বহুল আলোচিত পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের দুইটি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েই চলেছে। সরকারের ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের তালিকায় থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমাও বাড়ছে।
যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ব্যয় অনুমান সঠিক না হওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প কর্মকর্তাদের অনীহার কারণেই মূলত বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে দেরি হচ্ছে। আর প্রকল্পের কাজ শেষ করতে দেরি হওয়ায় বেড়ে চলেছে ব্যয়।
ইতোমধ্যে বন্দর সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব সংশোধন করা হয়েছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে আজ মঙ্গলবার আরও একটি প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন প্রস্তাব পাস হয়েছে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরিতে আরও সময় চাওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। এর ব্যয় ধরা হয়েছিলো তিন হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এই ব্যয় সংশোধন করে চার হাজার ৫১৬ কোটি টাকা করার এবং প্রকল্পের সময়সীমা আরও দেড় বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।
মূলত জেটির উচ্চতা সামঞ্জস্য করতেই এই ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
আন্ধারমানিক সেতু নির্মাণ অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ গবেষণা চালানোর পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই সেতুর দৈর্ঘ্য এক দশমিক শূন্য পাঁচ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে এক দশমিক ১৭ কিলোমিটার করার পরামর্শ দেয়।
এজন্য সরকারের কাছে আরও ৪১১ কোটি টাকা চায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা জরিপ চালিয়েছে কি না, জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘এটা যদি সাধারণ কোনো ভুল হয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু, যদি কোনো গাফিলতি থাকে, তাহলে আমি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
মন্ত্রী আরও বলেন, যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাক কার্যক্রম যারা পরিচালনা করবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে।
এই প্রকল্প সম্পর্কে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বন্দরের অফিসিয়ালদের ব্যবহারের জন্য একটি প্রশাসনিক ভবনই শুধু নির্মিত হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, প্রকল্পের পরিচালকসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা ঢাকায় থাকেন এবং মাঝে মাঝে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তবে, প্রযুক্তিগত কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকাতেই থাকেন।
২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন পাস হয় এবং সে বছরের ১ নভেম্বর এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরবর্তীতে, ২০১৬ সালে সীমিত আকারে তৃতীয় সমুদ্রবন্দরটির কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অসম্পূর্ণ থাকায় এখনো পণ্য বহনকারী মূল জাহাজগুলো বন্দরে ভিড়তে পারে না।
২০১৬ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালীন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ২০২৩ সালে পায়রা বন্দর সম্পূর্ণরূপে চালু হবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘এখানে ৭৫ হাজার কন্টেইনার রাখার সক্ষমতা থাকবে।’
তবে, সেই সক্ষমতা বাস্তবায়ন হতে আরও অনেক বেশি সময় লাগবে বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই বন্দরে ১০৬টি সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে পেরেছে এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বন্দরের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২৫৩ কোটি টাকা।
পায়রা বন্দর বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণের আরেকটি প্রকল্প রয়েছে। সেটি বাস্তবায়নেও দুই বছর বেশি সময় প্রয়োজন হবে এবং এর ব্যয় এক হাজার ২৪ কোটি টাকা বেড়েছে।
একনেক গত বছরের নভেম্বরে এই প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। বিভিন্ন কারণের পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে তিন হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়।
২০১৫ সালে শুরু হওয়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনের এই প্রকল্পটির প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছিল এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতেই এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেদারল্যান্ডসের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি ও ডিজাইনের কাজ করছে। এই কাজটিও এখনো শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত মাস্টারপ্ল্যানের মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বন্দরে বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পাঁচ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এখনো প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন পায়নি।
পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে ছয় হাজার ৫৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ২০২১ সালে শুরু হয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে এই প্রকল্পের কাজ।
এ বিষয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং সংস্থা জান ডি নুল’র সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে।
বন্দরে কয়লা টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ২১৪ কোটি টাকার একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি এখনো এর কাজ শুরু করতে পারেনি।
বন্দর অঞ্চলে একটি শহর গড়ে তুলতে এবং কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চল উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকার আরও একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে, সেই প্রকল্পেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটিতে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শদাতা ও পরামর্শক সংস্থা নিয়োগ করতে না পারা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি এবং প্রকল্পের কর্মীদের স্থানান্তর করায় এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বাড়তি সময় লাগছে।
আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তিনি বন্দরটি পরিদর্শন করেছেন এবং বর্তমানে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, ড্রেজিংয়ের জায়গাগুলোতে মাটির স্তর মাতারবাড়ি এবং চট্টগ্রামের চেয়ে বেশ ভিন্ন।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার সময় আমরা জানতে চেয়েছিলাম যে, এখানে ব্যয় এত বেশি কেন? তারা জানিয়েছে, ডাচ বিশেষজ্ঞদের মতে এই অঞ্চলের মাটির বৈশিষ্ট্য আলাদা।’