পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির মেরুকরণ

Daily Nayadiganta

পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির মেরুকরণ – ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বড় জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলো আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। মানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, নির্বাচনী এমন ফলের পেছনে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিকে চাই না, এই মনোভাবের ফায়দা পুরোটাই ঘরে তুলেছে তৃণমূল। তবে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের রাজনীতির পাটাতন আরো শক্ত করতে আগামী দিনে দলটি শুধু একে ফায়দা হিসেবেই দেখবে, না বাস্তবেও কাজে লাগাবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। মজার বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নীতিই কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের ধারা। এ রাজ্যে এটি তো বামফ্রন্টের নেতৃত্বেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বামদের করুণ পরিণতি। অন্য দিকে যতই দিন গেছে, রাজ্যের রাজনীতিতে বিজেপির স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। দলটি আদর্শিক দিক দিয়ে কোনো ধরনের রাখঢাক না করে দলীয় কার্যক্রম চালিয়েছে। এতে কোনো ধরনের লুকোচুরি ছিল না। তবে যে দলটা প্রায় গোটা ভারত মুঠোয় নিয়ে ফেলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে তারা কব্জা করতে পারল না। পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই বলেছিলেন, এ রাজ্যে বর্তমান সরকার আর টিকবে না। শাসক দল তৃণমূলকে পাততাড়ি গুটিয়ে ঘরে ঢুকে যেতে হবে। কিন্তু সেসব ধারণা উড়িয়ে দিয়ে মমতাই আবার ক্ষমতায় এলেন।

তৃণমূল এবার বামফ্রন্টের রেকর্ড স্পর্শ করেছে। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। তৃণমূলের এবারের ভোটের হার ওই নির্বাচনকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি বিশ্লেষকদের। এ দিকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রদত্ত ভোটের ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ পেলেও এবার তাদের ভোট কমে গেছে। ভোটের হিসাব অনুযায়ী, দলটি প্রদত্ত ভোটের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পেয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১১টিতে জিতেছিল তৃণমূল। সেবারও দলটির পক্ষে পড়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল যথাক্রমে প্রদত্ত ভোটের ৩৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির মোদি-অমিত শাহ জুটি সাঁড়াশি প্রচারণা চালায়। তবু রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ মমতার মমতাতেই আস্থা রেখে তার দলকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছে। ২১৩ আসনে জিতেছে দলটি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী মাঠে প্রবল উত্তাপ ছড়িয়েও শেষ পর্যন্ত কেন ধরাশায়ী হলো? জবাবে অল্প কথায় বলা যায়, বিজেপির ব্যর্থতার প্রাথমিক কারণ এই রাজ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা ভারতের অন্য অনেক প্রদেশের চেয়ে প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান। সাধারণ সাম্প্রদায়িক কৌশলে এখানকার ভোটাররা শেষ পর্যন্ত বিজেপির প্রতি ঝুঁকে পড়েনি। সচরাচর বিজেপির রাজনীতির মূল পুঁজি হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে নির্বাচনের মাঠে ফায়দা তোলা। এই পুঁজি নিয়ে দলটি প্রায় পুরো ভারতে জয় পেলেও গুটি কয়েক রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজয়রথ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিজেদের কর্মীবাহিনীর বাইরে ৭৫ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আবেদন এবার আগের তুলনায় কমেছে।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকায় এ রাজ্যের তরুণরা এক ধরনের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের আবহে বেড়ে উঠেছে, যা আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির জন্য সহায়ক নয়। তারা বিজেপির রাজনীতিকে স্বস্তি বিনষ্টকারী উপাদান হিসেবে দেখে থাকে। যা ধর্মভিত্তিক উন্মাদনার পালে তেমনভাবে হাওয়া লাগতে দেয়নি। একেবারে শেষ মুহূর্তে পাল ফুটো করে দিয়েছে, যা বিজেপি নেতৃত্ব টের পায়নি, কিংবা পেলেও কর্মীদের বুঝতে দেয়নি।

নির্বাচনী প্রচারে মোদি-অমিত শাহ জুটি গণ্ডায় গণ্ডায় জনসভা করেছেন। একটি রাজ্যের নির্বাচন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এতবার সফর ভারতীয় রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা। তবু ফল আশানুরূপ হয়নি। ভোটের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় শুধু হিন্দুত্ববাদী দল বলেই বিজেপিকে ভোট দেয়নি। যে রাজ্যের মোটামুটি ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোট, সেখানে হিন্দুরা যদি বিজেপিকে একচেটিয়া ভোট দিত, যেমনটা দিয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে, তবে নিঃসন্দেহে বিজেপি এ পর্যায়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকত। ২০১৪ সালের লোকসভা থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হিন্দু ভোট ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছিল। এই মেরুকরণ ২০২১ সালে আরো তীব্র হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি ব্যর্থ হলেও বিজেপিও ভোট পেয়েছে। সে জন্য বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি একেবারে ব্যর্থ হয়েছে, তা বলা যাবে না। হিন্দুদের একটা বড় অংশ অবশ্যই বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, তা না হলে বিজেপি যেখানে ২০১৬ সালে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল; সেখানে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে ৭৭ আসন। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোটের অনুপাত কমেছে। এর পরও বলা যায়, বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ, মানে ঘৃণার রাজনীতি ছড়াতে খানিকটা যে সক্ষম হয়েছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু অন্য সব রাজ্যের ক্ষেত্রে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর যেটা দেখা গিয়েছিল, সেটি এখানেও দেখা গেল। লোকসভা থেকে বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভোট কমেছে।

অন্য দিকে হিন্দুদের একটা বড় অংশ যে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে, তা-ও সত্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অনেকাংশে পাল্টে গেছে এই নির্বাচনে। এক দিকে একটা হিন্দু ভোটব্যাংক তৈরি হয়েছে, অন্য দিকে তৈরি হলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভোট। আর বামপন্থী ও কংগ্রেসপন্থীরা একেবারে মুছে গেল।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ব্যর্থতা থেকে কয়েকটি স্পষ্ট বার্তা মেলে। প্রথমেই যা ধরা পড়ে, তা হলো সংখ্যালঘুদের জন্য দলটির কোনো ইতিবাচক রাজনীতি নেই। বিজেপি পরিপূর্ণভাবে সংখ্যাগুরুর দল হয়ে পড়েছে, যা ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আদৌ মানানসই নয়। আবার যেহেতু উত্তর ভারতে বিজয়ের জন্য বিজেপি সংখ্যাগুরুর মনোরঞ্জনে জোর দেয়, সে কারণে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট রয়েছে; সেখানে এর নির্বাচনী সফলতার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতেও কম বলেই মনে হয়।

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের মর্যাদা পেলেও ক্ষমতায় আসতে বিজেপিকে অবশ্যই বড় অঙ্কের মুসলমান ভোট পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিজেপি রাজ্যের মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি অংশকে নিজেদের কাছে টানতে না পারলেও মুসলিম ভোটারদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে হবে। মুসলিম ভোটে ভাঙন ধরাতে বিজেপির তৎপরতাও ছিল। তবে এবার তা তেমন কাজে আসেনি। এসব কৌশল দীর্ঘমেয়াদে কতটা সফল হবে, সেটি ভবিষ্যৎই বলতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের রাজনীতিসচেতন এলাকায় মানুষ বিজেপিকে সেভাবে গ্রহণ করছে না, যতটা গ্রহণ করছে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কম গ্রহণযোগ্যতার কারণ এখানে শিক্ষার হার রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। একই সাথে হিন্দুত্বকে ব্যবহার করা ছাড়া বিজেপির হাতে বিকল্প কর্মসূচি নেই, যা দিয়ে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সব ভারতীয়ের কাছে যাওয়া যায়। এবারের নির্বাচনের ফল দেখে এ কথা বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনীতিকে যতটা জনজীবনের ইস্যু হিসেবে দেখে, ততটাই কম দেখে ধর্মযুক্ত বিষয় হিসেবে। বাঙালি সংস্কৃতির এই ভিন্নতা মোদি-অমিত শাহর নির্বাচনী কলাকৌশল অতিক্রম করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে মোটা দাগে সেটিই প্রমাণ হলো আবার।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিজয়রথ আপাতত থমকে দাঁড়িয়েছে। এই নির্বাচনের ফল কি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এর অগ্রযাত্রা থেমে যাওয়ার পূর্বাভাস? সর্বভারতীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফল কী প্রভাব ফেলে তা দেখার কৌতূহল রয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব মানুষের।

[email protected]