পাকিস্তানে কারাবন্দী ইমরানের পক্ষে জনগণের ভোটবিপ্লব

দল হিসেবে নির্বাচন করতে পারেনি ইমরান খানের পিটিআই। ইমরান নিজেও কারাবন্দী। এরপরেও নির্বাচনে অবাক করে দিয়েছেন ইমরানের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
দল হিসেবে নির্বাচন করতে পারেনি ইমরান খানের পিটিআই। ইমরান নিজেও কারাবন্দী। এরপরেও নির্বাচনে অবাক করে দিয়েছেন ইমরানের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।ফাইল ছবি: এএফপি

 

পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল দেখে দেশটির মানুষ বিস্মিত। সে বিস্ময়ের জন্মদাতাও আবার তাঁরাই। চূড়ান্ত কোণঠাসা অবস্থায় নির্বাচন করেও ইমরান খানের সমর্থক ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা প্রাথমিক ফলাফলে এগিয়ে আছেন। আবার একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব দেখে মানুষ বিক্ষুব্ধ। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, পিটিআইয়ের সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আদৌ জিততে দেওয়া হবে কি না।

বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে সম্ভাব্য সরকার গঠন নিয়েও। যেহেতু ইমরান খানের সমর্থকেরা কোনো নির্দিষ্ট প্রতীকে নির্বাচন করেননি, সে কারণে কীভাবে, কোন দলীয় পরিচয়ে এই সরকার গঠিত হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন—সেসব বিষয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ জনতা নিজেরাই যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তার পরিণতি তাদের জানা নেই।

পাকিস্তানের এ অবস্থার সঙ্গে অনেকখানি মিল পাওয়া যাচ্ছে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার গণ-আন্দোলনের, যখন জনতা দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের প্রাসাদ থেকে তাড়াতে পারলেও সে বিজয়কে গঠনমূলক কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারেনি।

ভোটের ফল আটকে রাখা হয়েছে যেভাবে

বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পরও আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ধেক আসনের ফলও পাওয়া যায়নি।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলাফলের নানান তথ্য-উপাত্ত ছড়িয়ে পড়েছে—যাতে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহেরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইয়ের সমর্থক প্রার্থীদের বিপুলসংখ্যায় বিজয়ী দেখা যাচ্ছে।

হতবাক হয়েছে পিটিআইও

ভোটের দিনের আগপর্যন্ত ইমরান খানের দল পিটিআই বলেছে, তারা যদিও এই ভোটে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের এই অভিমত মিথ্যা ছিল না। দল হিসেবে তাদের নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি।

তাদের নেতা ইমরান খানকে ভোট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ২৪ বছর কারাদণ্ডের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে এত সব বাধা পেরিয়ে পিটিআই এখন নির্বাচনী ফলাফলের গতি দেখে উল্লসিত। তীব্র ঠান্ডার মধ্যে রাতেও তাদের সমর্থকদের রাস্তায় আনন্দ-ফুর্তি করতে দেখা গেল।

সামগ্রিকভাবে মনে হয়েছে, জনগণ বিপুল হারে ভোট দিয়েছেন এবং সেটা পিটিআইয়ের দাঁড় করানো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে গেছে। সেনাবাহিনী, সেনাসমর্থিত নির্বাচনকালীন সরকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, পিটিআইসহ সবাইকে বিস্মিত করেছেন সাধারণ ভোটাররা।

এখন প্রাথমিক ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী ফলাফলে হস্তক্ষেপ না করলে ইমরান–সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন। শুক্রবার ভোরে প্রথম ঘোষিত তিনটি আসনই পেয়েছেন এ রকম স্বতন্ত্ররা।

ইমরানের অনুপস্থিতিতে যিনি এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, সেই গওহর খান বলছেন, তাঁদের স্বতন্ত্ররা ভোট হওয়া ২৬৫ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে এগিয়ে আছেন।

কিন্তু এই স্বতন্ত্ররা বহু মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। এর ফলে সুযোগ পেলে তাঁরা কার নেতৃত্বে, কীভাবে সরকার গড়বেন, সেটাও এই মুহূর্তে বড় এক ধাঁধার বিষয় হয়ে আছে।

ইমরান–বিরোধীরা যা বলছেন

ফলাফলের প্রাথমিক প্রবণতায় পিটিআইয়ের জয় দেখা গেলেও নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ বলছে, তারাই কেন্দ্রে ও পাঞ্জাবে সরকার গড়তে যাচ্ছে। নওয়াজের মেয়ে সে রকমই এক বিবৃতি দিয়েছেন।

এই দাবির ভিত্তি খুঁজে পেতে নিশ্চিতভাবে ফলাফলের পরবর্তী অধ্যায় দেখতে হবে। তবে সিন্ধুতে অতীতের মতোই পিপলস পার্টিকে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ইমরানের দল পিটিআই বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকবে বলে লক্ষণ বলছে। বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত।

