দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় এখন পর্যন্ত গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে তিনটি। এখানে গ্যাসের মোট উত্তোলনযোগ্য মজুদ আবিষ্কার হয়েছে ১ হাজার ২১৭ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এর মধ্যে একটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করে স্থানীয় শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। গত জুন পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, ভোলায় এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মোট মজুদ ১ হাজার ৭৫ বিসিএফ। বাজার দর হিসাব করে দেখা গেছে, মজুদ এ গ্যাসের মূল্য ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ভোলায় গত তিন দশকে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে তিনটি। তবে অর্থনৈতিক মুনাফাযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থেকে এসব ক্ষেত্রের গ্যাস মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা গেলে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে তীব্র হয়ে ওঠা গ্যাসের সংকট মোকাবেলায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারত। সরকার ভোলা থেকে বরিশালে সরবরাহের জন্য গ্যাসের একটি সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও এখনো তা প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে।
এ অবস্থায় দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। এক্ষেত্রে এলএনজির দাম নির্ধারিত হচ্ছে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার ব্রেন্টের মূল্যের ভিত্তিতে। এজন্য প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির (১ এমএমবিটিইউ = ১ হাজার ঘনফুট গ্যাস) দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে ব্রেন্টের ব্যারেলপ্রতি মূল্যের ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ ধরে (কাতার থেকে এলএনজির চুক্তি অনুযায়ী)। এর সঙ্গে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আরো ৫০ সেন্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্টের দাম এখন প্রতি ব্যারেল ৮৭ ডলারের কিছু বেশি। সে অনুযায়ী প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ১১ ডলার ৪৬ সেন্টের কিছু বেশি। এ হিসাবের ভিত্তিতে ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রগুলোয় বর্তমানে মজুদকৃত গ্যাসের মোট মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ২৩২ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার ডলারে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার = ১১০ টাকা) হিসাব করলে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার বেশিতে। যদিও দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোলায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত মূল্য এর চেয়েও অনেক বেশি।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে শাহবাজপুরে এখন গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ আছে ৪৯৯ বিসিএফ। এছাড়া ভোলা নর্থ ও ইলিশায় উত্তোলনযোগ্য মজুদ আছে যথাক্রমে ৪৩৫ ও ১৪০ বিসিএফ। গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে এখন উত্তোলন চলছে শুধু শাহবাজপুরে। বাকি দুটি গ্যাস ক্ষেত্র উৎপাদনে আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখনো গ্যাসের অর্থনৈতিক মূল্য বুঝে উঠতে পারেনি। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে তুলনামূলক অনেক স্বল্পমূল্যে গ্যাস কিনে গ্রিডে সরবরাহ করতে পারছে সরকার। পেট্রোবাংলাও নিজের সাবসিডিয়ারি হিসেবে পরিচালিত উত্তোলন কোম্পানিগুলোকে গ্যাসের মূল্য হিসেবে যা পরিশোধ করছে, তা আসলে উত্তোলন খরচ। গ্যাসের প্রকৃত মূল্য হিসাব করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বা স্পট মার্কেটে এলএনজির দামকে বিবেচনায় নিতে হবে।
ভোলার গ্যাস আবিষ্কারের পর প্রায় তিন দশক পার হয়েছে। যদিও এ গ্যাস ব্যবহার নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোলার গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনা না গেলে সেখানে শিল্প-কারখানা করে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে পাইপলাইন করে গ্যাস গ্রিডে আনার চিন্তাটা আরো আগেই করা দরকার ছিল। সেক্ষেত্রে অনেক আগেই এ গ্যাসের লাভজনক ব্যবহার নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা যেত। এখন পাইপলাইনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, সে অর্থ সরকারের কাছে আছে কিনা, কিংবা বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ করলে এ গ্যাস বিক্রি করে পাইপলাইনের খরচ তোলা যাবে কিনা, এসব বিষয় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে দেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক বিষয় চিন্তা করলে সরকার নিজে বিনিয়োগ করে এ গ্যাস গ্রিডে যুক্ত করতে পারে। তাতে গ্যাস খাতের সংকট কিছুটা হলেও কমবে।’
বাপেক্স কর্মকর্তাদের দাবি, ভোলায় এখন পর্যন্ত যতটুকুর হদিস পাওয়া গেছে, গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য প্রকৃত মজুদ এর চেয়ে অনেক বেশি। অনুসন্ধান চালালে গ্যাসের মজুদ পরিসংখ্যান আরো স্ফীত হবে। বর্তমানে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক উত্তোলন হচ্ছে ৫৫-৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এ গ্যাস সেখানকার কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা ও কিছু আবাসিক গ্যাস ব্যবহারকারীকে সরবরাহ করা হচ্ছে। সেখানে বর্তমানে দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। বাকি দুটি গ্যাস ফিল্ড উৎপাদনে এলে ভোলা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ দেয়া সম্ভব বলে জানান বাপেক্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
দেশে গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে বিতরণ কোম্পানির ইনটেক পয়েন্ট পর্যন্ত গ্যাস পরিবহন (সঞ্চালন) করে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য পাইপলাইন নিয়ে কাজ করছে জিটিসিএল। শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বরিশাল পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও কোম্পানিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। এটি শেষ হলে ডিপিপি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়া হবে।
জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোলা থেকে বরিশাল পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে। এখানে অনেকগুলো নদী রয়েছে। ফলে কোন রুট দিয়ে এ পাইপলাইন করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে, সমীক্ষায় তা দেখা হবে। এরপর প্রকল্পের বিষয়ে সরকারকে প্রস্তাব দেয়া হবে। প্রকল্পের জন্য বিদেশী অর্থায়নও খোঁজা হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্পে জিটিসিএল বা সরকারের একার পক্ষে এ ব্যয় বহন করা কঠিন।’
জিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ভোলার গ্যাস উত্তোলনে শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাস ফিল্ড থেকে লাহারহাট হয়ে বরিশাল পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালনে একটি পাইপলাইনের পরিকল্পনা করেছে জিটিসিএল। এ প্রকল্পে ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুলাই পর্যন্ত নির্ধারণ করা রয়েছে।
ভোলায় এখন আরো পাঁচটি কূপ খননের জোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে পেট্রোবাংলা। এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করবে রুশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম।
বাপেক্সের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাঁচটি কূপ খননে গ্যাজপ্রম কাজ পাচ্ছে এটি নিশ্চিত। এখন তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কারিগরি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। তারা পাঁচটি কূপ খননে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চেয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে মূল্য প্রস্তাব কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে প্রকল্পের খরচ আরো বাড়তে পারে।’
ভোলায় গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ ১ হাজার ২০০ বিসিএফ। বাপেক্সের দাবি সেখানে মজুদ প্রায় দুই টিসিএফ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোলায় ঠিক কতটুকু গ্যাসের মজুদ রয়েছে, সেটি আরো ভালোভাবে সমীক্ষা হওয়া দরকার।
জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোলায় যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া গেছে, সেখানে পাইপলাইন করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে কিনা; বিষয়টি নিয়ে এখনো সংশয় রয়েছে। এছাড়া পাইপলাইনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, সেটির কীভাবে সংস্থান হবে এ বিষয়েও এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থায়ন খোঁজা হচ্ছে। বর্তমানে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হচ্ছে। এরপর সিদ্ধান্ত হবে।’
ভোলার ইলিশায় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। এ গ্যাস ক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য ১৪০ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। ভোলায় ভবিষ্যতে আরো গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই সরকার সেখানে বাণিজ্যিকভাবে পাইপলাইন করে গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনার চেষ্টা করছে।
Bonik Barta