মূল হিজরি পঞ্জিকা চন্দ্রমাসের ওপর নির্ভরশীল। সৌর বছর ৩৬৫ দিন এবং চন্দ্র বছর ৩৫৪ দিন হওয়ায় সৌর বছরের চেয়ে চন্দ্র বছর ১১ দিন কম হয়। তৎকালীন বাংলায় কর আদায় সহজ করতে মূলত বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন। চন্দ্রবর্ষপঞ্জি বাংলা তথা ভারতে চাষাবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অসময়ে কর দেয়ায় দরিদ্র কৃষকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। প্রাথমিকভাবে বঙ্গাব্দের মাসগুলো নেয়া হয়েছিল সংস্কৃত থেকে এবং সে অনুযায়ী নামকরণ করা হয় ‘ফসলি সন’। পরবর্তীতে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ। সম্রাট আকবর তার সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এ জন্য ৯৬৩ হিজরি সন থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি সনের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এ জন্য বৈশাখ মাসকে বঙ্গাব্দ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। অনেকের মতে, রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ সালে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন।
যেকোনো জাতির খাদ্যাভ্যাস তার সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। বাঙালিদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি। এর অর্থ বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। বাংলাদেশের সর্বত্র যেমন ধান উৎপন্ন হয় অনুরূপ দেশের সর্বত্র বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এসব প্রজাতির একটি হলো ইলিশ। ইলিশ একটি সামুদ্রিক মাছ এবং এটি প্রজননের সময় মিঠা পানিতে এসে ডিম ছাড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছর প্রজনন করে থাকলেও সবচেয়ে বেশি প্রজনন করে বাংলা আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। আমাদের মৎস্য চাহিদার প্রায় ১২ শতাংশ মেটানো হয় ইলিশ মাছ থেকে। দেশে সাধারণত বর্ষাকালে নদ-নদীতে ইলিশ মাছের বিচরণ দেখা যায়। এ কারণে সে সময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। বর্তমানে সমুদ্র থেকে যান্ত্রিক ট্রলারে মাছ আহরণে সারা বছর সামুদ্রিক ইলিশ পাওয়া যায়; তবে এগুলো বর্ষাকালে নদ-নদীতে পাওয়া ইলিশের চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে থাকে।
বাংলার কৃষক আবহমানকাল থেকে সকালের আহারে বিশেষত গ্রীষ্মকালে যে খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত; তা পান্তাভাত। সাধারণত রাতে খাবার গ্রহণের পর যে ভাত অবশিষ্ট থাকে তা সকাল পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী রাখতে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পান্তাভাতের সাথে কৃষকরা সাধারণত রাতে খাওয়া পরবর্তী যেসব তরকারি অবশিষ্ট থাকে তা অথবা লবণ, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, শুঁটকি বা নারকেল বা মরিচ বা আলুভর্তা, পেঁয়াজ প্রভৃতি খেয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল ছাড়া বছরের অপরাপর সময় রাতে আহার-পরবর্তী যে ভাত অবশিষ্ট থাকে তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকায় পানি দেয়া আবশ্যক হয় না। এ ভাত কৃষকরা উপরোল্লিখিত তরকারি বা ভর্তা বা লবণ, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ প্রভৃতি দিয়ে খেয়ে থাকে। কৃষকদের গ্রীষ্মকালে মাঠে কাজ করার সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম নির্গত হওয়ার কারণে লবণ ও পানির অভাব দেখা দেয়। প্রাচীনকাল থেকে কৃষকরা পানিমিশ্রিত পান্তাভাত লবণ দিয়ে আহার করে ক্ষুধা নিবারণসহ শরীরের লবণ ও পানির অভাব পূরণ করে আসছে।
গ্রামাঞ্চলে অতীতে কৃষকদের মধ্যে যে দরিদ্রতা ছিল বর্তমানে তার অনেকটাই লাঘব হয়েছে। বর্তমানে গ্রামের অধিকাংশ কৃষকের বাড়ি বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসার কারণে এবং অনেকের বাড়িতে ফ্রিজের সংস্থান হওয়ায় এখন আর আগের মতো আহার-পরবর্তী যে খাবার অবশিষ্ট থাকে তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখার কারণে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তা ছাড়া বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদে ব্যাপকভাবে কলের লাঙলের প্রচলন হওয়ায় জমি চাষে অতীতের মতো হালের ব্যবহার একেবারে সীমিত হয়ে পড়েছে। কলের লাঙলের চাষে কৃষকের কায়িক পরিশ্রম না হওয়ায় শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় না। যার ফলে লবণ ও পানির অভাব ঘটার উপক্রম হয় না। আর তাই আগের মতো এখন কৃষকের পান্তা ভাত খাওয়ারও অবকাশ ঘটে না।
আমাদের দেশের কৃষক কখনো ভাতের সাথে ইলিশ মাছকে তাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেনি। কৃষকের ভাতের সাথে ইলিশ মাছ খাওয়াটা অনেকটা এর প্রাপ্যতা ও তাদের সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে। অতীতে যেমন কৃষক মাটির শানকিতে ভাত খেত এখন খুব কম কৃষক পাওয়া যায় যারা মাটির শানকিতে ভাত খাওয়ার অভ্যাস আঁকড়ে ধরে আছে। কৃষকের মাটির শানকিতে ভাত খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগের মূল যে কারণ তা হলো তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার অবসান।
আমাদের দেশ অতীতে যতটা না কৃষিনির্ভর ছিল বর্তমানে তা ক্রমহ্রাসমান। এর পরও দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী এখনো কৃষিকাজকে জীবিকার বাহন হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। আমাদের কৃষকের যে খাদ্যাভ্যাস তা-ই বাঙালির খাদ্যাভ্যাস। আমাদের দেশের জনমানুষের বাংলায় বসবাস এবং বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণেই তারা বাঙালি। বর্তমানে বাঙালি জাতি মুসলিম ও হিন্দু দু’টি পৃথক ধর্মাবলম্বী হলেও উভয়ের অতীত মাছে-ভাতে বাঙালি হতে বিচ্যুত নয়। সম্রাট আকবরের বাংলা এখন বিভাজিত হয়ে এর একটি অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা রাজ্য এবং অপরটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। উভয় বাংলার জনমানুষ পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করলেও অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতায় বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা রাজ্য থেকে এগিয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে গ্রাম-বাংলায় বৈশাখী মেলা আয়োজনের প্রচলন ছিল যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে গ্রাম-বাংলায় অতীতে কখনো গৃহস্থালি পর্যায়ে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হতো না; তবে পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠিত মেলায় দোকানিরা যেসব মিষ্টি জাতীয় খাদ্য যেমন জিলাপি, বাতাসা, কদমা, মুড়ি ও চিঁড়ার মোয়া, গুড় মিশ্রিত খই, খাজা, গজা প্রভৃতির পসরা সাজিয়ে রাখত মেলা থেকে ফেরার সময় প্রায় সবাই এগুলো নিজ গৃহে নিয়ে আসত এবং পরিবারসমেত খেত যার প্রচলন এখনো রয়েছে। ইদানীং পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে প্রতিটি শহরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায় উল্লিখিত খাবার ছাড়ও চটপটি, ফুসকা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, বিভিন্ন ভর্তাসমেত পান্তা-ইলিশ প্রভৃতির সমারোহ ঘটানো হয়।
অতীতে পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে নতুন জামাকাপড় কেনাকাটার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল না। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যায়, পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে বয়স নির্বিভেদে অনেকেই নতুন কাপড় পরে পয়লা বৈশাখ সংশ্লিষ্ট আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি লাভে সচেষ্ট।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের সমাজের সচ্ছল অনেক পরিবারের মধ্যে পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন- ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, ইলিশসহ রকমারি মাছ, মুরগি, খাসি ও গরুর গোশত, পিঠা-পুলি-পায়েস প্রভৃতির আয়োজনে পারিবারিকভাবে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবসহ পয়লা বৈশাখের এ দিনটিকে উদযাপন করতে দেখা যায়। কিন্তু পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের উদ্যোগে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এর প্রায় প্রতিটিতেই পান্তা-ইলিশের সরব উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর তাই পারিবারিক অনুষ্ঠানের পান্তা-ইলিশের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে এটির উপস্থিতি এখন অনেকটা লোকদেখানো আচার-অনুষ্ঠান।
একদা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পয়লা এপ্রিল দিনটিতে একে অপরকে বোকা বানানোর পাশ্চাত্যের একটি রীতির ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল। কী কারণে ইউরোপস্থ স্পেনে পয়লা এপ্রিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর চরম নির্মমতার বহিঃপ্রকাশে বোকা বানানোর ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল, এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি ও আলোচনায় সাধারণ জনমানুষের প্রকৃত সত্য জানার উপক্রম ঘটায় এ রীতিটি আজ আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে অনেকটাই নির্বাসিত। বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন এ দেশের সাধারণ জনমানুষের জীবনধারার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল কিছু তথাকথিত প্রগতিশীলের এমন দাবির কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। আর তাই পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে বছরের একদিন পান্তা-ইলিশ খাওয়া গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়ার নামান্তর বৈ আর কিছু নয়।
আমাদের দেশের শহুরে জনমানুষের একটি অংশের মধ্যে দেখা যায় পয়লা বৈশাখ এলেই দিনটি উদযাপনের জন্য তারা মাটির শানকিতে পান্তাভাত ও ইলিশসহ বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে দিনের আহারের সূচনা করে কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়ার প্রয়াস নিয়ে নিজেকে বাঙালির আদিরূপে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় নিমগ্ন হন। বছরের একটি দিন মাটির শানকিতে ইলিশ দিয়ে পান্তাভাত কৃষক খায়নি। এটি বাঙালির সংস্কৃতি নয়। আদি বাঙালিরা কখনো এ উপলক্ষে অতীতে মাটির শানকিতে ইলিশ দিয়ে পান্তাভাত খায়নি। আর তাই একটি বিশেষ দিনে শহরের এক শ্রেণীর জনমানুষের পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া কৃষক ও আদি বাঙালির চরিত্রের সাথে প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং এটিকে সংস্কৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে অপসংস্কৃতিকে সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিজেদের ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার বিসর্জন বলা যায়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
Nayadiganta