নির্বাচন কমিশন যা বলছে

চলতি নির্বাচনকালে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন নিয়ে জন–আস্থার ব্যাপক ঘাটতি ছিল। ভোট শেষ হওয়ার ৯ ঘণ্টা পর তারা প্রথম ফলাফল ঘোষণা করতে সক্ষম হয়। ভোট হওয়া ২৬৫ আসনের মধ্যে ভোর চারটা পর্যন্ত মাত্র ৩টি আসনের ফলাফল ঘোষণা হয়।

এ রকম বিলম্বের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। অজুহাত হিসেবে দেখানোর মতো ভোটের আগে-পরে দেশজুড়ে কোনো সহিংসতাও নেই।

ফলাফল ঘোষণার ব্যাখ্যাহীন বিলম্বে স্বাভাবিকভাবে ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে। মানুষ এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না, ব্যালট পেপারে তাঁরা যা বলে এসেছেন, ভোটের ফলে সেটার পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটবে।

এ অবস্থা পাকিস্তানের নির্বাচনী আইনেরও লঙ্ঘন। সেখানে ১৩ (৩) ধারায় রিটার্নিং অফিসারদের জন্য ভোট হওয়ার পরদিন সকাল ১০ টার আগে প্রাথমিক ফলাফল সংকলিত করার বাধ্যবাধকতা আছে।

মানুষের সন্দেহের মুখে সশস্ত্র বাহিনী

নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। তবে বারবার ইন্টারনেট–ব্যবস্থা কেন কাজ করছে না, সে বিষয়ে কোনো তরফে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় স্ববিরোধী নানান ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

মানুষ অবশ্য ভাবছেন, এসবই ঘটছে সেনাবাহিনীর ইঙ্গিতে, যারা মুসলিম লিগ নেতা নওয়াজ শরিফকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছিল বলে নির্বাচনের আগে ইঙ্গিত মিলেছে। তবে এখন সেটা দুরূহ হয়ে গেল।

ভোটের ফলাফল পাল্টে সে রকম কিছু ঘটানো হলে শুরু থেকে নওয়াজকে ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে এবং সম্ভবত তৃতীয় প্রধান দল পিপলস পার্টি সেই সরকারে যুক্ত হবে না। এর ফলে এ রকম একটা সরকারকে টিকে থাকার শর্ত হিসেবে পুরোপুরি সেনা সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে।

আমেরিকার জন্যও এই ফলাফল বিব্রতকর

চূড়ান্ত ফল যেটাই ঘোষিত হোক, আপাতত যা স্পষ্ট, তা হলো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নেতা হিসেবে ইমরান খানকেই পছন্দ করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে এটা আমেরিকার জন্য কিছুটা বিব্রতকর হয়েছে।

ইমরানের পদচ্যুতি ও বন্দিত্বের ঘটনাবলিতে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে তারা গত কয়েক মাসজুড়ে নীরবে সমর্থন দিয়েছে বলেই মনে হয়েছে।

এখন পিটিআইয়ের সমর্থকদের জাতীয় পরিসরে যেকোনোভাবে ফিরে আসার মানে হবে ইমরানের কারামুক্তি। স্বভাবত তখন রাজনীতিতে চালকের আসনে থাকবেন তিনি এবং আমেরিকার সঙ্গে দেশটির টানাপোড়েনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। একই অবস্থা তৈরি হতে পারে বর্তমান সেনা নেতৃত্ব ও ইমরানের মধ্যেও, যা পাকিস্তানকে নতুন করে তীব্র এক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংকটে ফেলবে।

পাকিস্তানের অনিশ্চয়তায় বার্তা আছে অন্যদের জন্যও

পাকিস্তানের এবারের ভোটে ৪ লাখ ৬৫ হাজার পুলিশ ও ১ লাখ ৩৭ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ভোটে সহিংসতা হয়েছে সামান্যই। কিন্তু এত নিরাপত্তায় হওয়া এই ভোটও দেশটিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে না পারার ভেতর আশপাশের সব দেশের জন্য গুরুতর এক বার্তা রয়েছে। সেই বার্তা হলো নির্বাচনী গণতন্ত্রে একবার দুর্নীতিপূর্ণ হস্তক্ষেপ ঘটে গেলে তা থেকে একটা দেশকে সহজে বের করে আনা যায় না।

পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন থেকে প্রধান একটা দলকে সরিয়ে রাখার ক্রমাগত বিপুল চেষ্টা এবং প্রশাসনিক চাপে ম্রিয়মাণ এক প্রচারণার মধ্যেও হতাশ ভোটাররা বিপুলভাবে কেন্দ্রে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সজীব রাখতে চাইছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নেতিবাচক ভূমিকায় সেটা হয়ে উঠছে না।

এর ফলে পাকিস্তানে আসন্ন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দায় মূলত সেখানকার সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ঘাড়েই বর্তায়। পাশাপাশি এ রকম প্রশ্নও ওঠে, ভোটবিপ্লবের বাইরে আর কোন উপায়ে এ রকম ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে? চলতি ভোটবিপ্লব ছিনতাই হয়ে গেলে ইমরানের দলই–বা কী করবে?