বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন ৩ ফেব্রুয়ারি। রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট দেশের নদীসমূহকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। নিউজিল্যান্ড, বলিভিয়া এবং ভারতে ইতোমধ্যেই এ জাতীয় রায় ঘোষণার নজির রয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সহায়ক হবে এবং নদী ও পানিসম্পদ রক্ষায় একটি সুদৃঢ় আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করবে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত উন্নয়নের ধারায় ভৌত কাঠামোগত বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই উন্নয়ন পরিক্রমায় টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি ১৯৮০-এর শুরুর দিক থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। যার সর্বশেষ রূপ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। অন্যভাবে বলা যায়, কেবলমাত্র ২০৩০ সাল পর্যন্ত নয় বরং ২১০০ সাল পর্যন্ত দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়— ‘আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। ২১০০ সালে বাংলাদেশকে যেভাবে গড়তে চাই সেভাবেই আমরা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি’।
প্রতিক্রিয়ায় ব্যারেজ, পোল্ডার এবং বাঁধসহ নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি রায়ের লঙ্ঘন বলা হয়েছে— যা রায় পর্যালোচনায় দেখা যায়, সমালোচকদের অতিশয়োক্তি। কে না জানে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জিডিপিতে কমপক্ষে ১% যোগ করবে। আর পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবকে ন্যূনতম রাখার লক্ষ্যে দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদরা কাজ করে যাচ্ছেন। যেকোনো উন্নয়নই প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে প্রভাবিত করে। কিছু ধ্বংস না করে বৃহত্তর সৃষ্টি সম্ভব হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ছাড়া উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হলো পরিবেশের ন্যূনতম পরিবর্তন বা ক্ষতি সাধন করে উন্নয়ন। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০তে ঠিক এ বিষয়টিতেই সবচেয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আলোচনাকারীদের মন্তব্য অনুযায়ী যদি মহামান্য হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের কারণে কোনো নদীর ওপর পরিবেশবান্ধব স্থাপনাও তৈরি না করা যায়, তবে তা অবাস্তব হবে বলেই মনে হয়। নিউজিল্যান্ড, বলিভিয়া বা ভারতে একইভাবে বাংলাদেশের আগে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণার পর নদীর ওপর সেতু বা অন্য কোনো অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেছে এমন নজির নেই। একপেশে মতামত প্রদানকারীদের বক্তব্য মেনে নিলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নদীর উপর গড়ে উঠা হাজার হাজার সেতু ধ্বংস করে দিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম ইঞ্চিয়ন ব্রিজ, মালয়েশিয়ার পেনাং ব্রিজ, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ব্রিজসহ নদীর উপর সকল রেল সেতু ও ব্রিজ ভেঙে দিতে হবে। যথাযথ সমীক্ষার পর যেকোনো প্রয়োজনীয় স্থাপনা অবশ্যই করা যাবে—যদি উন্নয়নকে স্থবির না করতে চাই। দ্রুততর যোগাযোগ এবং বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে জীবন-জীবিকা রক্ষায় নদী ও পানিসম্পদের সুষ্ঠু ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) কর্তৃক অনুমোদিত প্রায় শতবর্ষী ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’-এর অভিলক্ষ্য হল: “দৃঢ়, সমন্বিত ও সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল কার্যকরী কৌশল অবলম্ব্বন এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য ব-দ্বীপ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ”। অর্থাত্ দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলা করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ জলবায়ু অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ্বীপ গড়ে তোলাই এ পরিকল্পনার মূল উপজীব্য।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় জাতীয় পর্যায়ে দু’টি কৌশল স্থির করা হয়েছে। এর একটি হলো ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা’ অন্যটি হলো ‘স্বাদু পানির লভ্যতা’। অন্যদিকে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের মধ্যে অন্যদের সাথে ‘আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘গতিশীল আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা’ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, টেকসই নির্দিষ্ট কৌশলসমূহের সবকটিতেই পানিসম্পদ ও নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মকৌশল ও কার্যক্রম স্থান পেয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে প্রায় আড়াই বছর সময় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ যোগ্যতম ব্যক্তিদের নিয়ে ২৬টি গবেষণা সম্পাদন করা হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ২৬টি গবেষণার মধ্যে ১০টি গবেষণায় সরাসরিভাবে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, নদী ব্যবস্থাপনা, জলপথ পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট। পানিসম্পদের ব্যবহার; নদী ব্যবস্থাপনা; ভূ-গর্ভস্থ পানি; পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন; আঞ্চলিক সহযোগিতা; টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো; মেঘনা অববাহিকা উন্নয়ন; বাস্তুতন্ত্র, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের বিগত ৬০ বছরের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ রয়েছে গবেষণাগুলোতে।
সুষ্ঠু পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো— শুষ্ক মৌসুমে সেচ ব্যবস্থা ও পানির স্বল্প লভ্যতা। বরেন্দ্রসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরো চাষে শুষ্ক মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার অত্যধিক। আর এ জন্যেই সরকার অধিকতর হারে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় শুষ্ক মৌসুমে পানি ও সেচ ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচিত হয়েছে।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় মাত্র সাত ভাগ বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে হলেও এ অববাহিকার মোট প্রবাহের ৯৩ ভাগ এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মেশে। আর এ প্রবাহ মোট ১-১.৪ বিলিয়ন টন পলি বয়ে নিয়ে আসে। সমস্যার জায়গাটি হলো এ প্রবাহের সিংহভাগই হয় বর্ষা মৌসুমে। কাজেই শুষ্ক মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে যাকে কৃষিজনিত খরা বলা হয়। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকায় পানির চাহিদা এবং জোগানের ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
দেশে বিদ্যমান প্রাকৃতিক জলপথসমূহ পুনরুদ্ধারের জন্যও এ মহাপরিকল্পনায় বেশ কিছু কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেকেই জানেন, এ দেশে বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক জলপথের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কিলোমিটারে, যা শুষ্ক মৌসুমে কমে গিয়ে হয় প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী এ জলপথ ব্যবহার করে পণ্য ও যাত্রী পারাপারের বিষয়টি এ মহাপরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়েছে।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় কেবলমাত্র পানি ও নদী সম্পদ ব্যবস্থাপনাকেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি, একইসাথে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ইকোসিস্টেম সার্ভিসের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। কাপ্তাই পানি বিদ্যুত্ কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে কম খরচে আমরা বিদ্যুত্ পেয়ে থাকি। এটা ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব হাস্যকর। জলাভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
বন্যা ব্যবস্থাপনা ও স্বাদু পানির লভ্যতার বিষয়টি এ মহাপরিকল্পনায় ৩টি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলো, পরিবেশের বিপর্যয় না করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহায়ক কৌশল; প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতসহিষ্ণু বাংলাদেশ গড়ে তোলা; এবং সকলের অংশগ্রহণে জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত সহিষ্ণুতার ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন।
বন্যা ব্যবস্থাপনা ও স্বাদু পানির লভ্যতা নিশ্চিতকল্পে জাতীয় পর্যায়ে বেশকিছু কৌশল ও কার্যক্রম এ মহাপরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের বিদ্যমান জলাধার (খাল, পুকুর, বাঁওড়) পুনঃখনন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে পানি সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ; সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে রাবার বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন; আঞ্চলিক নদ-নদীগুলোর প্রবাহ বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ; নদী ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার এবং জীব-বৈচিত্র্যের গুরুত্ব প্রদান; এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ এবং সংরক্ষণ ইত্যাদি এ মহাপরিকল্পনায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।
বলা যায়, ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ দেশের পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করে অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অভিযাত্রার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের প্রণীত একটি সমন্বিত পথ নকশা। এতে নদী ও প্রকৃতিকে যতদূর সম্ভব তার স্বাভাবিকতায় রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় ‘প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস’, ‘স্বাভাবিক নদী প্রবাহের স্বাভাবিক সংস্থান’, ‘দূষণকারী কর্তৃক দূষণব্যয় প্রদান’, ‘পরে কোনো অনুশোচনা নয়’ এরূপ নীতি ও কার্যক্রম পালনের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান অনুসরণ করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪ বছর সময় নিয়ে স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি ধাপে দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের নীতি-নির্ধারকের অনুমোদনে চূড়ান্ত হওয়া এ মহাপরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন এখন মূল লক্ষ্য। সরকারি, বেসরকারি ও সুশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নের মাধ্যমে দেশকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সফল বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব), সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন