ওলেগ ইয়ানোভস্কি
এ বছরের ৩১ মার্চ রাশিয়া তাদের নতুন পররাষ্ট্রনীতি প্রকাশ করেছে। এশিয়ার দ্রুত প্রবৃদ্ধি দেখে রাশিয়া অনেক আগেই প্রাচ্যমুখী হতে শুরু করে। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিতে এর স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়ার জন্য এ ঘটনা যুগান্ত সৃষ্টিকারী বাঁকবদল; কিন্তু এর ফলে এশিয়াতেও ক্রমশ বস্তুগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে।
পররাষ্ট্রনীতিতে কোন অঞ্চলকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে রাশিয়া। রাশিয়া তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় পশ্চিমকে আগের অবস্থান থেকে নামিয়ে দিয়েছে। কেবল অ্যান্টার্কটিকায় পশ্চিমের নিচে রয়েছে। পশ্চিমের বিষয়ে রাশিয়া যে তার নীতি পুরো ১৮০ ডিগ্রি বদলে ফেলছে, এ ঘটনা তারই ইঙ্গিত। মস্কো এবারের পররাষ্ট্রনীতিতে পশ্চিমের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু সেই বল এখন পশ্চিমাদের ঘরে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর পরেই আর্কটিক অঞ্চলের দেশগুলো কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়ার অগ্রাধিকার পেয়েছে। এবারই প্রথম রাশিয়া নর্থ সি বা উত্তর সাগরের ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনা পরিষ্কার করল। উত্তর সাগরে রাশিয়ার প্রবেশ চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে করে ভূ-অর্থনৈতিক বাধাগুলো অনেকটাই অপসারণ হবে এবং চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পণ্য বিনিময়ব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে।
আর্কটিক মহাসাগর বিশ্বের সর্ব উত্তরের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব-বিরোধেরও একটি বিষয়। পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে এ দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। রাশিয়া একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ পথ খুঁজলেও নিকট ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সেটা ঘটার দৃশ্যমান সম্ভাবনা নেই।
মস্কোর আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও এশিয়ায় এখন পর্যন্ত রাশিয়ার উপস্থিতি অনেক কম। এশিয়ায় নোঙর গাড়ার জন্য এক দশকের বেশি সময় ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে আসছে রাশিয়া। এশিয়া রাশিয়ার কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এশিয়ার দিকে রাশিয়ার অবস্থান বদল পর্যায়ক্রমে, নির্দিষ্ট খাতে ও অল্প কয়েকটি দেশ দিয়ে শুরু হলেও সেটা দিন দিন আরও গভীর ও বিস্তৃত হবে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তৃতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে চীনকে প্রথম এবং ভারতকে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছে রাশিয়া। মস্কোর কাছে চীনের গুরুত্ব অনিবার্য, গভীর ও স্থায়ী।
ভারতের ক্ষেত্রেও তা–ই। ভারত স্বাধীন হওয়ার পাওয়ার পর থেকেই নয়াদিল্লি-মস্কো সম্পর্ক শক্তিশালী সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সামরিক ও অর্থনৈতিক দুই খাতে সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যৌথ সহযোগিতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
বৈশ্বিক ফোরাম থেকে মুখ ফিরিয়ে আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। কোয়াড, চিপ-৪, এইউকেইউএসের মতো পশ্চিমা আধিপত্যে পরিচালিত জোটে এ অঞ্চলের দেশগুলো যুক্ত হয়েছে, রাশিয়াও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতি নিয়েছে। এই কৌশলনীতি চীনের নীতিনির্ধারকদের কৌশলনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্ধেকসংখ্যক নীতিনির্ধারকও একই নীতির কথা বলছেন।
এরই মধ্যে ১৯টি রাষ্ট্র ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর বেশির ভাগ দেশই দক্ষিণ বিশ্বের। এ থেকে প্রমাণিত হয়, বৈশ্বিক নয় বরং আঞ্চলিক ধরনের ফোরামের পক্ষে রাশিয়ার কৌশলনীতি ভবিষ্যতে জিততে চলেছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে অর্থনীতিকে সবার আগে স্থান দেওয়া হয়েছে। রাশিয়া তার অর্থনৈতিক দৃষ্টি এশিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলো দ্রুত উন্নতি করছে, সেসব দেশেই মূল মনোযোগটা কেন্দ্রীভূত করছে।
