প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সোমবার
বিশ্বে আন-সাংকেবল প্রমোদযান টাইটানিক ও ফলোআপ টাইটান বিলীন হয়ে গেছে। দেশের টাইটানিকসম আওয়ামী লীগ সদলবলে সরে গেছে। এখন উপদেষ্টা সরকারও কি সে রকম জেদ ধরবে নাকি বাস্তবতা মেনে কাজ করবে? বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। বর্তমান অবস্থায় গরিষ্ঠজন চাচ্ছে দেশে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচন হউক। সত্যিকারভাবে দেশের কার্যকর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এ রকম একটি নির্বাচন অত্যাবশ্যক। সরকারও পরোক্ষ প্লাটফরমে তা বিশ্বাস করে বলে জানাচ্ছে (?)। তারপর? বর্তমান পরিস্থিতি রাজনীতিতে ‘যদি-কিন্তু-তবে’-এর ঘোরপ্যাঁচ ক্রমেই আরও প্যাঁচ খাচ্ছে, জুলাই আন্দোলন নেতাদের দাবি এখন ‘সনদ, ঘোষণা, ডিক্লারেশন, প্রোক্লেমেশন, ঐকমত্য সংস্কার, গণভোট, জনপরিষদ, পিআর, ইত্যাদি ইত্যাদি নামে সংজ্ঞাহীন অব্যাখ্যাত হিসাবে মুখে-কানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা দেশকে নির্বাচনের দিকে দৃঢ়ভাবে মনোযোগী করছে না। কিন্তু না, নির্বাচন একটা হতেই হবে। আমরা এখন পানিতে পড়ে আছি, নির্বাচনের পর পাড়ে উঠবো, জনগণের জন্য স্বাভাবিক কাজ শুরু হবে। যদি-কিন্তু-তবে’ যতই বিশ্বাস করি না কেন তারিখ বিহীন ঘোষিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অবিসম্ভাবী, তবে ৫১% নিশ্চিত নয়।
নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত যত শক্তই বলা হোক না কেন এর বিভিন্ন অপশন মাথায় রেখে দেশের অন্যান্য কাজ পাশে রেখে কেবল কৃষক স্বার্থ খাদ্যকৃষি (কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য) ও শিক্ষার্থী স্বার্থ শিক্ষার কার্যক্রম (শিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য) জোরদার রাখতে হবে। অনেকে বলবেন, আমিও বিশ্বাসী ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবেই। যদি না হয়? বিশ্বশ্রেষ্ঠ প্রমোদ জাহাজ টাইটানিক ছিল বিশ্বের ঘোষিত আন-সিংকেবল জাহাজ। অথচ প্রথম যাত্রায়ই ডুবেছে, ঘোষণা টিকে নাই। যুক্তরাষ্ট্রের সূক্ষ নিরাপত্তা টুইন টাওয়ার আক্রমণ নিরাপদ করতে পারে নাই। বলা যায় দুই হাজার চল্লিশ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে টাইটানিক শক্তিসম আওয়ামী লীগ দলকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে দেশ থেকে ভিন্ন দেশের আশ্রয়ে সরে যেতে হয়েছে। টাইটানিক আদলের আওয়ামী লীগ পতনের জন্য টাইটানিক পতনের মধ্যে বেশ মিল পাওয়া যায়, যার প্রভাবে বাংলাদেশের ড. ইউনূসের নির্বাচন অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে যা এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। টাইটানিক জাহাজের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন্ স্মিথ নিজের পছন্দের লোকদ্বারা ক্রুসদস্য মি. ব্লেয়ারকে বাদ দিয়েছিল, যে ব্লেয়ার জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার সময় জাহাজের বাইনোকুলার রাখা ড্রয়ারের চাবিটা পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিল। এই বাইনোকুলারটি হাতে পেয়ে তা ব্যবহার করতে পারলে ক্যাপ্টেন আগেই ধ্বংসাত্মক পাহাড়সম আইসবার্গটি দেখে শনাক্ত করে জাহাজের দিক-নির্দেশনা দিতে পারতো। টাইটানিক ডুবতো না। ড. ইউনূসের কর্মপরিকল্পনার বাইনোকুলারটি তার হাতে নাই? শেখ হাসিনা যাওয়ার সময় নিজের সিদ্ধান্তে তার অবস্থান ডাইনামিক করতে পদত্যাগ পত্র ও আপন বোনকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন (দেশে আর কেউ নাই)। এজন্য টাইটানিকের মতো সে নয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ডুবেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন দোলাচলের সন্দেহখাতে পড়ার অন্যতম কারণ হলো সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সিউডো-ডাইনামিক অবস্থান।

বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হলো- টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর তাকে ফলোআপ করার জন্য টাইটান’ নামে আরেকটি সমুদ্রযান তৈরি করে বিশেষজ্ঞ সহ টাইটানিকের অবস্থানের দিকে রওয়ানা হয়েছিল। তবে আজ পর্যন্ত সেই টাইটানেরও কোনো খবর পাওয়া যায় নাই। টাইটান টাইটানিককে রক্ষা করতে পারে নাই। প্রকৃতপক্ষে টাইটান তৈরি করা হয়েছিল টাইটানিককে উদ্ধার করার জন্য নয়, বরং পর্যটন ব্যবসার জন্য। এই কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো: বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কিছু দল ও ব্যক্তি ভিত্তিক সাপোর্ট বা ফলোআপ টাইটান তৈরি করে কাজ করছে, যেগুলো সাত-সতেরো দাবি তুলে সরাসরি নির্বাচনটি অনিশ্চিত করে চলেছে। পাঠকবর্গ অবশ্যই একটু চিন্তা করলেই একাধিক উদাহরণ স্মরণে পাবেন। তবে আমি বলবো এসব টাইটান নেতাদের অবশ্যই যৌক্তিক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ নির্বাচিত আদলের সরকার আমাদের লাগবেই। সেই সরকারের আদল নিয়ে একাধিক অপশনের সুযোগ নেয়ার চিন্তা করা যায়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব বিষয হল: টাইটানিক দুর্ঘটনা নিয়ে তৈরি বিশেষজ্ঞ তদন্ত টিম অনেক কারণ উদ্ঘাটন করেছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো সেকেন্ড ক্যাপ্টেনের মতে- আইসবার্গটি যখন একেবারে সামনে এসে গেছে তখন ‘হেডস-অন-কলিশন -ই’ ছিল তুলনামূলক সঠিক সিদ্ধান্ত। তাতে জাহাজের সামনের দিক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো, কিন্তু জাহাজটি ডুবতো না। ক্যাপ্টেন স্মিথ তা মানেন নাই। একই ভাবে ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে সেইফ রেখে শৃঙ্খলা বাহিনীকে হেডস-অন-কলিশন করতে বলেছিল কিন্তু শৃঙ্খলা বাহিনী সে কৌশলে রাজি হয় নাই। কিন্তু শিক্ষার্থী-জনতা হেডস অন কলিশনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার কলিশন হলে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কিছু সক্রিয় নেতার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ডুবতো না, টিকে যেত। লীগারদের দেশ ছেড়ে হয়তো পালাতে হতো না। বর্তমান অভিনেতা রাজনীতিবিদের নির্বাচন পিছানোর উছিলা এড়িয়ে নির্বাচনের শর্তবিহীন তারিখ ঘোষণা করা অন্তর্বতীকালীন মিশ্র সরকারের ফরজ হয়ে পড়েছে।
পাঠক মনে করতে পারেন ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করে সেই সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংকট সমাধানধর্মী বিল পাস করে সরকার চালু করা হয়েছিল। সেইমতে বর্তমানেও যদি সাবলীলভাবে নির্বাচন সময়মতো না হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে কার্যরত উপদেষ্টা সরকার সেনাসহ শক্ত মনোভাব নিয়ে যে ধারায় তিনি প্রধান উপদেষ্টা সেই রেফারেন্সে একটি লীগের ফ্রেম ওয়ার্ক তৈরি করে নির্বাচনের এই উদ্যোগটি নিতে পারেন। তখন উপদেষ্টা পরিষদকে টাইটানিক মনোভাব পরিত্যাগ করে সৎসাহস নিয়ে নির্বাচন বিরোধী এবং দেশি-বিদেশি অশুভ টাইটানদের সামনা-সামনি হতে হবে। এতে নির্বাচনের ফলাফল হতে পারে যে বহুসংখ্যক প্রার্থী (স্বতন্ত্রসহ) নির্বাচনে অংশ নেবেন, জিতেও আসবেন। তারপর সেই সংসদে দেশের স্বার্থে যাবতীয় বিল-পরিকল্পনা অনুমোদন করে নিতে হবে। পরবর্তীতে ট্রমাকাটা রেগুলার রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার কাজ চলতে থাকবে। ড. ইউনূস সরকারের একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্থান নিশ্চিত হবে। টাইটানিক-টাইটানের শিক্ষা আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনুক।