলোপাতাড়ি গুলিতে পথচারী জাপান দূতাবাসে কর্মরত ড্রাইভার সাজ্জাত হোসেনের বাম হাতে একটি ও পেটে দুইটি গুলিবিদ্ধ হয়। বর্তমানে আশঙ্কাজনক অস্থায় গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। সংবাদ পেয়ে গুলশান থানা পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয়ে ঘটনাস্থলের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে আসামিকে সশস্ত্র অবস্থায় আটক করে থানায় নিয়ে যায়। আসামির কাঁধে ঝুলানো অবস্থায় ২২ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিনসহ অস্ত্র এবং রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় আরেকটি খালি ম্যাগাজিন ও ৩৪টি গুলির খোসা ও নিহতের কাছে থাকা ৭.৬২ চায়না রাইফেল ও চায়না রাইফেলের ২০ রাউন্ড গুলিসহ অন্যান্য আলামত জব্দ করা হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, কাওছার ২০০৫ সালে পুলিশে যোগদান করে। ঘটনার দিন সকালে কাওছার বাড়িতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৭ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। কাওছারের দুই ছেলে। ডিউটিতে আসার আগে রাত ৮টার দিকে সে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। কাওছারকে কখনো অস্বাভাবিক মনে হয়নি। জানা যায়, বারিধারায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনের পুলিশ বক্সে কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম সাড়ে ৩ মাস এবং কনস্টেবল কাওছার আহমেদ ১ বছর ১০ মাস ধরে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি ব্রাজিলীয় কোম্পানি টরাস আর্মসের তৈরি। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মানবজমিনকে জানায়, আসামি কাওছার যে বন্দুক দিয়ে গুলি করেছেন এই বন্দুকে একটি ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা ৩০ রাউন্ড গুলি। দুইটি ম্যাগাজিনে মোট ৬০ রাউন্ড গুলি কাওছারের নামে ইস্যু করা ছিল। ‘ঝগঞ-৯’ নামের অস্ত্রটিতে একটি ম্যাগাজিনের গুলি শেষ হওয়ার পরে আরেকটি ম্যাগাজিন লোড করেন কাওছার। দ্বিতীয় ম্যাগাজিনের আট রাউন্ড গুলি ছোড়েন তিনি। সর্বশেষ কাওছারের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ২২ রাউন্ড গুলি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, কাওছার আলী ‘ঝগঞ-৯’ অস্ত্র দিয়ে মনিরুলকে হত্যা করেছে। নিহতের বন্দুক থেকে কোনো গুলি ছোড়েনি। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা ও তার গুলি ছোড়ার ধরন দেখে বোঝা যায় সে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। তার ভেতরে মানসিক সমস্যা লক্ষ্য করা যায়নি। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিএমপি গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম মানবজমিনকে বলেন, নিহত মনিরুলের বড় ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। তদন্ত চলছে। কাওছারকে হত্যার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়ছে, কিন্তু সে মুখ খুলছে না। রিমান্ডে এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
manabzamin