অবশ্য রাশিয়া-এশিয়া সংযুক্তি মস্কোর এবারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্কের অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সাইবেরিয়া পাইপলাইন, ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ে এবং নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডরের মতো প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়।
এ ধরনের অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলো রাশিয়ার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে। নতুন বাজারগুলোর ক্ষেত্রে যেখানেই রাশিয়ার জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেখানেই নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছে রাশিয়া। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। দৃষ্টান্ত হিসেবে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সম্পাদিত ট্রান্সমাশহোল্ডিং কো–অপারেশন চুক্তির কথা বলা হয়েছে। এই প্রকল্পে এরই মধ্যে ট্রেন উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে।
রাশিয়ার জ্বালানি, পণ্য ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জ্বালানি ঘাটতিতে পড়া দেশগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভালো একটি দৃষ্টান্ত হলো, ভারত। তারা এখন রাশিয়ার জ্বালানি তেলের অন্যতম প্রধান ক্রেতা।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোনো মতাদর্শ না থাকলেও দেশটির অনেক মানুষ প্রথাশ্রয়ী ও রক্ষণশীল। রাশিয়া তার জনগণের চিন্তাকে রক্ষা করে। পশ্চিমারা এটিকে প্রতিক্রিয়াশীলতা হিসেবে বিবেচনা করে। পশ্চিমা মূল্যবোধ খোলাসা হয়ে পড়ায় পশ্চিমা দেশগুলো দক্ষিণ বিশ্ব থেকে নিজেদের দূরত্ব সৃষ্টি করছে। বিপরীতে রাশিয়া দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলোর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসছে। এ ছাড়া ‘ঐতিহ্যগতভাবে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ’-এর মতো বিষয়কে পররাষ্ট্রনীতির অংশ করেছে রাশিয়া।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ কারণেই এই বাজারটিকে রাশিয়া তাদের পণ্য রপ্তানির নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই রাশিয়া এশিয়ামুখী হয়েছে, ইউরোপে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ করেই আসেনি তারা।
এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় শামিল হয়নি। এটি রাশিয়াকে তার কৌশলনীতি বাস্তবায়নে সুবিধা দিচ্ছে। মস্কোর কৌশলনীতি থেকে এটা পরিষ্কার যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নেতিবাচক প্রচারণা বরং উল্টো দক্ষিণ বিশ্বের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বসভ্যতা সম্পর্কে চীনের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। দুই দেশই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুমেরুর বিশ্বের কথা বলছে। এ ছাড়া আধিপত্য প্রতিরোধ ও অন্য সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলছে চীন ও রাশিয়া।
নীতিগত ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের এই মিল বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার আঁতাত এশিয়ার সামনে ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রাশিয়ান ও চীনাদের সম্পদ ও শিল্প এশিয়ার বিকাশ ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করবে।
মস্কোর আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও এশিয়ায় এখন পর্যন্ত রাশিয়ার উপস্থিতি অনেক কম। এশিয়ায় নোঙর গাড়ার জন্য এক দশকের বেশি সময় ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে আসছে রাশিয়া। এশিয়া রাশিয়ার কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এশিয়ার দিকে রাশিয়ার অবস্থান বদল পর্যায়ক্রমে, নির্দিষ্ট খাতে ও অল্প কয়েকটি দেশ দিয়ে শুরু হলেও সেটা দিন দিন আরও গভীর ও বিস্তৃত হবে।
- ওলেগ ইয়ানোভস্কি মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে রাজনৈতিক তত্ত্ব বিষয়ে প্রভাষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে