পাহাড়ে বিস্ফোরক আইইডি পুঁতে হত্যাযজ্ঞে মেতেছে কেএনএফ

 আমার দেশ
৩০ জুন ২০২৩

পাহাড়ে ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কেএনএফ

পাহাড়ে ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কেএনএফ

নিজস্ব প্রতিনিধি

পাহাড়ে ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি এবং রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে মাটির নীচে বিস্ফোরক আইইডি (হাতে তৈরী বোমা) পুঁতে রেখে মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করেছে বম জনগোষ্ঠীর বিপদগামী এ সশস্ত্র সদস্যরা। হাতে তৈরি বোমা বিস্ফোরণে সেনা কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। পার্বত্যবাসীদের নিরাপত্তা এবং দেশের স্বার্বভৌমত্ত হুমকির মুখে পড়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কর্মকাণ্ডে। কেএনএফ’র অত্যাচার নির্যাতনে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার অনেকগুলো গ্রামের পাহাড়ীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। সম্ভাবনাময় উপজেলাগুলোতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় পর্যটক শূণ্য হয়ে পড়েছে গোটা জেলা।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, হঠাৎ করেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা হিসেবে পরিচিত বান্দরবানকে অশান্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে কেএনএফ। বাইরের রাষ্ট্রের ইন্ধনে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনটি স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট আলাদা রাজ্য বানাতে চায় পার্বত্য চট্টগ্রামে।

একেএম জাহাঙ্গীর আরও বলেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে রুখতে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে, ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হবে সরকারকে। রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে দেশের নাগরিকত্ব ভোগকারী কারা জড়িত তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে।

এদিকে, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়া বম জনগোষ্ঠীর বিপদগামী সদস্যদের শান্তির পথে ফেরাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবজাতী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে উদ্যাগে নিয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদ।

এই প্রসঙ্গে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা গণমাধ্যমকে বলেন, শুধুমাত্র কেএনএফ নয়; পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে শান্তির পথে ফেরাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতীগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করেছি।

বম জনগোষ্ঠীর ষ্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি লাল থাক বম বলেন, বম জনগোষ্ঠীর বিপদগামী যুবকদের শান্তির পথে ফেরাতে আমরা কাজ করছি। এই বিষয়ে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র হলো পার্বত্য জেলা বান্দরবান। নেপথ্যে মূলত চাঁদাবাজি। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সংঘাত এবং অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজিতে থমকে গেছে পাহাড়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। পার্বত্যবাসীর নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করতে পাহাড়ে সন্ত্রাস বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের দাবী জানাচ্ছি।

পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল (কেএনএফ) এর সশস্ত্র শাখার নাম হলো কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। গত বছরের এপ্রিল মাসে সংগঠনটি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটির সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। গতব ছর তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে চলে যায়।

এই সংগঠনের প্রধান হলো নাথান বম। তিনি রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার অধিবাসী। নাথান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। রুমার এডেন পাড়ায় কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট
ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তবে বর্তমানে নাথান বম কোথায় আছেন, সেটি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও স্থানীয় নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবী, নাথান বম ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে।

এদিকে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আত্মপ্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করে। সংগঠনটি মূলত বম জনগোষ্ঠী নির্ভর হলেও তাদের দাবী, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। এগুলো হচ্ছে- বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো এবং খুমি।

কেএনএফ এর হত্যাযজ্ঞের কিছু চিত্র:

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এর সাথে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে কয়েক মাস ধরে। গত ১৩ই মার্চ সশস্ত্র সংগঠন কুকি চীনের হামলায় সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের মৃত্যু হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সৈনিক রাকিবুল ইসলাম ও সৈনিক শিশির আহমেদ আহত হন।

অপরদিকে কেএনএফ’র পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরক বিস্ফোরণে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সন্ত্রাসী বাহিনী পৃথকভাবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা’সহ নির্মাণ কাজের ১২ জন শ্রমিককে এ পর্যন্ত অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপন আদায় করে ছেড়ে দিয়েছে।

অপরদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটন স্পট বগালেকের রিসোর্ট ব্যবসায়ী লারাম বম কে অপহরণ করে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীদের তথ্যমতে, গত ১৬ই জুন রুমা উপজেলার দূর্গম পাইনুম পাড়াতে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করতে যাবার পথে ছিলোপি পাড়া এলাকায় কেএনএফ’র পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরক বিস্ফোরণে মোন্নাফ হোসেন রাজু নামে সেনাবাহিনীর এক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। এসময় মো: রেজাউল নামে সেনাবাহিনীর আরেক সদস্য আহত হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

এর আগে গত পহেলা জুন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার স্বার্থে অভিযানে গিয়ে ছিলোপি পাড়া এলাকায় কেএনএফ’র পুঁতে রাখা বিস্ফোরক আইইডি বিস্ফোরণে তুজাম (৩০) নামে এক সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়।

গত ১৭ই মে রাঙামাটির বিলাইছড়ি জারুলছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনাবাহিনীর রুমা ২৮ বীর জোনের সেনা সদস্যদের টহল টিমের উপরে গুলিবর্ষণে সেনাবাহিনীর ২ জন সৈনিকের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- মো: আলতাফ আহম্মদ এবং মো: তৌহিদ। এসময় সেনাবাহিনীর রুমা ২৮ বীর সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক আহম্মদ শওকত এবং আরেকজন সেনা কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিল।

গত ৮ই মে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে গোলাগুলিতে রোয়াংছড়ি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নেমথাং বম’সহ ৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

৭ই এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খামতান পাড়া এলাকা থেকে বম জনগোষ্ঠীর ৮ জনের লাশ উদ্ধার করে যৌথবাহিনী।

এর আগে ২৭ই এপ্রিল রুমা উপজেলার মুয়ালপি পাড়া এলাকা থেকে বম জনগোষ্ঠীর এক জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা সকলেই পাহাড়ের বম জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্য বলে জানা গেছে।