পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা

আবু রূশদ

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির সদস্য বলে পরিচিত একটি সশস্ত্র সংগঠন ব্যাংক লুট করেছে, পুলিশ-আনসারের অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে, থানচি বাজারে ঘটিয়েছে অঘটন। ঈদের আনন্দের মধ্যে সেখানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশকে ঘুম হারাম করে সতর্কাবস্থায় থাকতে হয়েছে। ১৯৯৭ সালে তদানীন্তন শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য এলাকা কখনো এমন অশান্ত হয়নি।
দীর্ঘ দুই যুগ সেখানে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলাকালে নিরাপত্তাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে অনেক। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর আশা করা গিয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিকভাবে বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যাম্পগুলোকে সঙ্গত কারণেই গুটিয়ে নেয়া হয়েছিল। যদিও পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সেখানে সব সেনা অবস্থান প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে অব্যাহতভাবে।

শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ চলাকালে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন যা এখন অনেক, অ-নে-ক জটিল। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ। পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকহারে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, চিকিৎসাকেন্দ্রসহ বিনোদন স্থাপনা প্রতিষ্ঠার পরও পার্বত্যবাসীর মন থেকে ক্ষোভ যায়নি। তাদের কথাবার্তা ও প্রচারণায় এটি সহজেই বোঝা যায়। বিষয়টি যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক তা বলাই বাহুল্য। তারা সেসব সমস্যার সামরিক কোনো সমাধান চান না। চাকমা, ত্রিপুরা, কুকি কোনো জনগোষ্ঠীই সেনা উপস্থিতিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। তারা এ নিয়ে সুস্পষ্টভাবেই মতামত প্রকাশ করছেন। তাদের অভিযোগের তীর এসে পড়ছে কেবল সেনাবাহিনীর দিকে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? সেনাবাহিনীই কি দায়ী সব ক্ষোভের জন্য? সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলেই কি পার্বত্য এলাকায় সুনসান শান্তি ফিরে আসবে?

আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ নিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার’ শিরোনামে একটি বই লিখেছি, সেই ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, শান্তিচুক্তি হওয়ার কয়েক মাস আগে। এই বইটি লেখার জন্য আমাকে সেনা প্রশাসনের সহায়তা নিতে হয়েছিল। তদানীন্তন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আমাকে পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ইউনিট ও ক্যাম্প পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সাথে মিলিটারি অপারেশন্স পরিদফতরে রক্ষিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল দেখার সুযোগ হয়েছিল অনুমতি সাপেক্ষে। ১৯৯৬ সালে প্রায় মাস ছয়েক লেগেছে বইটির মাল-মসলা সংগ্রহ করতে। অন্যদিকে মেজর জেনারেল ইবরাহিম, বীর প্রতীক পার্বত্য এলাকায় চাকরিকালে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেকটি বই লিখেছেন।

আমার বইয়ে দুই যুগব্যাপী যুদ্ধের তথ্য উপাত্ত বা রেফারেন্স সন্নিবেশ করেছি। সম্ভবত এটিই একমাত্র বই যাতে সামগ্রিক পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বইটি সে সময়কার বাস্তবতায় লেখা হলেও তা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। বইটি ছাপা হওয়ার পর যখন চট্টগ্রামের তদানীন্তন জিওসি মেজর জেনারেল এম এ মতিন, বীর প্রতীককে উপহার দিতে গিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘২৫-৩০ বছর পর তোমার বইটি যারা পড়বে তারা তখন আজকের ও আগের পরিস্থিতির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখতে পাবে। তবে ততদিনে পার্বত্য এলাকায় নতুন পরিস্থিতির জন্ম নেবে।’ মুক্তিযোদ্ধা জে. মতিন তা বুঝেছিলেন। শুনতে ভালো না লাগলেও এটিই সত্য যে, শান্তিচুক্তি হওয়ার পর সেনা প্রশাসন তা আর বুঝতে চায়নি।

বিস্ময়ের ব্যাপার, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সফল কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অপারেশন দুই যুগ ধরে পরিচালনা করলেও সেনা কর্তৃপক্ষ কখনো তাদের নিজ অফিসার ও সৈনিকদের অবদান, আত্মত্যাগ নিয়ে কোনো তথ্যভিত্তিক বই প্রকাশ করেনি। সাধারণ জনগণকে তারা তাদের নিজেদের ঘাম, রক্তের বিনিময়ে সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের কথা জানাননি। এ নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারিও কখনো তৈরি হয়নি।

