- মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
- ১৯ মার্চ ২০২২, ২০:২৩
পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দু’টি দেশ। একসময় পাকিস্তান আর সাবেক পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ মিলে ছিল পাকিস্তান নামে একটি পূর্ণরাষ্ট্র, যা ১৯৪৭ সালের দেশভাগে জন্মলাভ করে। ১৯৭১ সালে সেই পাকিস্তান ভেঙে টুকরো হয়ে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। চিরদিনের জন্য মুছে যায় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে সম্পর্ক ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করেন। সেদিনের বাস্তবতায় একটি নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় ঘটনাটিকে অনেকেই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেছিলেন। আবার সফরের পক্ষেও যুক্তি উপস্থাপিত হয়। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদসহ ভারত-সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করেন। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরের সরকারগুলো পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিয়ে যায়, তবে সেটি সীমিত পরিসরে। সেই সূত্রে ১৯৮০ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে এফ-৬ জঙ্গিবিমান ও কিছু ট্যাঙ্ক বিক্রি করে।
বর্তমান সরকারের সময় পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি নতুন মাত্রা লাভ করে। যেহেতু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই পাকিস্তান বিরোধিতার রাজনীতি করে এসেছে, তাই তার আমলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরির একটা আলাদা আবেদন থাকা স্বাভাবিক। গত ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত জং পত্রিকার উর্দু সংস্করণে বাংলাদেশে বিনিয়োগে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানানোর একটি খবর প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসানের বরাতে খবরটিতে বলা হয় : আমরা চাই, পাকিস্তান বাংলাদেশে উত্তরোত্তর বিনিয়োগ করুক। বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে পাকিস্তানিদের জন্য বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের ২০ জুলাই সাউথ এশিয়ান মনিটরের বাংলা সংস্করণে ‘বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসে পাকিস্তানের কূটনৈতিক উদ্যোগ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়- বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার লক্ষ্যে নীরবে প্রয়াস শুরু করেছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর সাথে পরিচিত কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, বর্তমান আঞ্চলিক পরিবেশ ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একই বছরের ২৩ জুলাই এশিয়ান মনিটরে ‘নীরব কূটনীতি : পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর বিরল ফোনালাপ’ শীর্ষক আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়- পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিজেদের মধ্যে নীরব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে। কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এই সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, বর্তমান আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশের কারণে দু’পক্ষ তাদের সমস্যাদায়ক সম্পর্ক শুধরে নেয়ার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সাথে বৈঠকে বসেন, যে উদাহরণ খুবই বিরল। এই বৈঠক নয়াদিল্লিতে অনেকের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে এবং সন্দেহের চোখে তারা ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখছে। বাংলাদেশ সরকার এই বৈঠককে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু সূত্র জানিয়েছে, এর পেছনে আরো অনেক বিষয় রয়েছে। অনেকের বিশ্বাস, ইমরান-হাসিনার যে টেলিফোন আলাপ হয়েছে, সেটি এ বৈঠকেরই ফল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে কথা বলেছেন। দুই দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে এটি বিরল অগ্রগতি, বিশেষ করে যখন দুই দেশই নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ‘পারস্পরিক আস্থা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গভীর করার ব্যাপারে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ প্রধানমন্ত্রী খানের অফিস থেকে দেয়া বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ভূমিকা। বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে আছে আজ অবধি। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বিষয়টি তো প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে ১৯৭৪ সালে যখন ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসেন।
১৯৭৪ সালের ২৯ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস Bhutto Regrets ÔCrimes’ of 1971 শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপে। পরের দিন অর্থাৎ ৩০ জুন তারা Bhutto Apologizes নামে আরেকটি খবর ছাপে। সেখানে বলা হয় : Prime Minister Zulfikar Ali bhutto of Pakistan last week asked forgiveness from the Bengali people for atrocities commited by the Pakistani Army during the struggle for independence. (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো গত সপ্তাহে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতার জন্য বাঙালি জনগণের কাছে ক্ষমা চান।) খবরের পরের দিকে লেখা হয় : In a dinner speech tonight Sheikh Mujib said, ÔLet us forget the enmity and bitterness of the past and inaugurate a new chapter of hope and prosperity for our peoples.
