পা পিছলে পড়লেই শেষ

  • তোফাজ্জল হোসাইন
  •  ২৫ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৫৯

রাজনীতির মাঠ আবার ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে, তেল-গ্যাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে শুরু হলো মাঠ গরমের রাজনীতি। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বিএনপি মাঠপর্যায়ে মিটিং-মিছিল পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বাধা উপেক্ষা করে বাস্তবায়নে অনেকটাই আশানুরূপ। দেশের আটটি বিভাগে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমাবেশে জনস্রোত চোখেপড়ার মতো; যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা রাতের আঁধারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকিং, পরিবহন বন্ধ, পুলিশি হয়রানিসহ সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাবেশ সফল করেছে; যদিও এ আন্দোলন ছিল তেল, গ্যাস, দ্রব্যমূল্য ও দেশব্যাপী নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। আন্দোলন এখন ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বসে নেই। তারাও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠেই আছে। তৃণমূলকে চাঙ্গা রাখতে এবং দলের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে জেলায় জেলায় কর্মসূচি পালন করেন নেতারা। এভাবেই রাজধানীসহ রাজনীতির উত্তাপ দলের তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান এজেন্ডা, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রকিব কমিশনের ভোটারবিহীন নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ ছিলেন যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ছিল অবমাননাকর। বিরোধী দলহীন সেই নির্বাচনে ভোটডাকাতি, কেন্দ্র দখল, খুনাখুনি বেশ আলোচিত ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল রকিব কমিশনের ‘শান্তিপ্রিয়’ নির্বাচনে। শান্তিপ্রিয় শব্দটি তো রকিব কমিশনের অপ্রত্যাশিত বাণী। ভোটকেন্দ্রে পশুপাখির বিচরণ সাংবাদিকদের ক্যামেরাবন্দী হওয়া থেকে বাদ পড়েনি। দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করা অসম্ভব; তার প্রথম প্রমাণ ২০১৪ সাল। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ছিল মেরুদণ্ডহীন হুদা কমিশনের অন্যতম চমৎকার ম্যাজিক। রাতেই কিচ্ছা খতম মানে রাতের আঁধারে ভোট শেষ। রাতে মানুষ ইবাদত করার জন্য জাগ্রত হয়, আওয়ামী লীগ ইবাদত মনে করেই ভোটের মতো একটি পবিত্র আমানত অতীব গুরুত্বের সাথে আদায় করেছে। মিডিয়ার সামনে হুদা কমিশন ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ বলেছেন, ‘এমন সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন বাংলাদেশ দেশে আর কখনো হয়নি’। চোরের মায়ের বড় গলা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা দেশ-বিদেশের সবাই দেখেছেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে এ রকম হতাশাব্যঞ্জক নির্বাচন যে কখনো হতে পারে, এটি হয়তো আমরা কেউই ভাবিনি। নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন মাত্রার অবক্ষয় কিভাবে ঘটতে পারল? আমরা কি এই অবস্থায় এক দিনে পৌঁছেছি?

‘দেশে এখন গণতন্ত্র নেই, নেই কথা বলার অধিকার, দেশে একনায়কতন্ত্র চলছে’। জনগণকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ভোটের অধিকারের লড়াই শুরু হয়েছে- এ লড়াই বড় লড়াই, আমাদের জিততেই হবে! চট্টগ্রামে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশজুড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। রাজনীতির মাঠ বিএনপি গরম করলেও আওয়ামী লীগ কৌশলে এগোবে। কঠোর নজরদারিতে রাখবে বিএনপির রাজনীতি। গুম খুন আর লুটপাটের মহোৎসব ক্ষমতাসীন রাতের ভোটের সরকারের মেয়াদকালের জীবন্ত ইতিহাস হয়ে থাকবে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে দেবে না’। সরকারের বক্তব্য, নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি জনগণ মেনে নেবে না; যদিও এগুলো বিএনপির নামে অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজনীতির মাঠ গরমের কথা বলে দেশে কোনোরকম অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে দেবে না আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন গণমাধ্যম, অনলাইন পত্রপত্রিকা অনেক সোচ্চার। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সব নৈরাজ্য ও অপকর্মের বোঝা বিএনপির কাঁধে ঝুলিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। দেশের ৯০ শতাংশ জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। এ দিকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। কোনো সহায়ক সরকার হবে না, কোনো ভাবনার সরকার হবে না। এ নিয়ে বিএনপির সাথে কোনো আলোচনা করা হবে না, সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়।’ বিএনপি বুঝতে পেরেছে তাদের মিথ্যাচার, মানুষ হত্যা, লুটপাট, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির জন্য জনগণ আগামী নির্বাচনেও তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। তাই তারা মাঠ গরমের নামে নানা ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ফের ষড়যন্ত্র করা হলে, আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জ্বালাও পোড়াও করলে কোনোরকম ছাড় দেয়া হবে না। এসব যারা ফের করবে তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপিকে নিয়ে বিচলিত হওয়ার দরকার নেই- তবে তাদের বিভাগীয় যে দু’টি সমাবেশ সেখানে বহু লোক সমাগম হয়েছে। তারা আন্দোলন করছে এবং সরকারের পদত্যাগ চাচ্ছে কোন ইস্যুতে? তারা একটি ব্যর্থ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন অনেক দেরি। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে গরম হাওয়া বইছে; তা ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। অনেক ভয়ভীতি, হিমালয় পাহাড় পরিমাণ বাধা ডিঙিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।

‘রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটে আসে। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠের রাজনীতি কখনো গরম; আবার কখনো রাজনৈতিক বাহাস চলবে। তবে রাজনীতির মাঠ গরমের মৌসুম শুরু হয়েছে। শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। শুরু হয়েছে মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এই আন্দোলন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও শিক্ষা-চিকিৎসা নিশ্চয়তার। দেশের মানুষ ভালো নেই, জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি হাত ফসকে যায়, এই গাঢ় ঘোর কালো অন্ধকারে বাংলাদেশ আর আলোর মুখ দেখবে না।

[email protected]