ঢাকায় নিয়োজিত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, রিকন্ডিশন্ড সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে ফেয়ার টেকনোলজি-হুন্ডাই কারখানা পরিদর্শনকালে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের আমদানি করা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ির উপর নির্ভরতা কমানো উচিত। পরিবেশের জন্যও দেশীয়ভাবে তৈরি গাড়ি ভালো হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, অনেক দেশ ইতিমধ্যেই পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং বাংলাদেশও অনুরূপ নীতি গ্রহণ করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট খাতের সূত্রমতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ প্রাইভেট কার বিক্রি হয়। ২০২২ সালে নিবন্ধিত হয়েছে ২৬,৯৩৫টি প্রাইভেট কার এবং এসইউভি। তারমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই সেকেন্ড-হ্যান্ড, আর বাকি ৩০ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন গাড়ি।
কেন ব্যবহৃত জাপানি গাড়ির উপর এত নির্ভরতা?
১৯৮০ এর দশক থেকে ব্যবহৃত জাপানি গাড়ি, প্রধানত টয়োটা, বাংলাদেশের অটোমোবাইল বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। রাস্তায় বেশিরভাগ গাড়িই টয়োটার, এবং ভোক্তারা এটিকে অন্য সব ব্র্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে মনে করেন।
প্রকৃতপক্ষে, জাপানি গাড়িগুলি এত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সেগুলোর ভাল পারফরম্যান্স এবং খুচরা যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা। স্থানীয় মেকানিকরাও টয়োটা গাড়ি মেরামত করা সহজ বলে মনে করেন। মেকানিক এবং গ্যারেজ মালিকদের একটি বড় অংশ এই গাড়িগুলি মেরামত করতে শিখেছেন, যে কারণে তাদের জীবিকাও টয়োটার উপর নির্ভর করে।
তবে র্যানকন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, পুরনো জাপানি গাড়ির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে আমাদের সরকারের নীতির কারণে, অন্য কিছু নয়। সরকার নীতিমালা তৈরি করেছে তাই আমরা এসব গাড়ি আমদানি করি।
তিনি বলেন, সরকার সম্ভবত ভেবেছিল যে আমরা যদি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করি তবে আমাদের কম বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে এবং মানুষও কম দামে একটি গাড়ি পাবে।
জাপানি পুরনো গাড়ির প্রধান বাজার হল বাংলাদেশ, আফ্রিকা মহাদেশ এবং রাশিয়া। অতীতে, বাংলাদেশ আমদানিকারকদের আট বছরের কম সময় ব্যবহৃত গাড়ি আনার অনুমতি দিয়েছিল। যেগুলোর দামও কম।
এখন সরকার আর পাঁচ বছরের বেশি পুরনো গাড়ি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে জাপানে পুরনো গাড়ির দাম বেড়েছে এবং এ কারণে বাংলাদেশকে বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে।
মোস্তাফিজুর বলেন, আমরা আজকাল দেখছি যে জাপানের অনেক পুরনো গাড়ির দাম একেবারে নতুন গাড়ির (আমদানি করা) চেয়ে অনেক বেশি।
নতুন গাড়ির সুবিধা হলো, ক্রেতা পাঁচ বছরের গ্যারান্টি এবং দুই বছর বিনামূল্যে মেরামতের সুবিধা পান।
তিনি বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পুরানো যানবাহন নতুন গাড়ির চেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। নতুন গাড়ির তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি কার্বন নিঃসরণ করে পুরনোগুলো।
‘এখন আমাদের অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে এবং আমাদের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে, যা যানবাহনের চাহিদা বাড়াচ্ছে। কিন্তু পুরানো জাপানি গাড়ির উপর নির্ভরতা অটোমোবাইল শিল্পে বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ।’ যোগ করেন তিনি।
অটোমোবাইল শিল্পকে উৎসাহিত করতে চায় বাংলাদেশ
স্থানীয় অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে সহায়তা করার জন্য অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০২১ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ, যাতে মানুষ কম দামে গাড়ি কিনতে পারে। সংশ্লিষ্ট খাতের নেতারা বলেন, স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরনো জাপানি গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারব।
নির্ভরতা কমাতে সরকার সেমি-নকড-ডাউন (এসকেডি) এবং কমপ্লিট নকড-ডাউন (সিকেডি) প্লান্ট স্থাপনে বিদেশি এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলিকে উৎসাহিত করছে। মূলত, এগুলি অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট।
কিন্তু এসব প্ল্যান্ট স্থাপনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএএমএ) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, চীন মিরসরাইয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। জাপানের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে গাড়ি তৈরিতে ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে সরকার সহায়তা দেবে। তবে বড় বড় কোম্পানিগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের দেশেই অটোমোবাইল তৈরি করতে চাই। আমাদের সরকারসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে।
নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব বলেন, ‘অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০২১ এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে।
তিনি বলেন, আমাদের বেশিরভাগ গ্রাহক জাপানি গাড়ি কেনেন। কিন্তু এই খাতে জাপানি বিনিয়োগ কোথায়? আমরা ডব্লিউটিও অনুযায়ী পুরনো জাপানি গাড়ি আমদানি বন্ধ করতে পারি না। আমরা এটাকে নিরুৎসাহিত করতে পারি।
তিনি বলেন, সরকার এখন উচ্চ কর দিয়ে এবং এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন দিয়ে জাপানি গাড়ি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে।
তিনি বলেন, ‘এর প্রভাব কী? গাড়ির দাম বাড়ছে। তবে আপাতত পুরনো জাপানি গাড়ি আমদানি করা ছাড়া বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, জনগণ যাতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় একটি নতুন গাড়ি কিনতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এটা তখনই হতে পারে যখন বাংলাদেশে কারখানা গড়ে উঠবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হল দেশে অটোমোবাইল শিল্প থাকা, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য।
তিনি বলেন, কেউ বিনিয়োগ না করলে সরকার রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি কমাতে পারবে না। আমরা যদি যানবাহন রপ্তানি করতে চাই তবে আমাদের বৈদ্যুতিক গাড়ি বা টয়োটা তৈরি করতে হবে।
আবদুল মাতলুব বলেন, ভারত ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো নিজেদের গাড়ি তৈরি করে আসছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশ তা করতে পারে না, কারণ রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলো সস্তা এবং সেগুলোও নতুনের মতো চলে।
তিনি বলেন, সরকারকে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে আপনি যদি দেশে বিনিয়োগ করেন তবে আমরা আমদানি করা পুরানো জাপানি গাড়ির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেব।
পুরনো গাড়ি আমদানিকারকরা চান সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা
কোম্পানিগুলোকে অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং কারখানা স্থাপন করতে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগকে পুরনো জাপানি গাড়ির আমদানিকারকরা দেখেন একচেটিয়া আধিপত্য তৈরির উপায় হিসেবে। তারা বলেন, বাংলাদেশের উচিত কমপ্লিটলি বিল্ট ইউনিটের (সিবিইউ) জন্য কারখানা স্থাপন করা।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, দেশে একটি অটোমোবাইল শিল্প স্থাপনে সরকারের পদক্ষেপকে তারা সবসময় স্বাগত জানান। তবে তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত সম্ভাব্য বাজার বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, মালয়েশিয়া সহ অনেক দেশ অটোমোবাইল শিল্প স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে।
আবদুল হক বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত মূলত গাজীপুরে একটি অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট থাকায় এ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এই একটি দিয়ে শিল্প তৈরি করা যায় না।
তিনি বলেন, এটি মূলত একটি ‘স্ক্রু ড্রাইভার শিল্প’ কারণ এটি একটি সংযোজন কারখানা। তারা কোরিয়া থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে আসছে এবং হয়তো বাংলাদেশে পেইন্টিং করছে।
আব্দুল হক জানান, জাপান থেকে আমদানি করা পুরনো গাড়ির জন্য তারা (আমদানিকারকরা) প্রায় দ্বিগুণ কর পরিশোধ করেন।
তিনি বলেন, আমরা সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা চাই। পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দেশে নতুন গাড়ি তৈরি করলে একচেটিয়া রাজত্ব তৈরি হবে। আর বিশ্বের কোনো দেশই তা করতে পারেনি। পুরনো যানবাহন খাত এই নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্র্যান্ডিংয়ে স্থানীয় শিল্পের প্রয়োজন
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পুরোনো জাপানি গাড়িগুলো নির্ভরযোগ্য ও টেকসই হওয়ায় বাংলাদেশে ও সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। পুনরায় বিক্রি করার ক্ষেত্রে ভালো দাম পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, সুতরাং, আমি যদি এমন একটি গাড়ির মালিক হই যার পুনঃবিক্রয় মূল্য কমে না এবং এটি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়, তাহলে আমি কেন এটি ব্যবহার করব না?
শামসুল হক বলেন, একটি গাড়ির কার্বন নিঃসরণ নির্ভর করে সেটি কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তার ওপর। আমাদের ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। যানবাহনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
এই অধ্যাপক আরো বলেন, আমাদের দেশে আমরা এখনও দূষিত জ্বালানি বিক্রি করি এবং পরিষ্কার জ্বালানি পাওয়া যায় না। আমাদের এই বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। আপনি যদি নতুন গাড়িতে এই জ্বালানি ব্যবহার করেন তবে নতুন যানটিও দূষণ তৈরি করবে।
তবে পুরানো জাপানি গাড়ির উপর আমাদের নির্ভরতা কামনো উচিত, এই বিষয়ে তিনি সম্মত। বাংলাদেশে কারখানা তৈরি হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় আমাদের দেশের ব্র্যান্ডিং করার দিকে মনোযোগ দেই, কিন্তু আমরা সেটা করি তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে করি। যদিও এটি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরিতে খুব বেশি অবদান রাখে না। আমরা যদি সত্যিই বাংলাদেশের জন্য একটি ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে চাই, তাহলে অটোমোবাইল খাত একটি উপায় হতে পারে।