(আজ রাতে এক নৈশভোজের ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের শত্রুতা ও তিক্ততা ভুলে যাই এবং আমাদের জনগণের জন্য আশা ও সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায়ের সূচনা করি’) ভিন্নমতের কেউ কেউ বলছেন, এভাবে নয়, পাকিস্তান সরকারকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবে। আমাদের মনে হয়, বৃহত্তর স্বার্থে এবং বাংলাদেশের কৌশলগত দিক বিবেচনায় এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে হবে আমাদের। কারণ সাবধান থাকতে হবে, তরকারি বেশি সিদ্ধ কি কম সিদ্ধ- সেই বিতর্কের ছায়ায় ধান্ধাবাজ তৃতীয় শক্তি যেন সব আত্মসাৎ করতে না পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সে জাতীয় হোক বা আন্তর্জাতিক, কৌশলগত কারণে অনেক অগ্রসর এবং বাস্তবভিত্তিক। পেছনকে আঁকড়ে থাকার সংস্কৃতি এখনকার দিনে অচল। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যারা অধিকতর কুশলী ও কৌশলী থেকে দ্রুত কূটনৈতিক পথে চলতে সক্ষম- তারাই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে সমর্থ। ঠিক এখানটায় বলা যায়, পাকিস্তানের কূটনীতি ভারতের চেয়ে অধিক প্রাগ্রসর। ভারত যেখানে তার পশ্চাৎপদতার বেড়া ডিঙ্গাতে ব্যর্থ; জটিল আমলাতান্ত্রিক বাধা পেরুতে অক্ষম, সেখানে পাকিস্তান বেড়া ডিঙ্গিয়ে এগোনোতে সফল। তাই আজ পাকিস্তান জড়তা ভেঙে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়তে উদগ্রীব; বাংলাদেশ সেখানে দূরে থাকতে পারেনি। ভারত যদি বিষয়টিকে বুঝতে সক্ষম না হয়, সাদামাটাভাবে বলা যায়, সে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের মাঠে টিকতে পারবে না। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী; তাদের সাথে সম্পর্ক স্থায়ীভাবে গরমিল থাকবে- তা মোটেও আমাদের কাম্য নয়। তাদেরকে বড় ভাইসুলভ আচরণ ও ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে গিলে খাবার নেহরু তত্ত্ব (ঘবযৎঁ উড়পঃৎরহব) থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই ভারত আধুনিক কূটনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষম হবে। নিঃসন্দেহে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় যে অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে- তা সফল হলে অবধারিতভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে উদার ও বাস্তববাদী রাজনীতির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হবে। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা অন্তত এ বিষয়ে ধন্যবাদ আদায় করতে পারেন। অন্তত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলতে পারবেন, তার মরহুম বাবা ১৯৭৪ সালে যে সম্পর্ক স্থাপনের সূচনা করে গেছেন, তিনি সেটিকে এগিয়ে নেয়ার গুরুদায়িত্ব বহন করছেন।
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের স্বাভাবিক বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কি একান্তই দরকার? প্রশ্নটি বাস্তববাদীরা করতে পারেন না। কারণ পিপাসায় যখন ব্যক্তি কাতর হয়, তখন পানি কি একান্তই দরকার- এমন প্রশ্ন অবান্তর বৈকি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রমূল্য বুঝতে প্রয়োজন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভ‚রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব উপলব্ধিতে নেয়া। বাংলাদেশের জন্য এখন পাকিস্তান-চীন-আফগানিস্তান-তুরস্ক সংযোগ বা কানেকশন খুবই জরুরি। বলাবাহুল্য, তালেবানের ক্ষমতায় আসায় কানেকশনটির গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। আফগানিস্তানে ঢুকতে হলে পাকিস্তানের প্রয়োজন। সবাই একমত, আগামীর আফগানিস্তান হবে বিদেশীদের জন্য বিশাল শ্রমবাজার ও বিনিয়োগক্ষেত্র। এখানে আগেভাগে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলে আমাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। এরপর আছে চীন ও তুরস্ক। চীন তো আছেই, তুরস্ক হতে পারে আমাদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও উন্নয়ন সহযোগী বা পার্টনার। সর্বোপরি ভাবতে হবে, পাকিস্তান এখন সামরিক শিল্পে উদীয়মান একটি দেশ; রফতানি করছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বিশেষত- আধুনিক যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্ক। সব কিছু মিলিয়ে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গড়া এখন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাস পয়েন্ট।