আজকে যেসব জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকরা কর্মরত রয়েছেন তাদের কেউই হয়তো পূর্বসূরিদের পরিচালিত অপারেশনের কথা বলতে পারবেন না। কি জন্য, কিভাবে সেনাবাহিনী সেখানে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, কিভাবে দেশী-বিদেশী যড়যন্ত্র কাজ করেছে- সে সবের ইতিহাস তাই মুছে গেছে তাদের কাছে। জনগণ তো দূরের কথা, সেনা সদস্যরাও বলতে পারবে না শহীদ মেজর মহসিন কে? স্বাধীনতার পর অপারেশনাল খাতে পাওয়া একমাত্র বীর উত্তম লে. মুশফিক কে? ক্যাপ্টেন ইমরান কিভাবে শহীদ হয়েছিলেন? কেন পিসিজেএসএস অস্ত্র তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে? তারা আজ সাজেকে তৈরি সুরম্য রিসোর্টে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে পারে, চিম্বুক পাহাড় ডিঙিয়ে অনায়াসে থানচিতে তৈরি রেস্ট হাউজে চলে যেতে পারে, পার্বত্য এলাকার চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক পরিবেশ অবলোকন করতে পারে; কিন্তু তারা কি জানে ওই এলাকাগুলো আগে কেমন ছিল? কিভাবে সেনাবাহিনী সেখানে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, সাপখোপের অত্যাচার সহ্য করে হেঁটে পেট্রোলিং করে, জীবন দিয়ে যুদ্ধ করেছে? কোনো রেফারেন্স নেই। কোনো ব্যাটালিয়নের কোনো অপারেশনের বিবরণ কোথাও নেই। কেন? একটি রিসোর্ট তৈরির অর্থ কি ভালো একটি রেফারেন্স বই লেখায় ব্যয় করা যায় না? রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে একটি জাতীয় সেনাবাহিনী হিসেবে নিজেদের গর্বের বিষয়টিকে জানান দিতে সেনাবাহিনীর এত অনীহা কেন? সব তো হারিয়ে যাবে ইতিহাসের গহ্বরে আর ক’দিন পর!

এদিকে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, আনন্দ, বেদনা, বঞ্চনার কথা আমরাই বা কতটুকু জানি? জানলেও কি সেগুলোকে পাত্তা দিই? রাজনৈতিক নেতারা কতটুকু খেয়াল করেন? তারা কি পাহাড়িদের সাথে আন্তরিকতার সাথে মেশেন? তাদের বুঝতে চেষ্টা করেন? এটি তো বিগত শতকের সত্তর, আশি বা নব্বই দশক নয়। এটি একুশ শতক, যখন পৃথিবীর কৌশলগত অবস্থান পাল্টাচ্ছে ঝড়ের বেগে। এখানে তো পুরনো ধ্যান-ধারণা চলবে না। সবার কথাই শুনতে হবে, মানবাধিকার গণ্য করতে হবে, পাশের দেশে কোন কোন বিশ্বশক্তি কিভাবে প্রক্সি ওয়্যার চালাচ্ছে সেটি গণনায় নিতে হবে। আমরা নিচ্ছি না। আজ প্রায় সব পাহাড়ি জনগাষ্ঠীই বলছে যে, শান্তিচুক্তি ঠিকমতো বাস্তাবায়িত হয়নি, এ নিয়ে হতাশা বাড়ছে। আবার কেউ কেউ এটিও বলছে, শান্তিচুক্তির ধারাগুলো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। শান্তিচুক্তির সূচনা ও এর ধারা-উপধারা সেনাবাহিনী তৈরি করেনি; করেছেন রাজনীতিবিদরা, শেষমেশ সরকারি সিদ্ধান্তেই তা স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন তা নিয়ে যদি অসন্তোষ দানা বাঁধে তবে তার নিরসন করার দায়িত্বও রাজনীতিবিদদের, সেনাবাহিনীর নয়। সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সমস্যার সমাধান হতে পারে কি না ভাবতে হবে।

বর্তমানে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সোশ্যাল মিডিয়া এতটাই ব্যাপ্ত যে, কোনো এলাকায় একটি ক্ষুদ্র ঘটনা ঘটলেও তা তৎক্ষণাত বিশ্বের নজরে চলে আসে। একই সাথে আঞ্চলিক পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে। মিয়ানমারে চার শক্তির প্রক্সি ওয়্যার চলছে। সামরিক জান্তাকে সমর্থন করে আসছে চীন-রাশিয়া-ভারত অক্ষ। অন্যদিকে, গণতন্ত্রকামী জনতাকে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে। গঠিত হয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি। আমাদের সীমান্তের পাশে রাখাইনে চলছে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার জান্তার তীব্র লড়াই। ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত যেখানে ত্রিকোণে মিশেছে সেখানেই অবস্থান ভারতের সমস্যাসঙ্কুল প্রদেশ মিজোরামের। সেখানেও রয়েছে কুকি চিনের প্রাধান্য। টেকনাফ এলাকায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রতি দৃষ্টি রয়েছে পুরো বিশ্বের। পার্বত্য এলাকায় আবার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী কুকি সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ। গত বছর তাদের সশস্ত্র সংগঠনের সাথে ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনীর কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। কুকি চিনের নেতা নাথান বমকে গত বছরই দেখা গেছে খ্রিষ্টানদের তীর্থভূমি ভ্যাটিকানে। বিশ্বে ভ্যাটিকান অত্যন্ত শক্তিশালী একটি এনটিটি। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ সুদানে এদের ক্ষমতা সবাই দেখেছে।

ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী জাঙ্গল ওয়্যারফেয়ারে অত্যন্ত পারদর্শী ও শক্তিশালী। কিন্তু খ্রিষ্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুরে বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী অপারেশন পরিচালনাকালে তারা মাইনরিটি খ্রিষ্টানদের আবেগ-অনুভূতি, সমস্যা ধর্তব্যে নেয়নি। হাই হ্যান্ডেডনেস দেখা গেছে তাদের কৌশলে। ফলাফল হয়েছে, মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের তকমা নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছে ও পূর্ব তিমুর পরিণত হয়েছে স্বাধীন দেশে। দক্ষিণ সুদানেও ঘটেছে একই ঘটনা। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে দেখেছি, সুদানের সেনাবাহিনী পোড়ামাটি নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদানে জ্বালাও পোড়াও করেছে যত্রতত্র। কোনো অবকাঠামো থাকতে দেয়নি, কোনো উন্নয়ন হতে দেয়নি। ফলাফল- দক্ষিণ সুদান স্বাধীন খ্রিষ্টান দেশ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেনি সত্য, তবে বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই দাবি ওঠে- সেখানে কুকি চিন দমনে সেনাবাহিনীকে সব দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হোক। সব জায়গায় আবার সেনা ক্যাম্প তৈরি করা হোক। এটি একপেশে উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়। যারা এটি বলেন তারা বোঝেন না যে, ইস্যুটি জটিল ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ওদিকে রয়েছে। কোনো একটি জায়গায় যদি কোনো কারণে সেনাবাহিনীকে ব্যাকফুটে ফেলা যায় তাহলে পুরো সেনাবাহিনীকে বেইজ্জত হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। এ ক্ষেত্রে তাই রাজনৈতিক সমাধানই উত্তম।

গত কয়েক দিন আগে পার্বত্য এলাকা নিয়ে একটি টক শোতে ছিলাম। সেখানে পাহাড়ি একজন নেতা অঙ্কন চাকমা অভিযোগ করেছেন, সেনাবাহিনী সাজেকসহ বহু এলাকায় স্থানীয় পাহাড়িদের বাস্তুচ্যুত করে বিনোদনকেন্দ্র বা ব্যবসায়কেন্দ্র বানিয়েছে। অভিযোগটি গুরুতর। যদি এটি পরিপূর্ণ সত্য নাও হয়, তাহলেও এর তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষার স্বার্থেই।

বর্তমান প্রজন্মের সেনা সদস্যদের এটিও জানা দরকার যে, একসময় পাহাড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে তাদের পূর্বসূরিদের কী পরিমাণ ঝুঁকি নিতে হয়েছে, কেমন মেহনত করতে হয়েছে। আমি দুইবার সাজেক গেছি বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে চড়ে পত্রিকার জন্য রিপোর্ট করার উদ্দেশ্যে। তখন সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। খাগড়াছড়ি থেকে দুই-তিন দিন লাগত একটি পদাতিক পেট্রোল দলকে সাজেক পৌঁছতে। তৃতীয়বার সাজেক যাই ২০০৪ সালে যখন সড়ক তৈরি করছিলেন সেনা প্রকৌশলীরা। সেনাবাহিনীর একটি জিপে আরো দুই সাংবাদিকের সাথে গিয়েছিলাম সেবার। থানচি যাওয়ার সড়ক তৈরির কাজও তখন কেবল শেষ হয়েছে। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় হয়ে সেই নতুন পথেও সেবার গেছি থানচিতে। তখন ওখানে বলতে গেলে কিছুই ছিল না। এরপর আর পার্বত্য এলাকায় কখনো যাইনি। তাই সেখানকার রিসোর্ট কালচার বা বিনোদন ফোবিয়া নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই, আগ্রহও নেই। কিন্তু এসব বিস্তারে কি কখনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মতামত নেয়া হয়েছে? তাদের অভাব-অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে? যদি হয়েও থাকে তাহলে কেন ক্ষোভ- সেটি সেনাবাহিনীকেই বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ তারা জাতীয় সেনাবাহিনী, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শেষমেশ দায়িত্ব তো তাদের কাঁধেই বর্তায়। তখন আর কাউকে আশপাশে পাওয়া যায় না। তাই রাজনৈতিক চেতনার বাইরে গিয়ে জনগণের সেনাবাহিনী হওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার বৈকি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি ও ঢালাওভাবে সেনাবাহিনীকে দায়ী করা খুবই অন্যায় এবং অন্যায্য। সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশেই সেখানে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওই অঞ্চলে এত জাতিগোষ্ঠী রয়েছে যে, যদি সেখানে সেনাবাহিনী না থাকে তাহলে জাতিতে জাতিতে, দল- উপদলে, বিভিন্ন স্বার্থে যদি কখনো পরিস্থিতির অবনতি হয় তাহলে কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? এর উপর বিদেশী শক্তি যদি তাদের স্বার্থে সেখানে কোনো ঘটনা ঘটায় তাহলে তা সামাল দেবে কে? জননিরাপত্তা তো আছেই, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে কে? সেনাবাহিনী ছাড়া স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তা রক্ষা অসম্ভব। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বার্থেও সেনা উপস্থিতি দরকার। এমনিতেই পিসিজেএসএসের সাথে ইউপিডিএফের সম্পর্ক ভালো নয়। প্রায়ই এদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। কুকি চিন যদি অদূর ভবিষ্যতে আরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে তখন সেনাবাহিনী ছাড়া স্থিতাবস্থা কেউ রক্ষা করতে পারবে না। একই সাথে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা যেকোনো সম্ভাব্য বিপদও ধর্তব্যে রাখতে হবে। সেটি এক্সটারনাল থ্রেট। তবে, সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যে আস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে তা জরুরি ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দূর করা উচিত। পাহাড়িদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা দরকার। কোনো মাথা গরম পদক্ষেপ বা উসকানি সমস্যার সমাধান করবে না; বরং মানবাধিকার বিরোধিতার তকমাটা গায়ে লাগিয়ে দিতে পারে। সতর্কতা কাম্য। এগুলো স্পর্শকাতর বিষয়, তাই সহনশীলতা দরকার।

সার্বিক দৃষ্টিতে বলতে পারি, সেনাবাহিনীকে পার্বত্য এলাকায় থাকতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো অকুপেশন ফোর্স নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ। মারমা, চাকমা, লুসাই, বম, ত্রিপুরা, কুকি- সবাই বাংলাদেশী। এই সেনাবাহিনী তাদেরও, শুধু বাঙালির নয়। তবে কোনো জাতিগোষ্ঠীর জমি দখল বা তাদের সমস্যায় ফেলে শুধু মেজরিটির দোহাই দিয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া হোক, তাও আমরা চাই না।

লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক
nayadiganta