From Facebook 16 June 2021
পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে তরুণ শায়খ আদনান গুম হয়েছেন। গুমের দেশে তিনি কি শুধুই আরেকটি সংখ্যা?
তরুণ শায়খ আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন, ২০২১) দিবাগত রাত থেকে নিখোঁজ। তাঁর স্ত্রী সাবেকুন নাহার সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন আদনান বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। রাত ২টা ৩৭ মিনিটে সাবিকুনের সঙ্গে আদনানের শেষ কথা হয়। তিনি তখন বলেছেন, তিনি কাছাকাছি চলে এসেছেন। তিনি তখন গাবতলী ছিলেন। এরপর রাত ৩টা থেকে পরিবার আদনানের ফোন বন্ধ পেয়েছে। এখনো পর্যন্ত নম্বর বন্ধ। নিখোঁজ হওয়ার সময় গাড়ি চালকসহ আরো তিনজন সহকর্মী ছিলেন। ওই তিনজন সহকর্মী কিম্বা গাড়িটিরও কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার মানে গাবতলীতে কিম্বা ঢাকার মধ্যেই তিনি গুম হয়েছেন।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, শায়খ আবু ত্বহা মুহাম্মদ নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে দারুসসালাম ও মিরপুর থানায় গেলে কোনো থানাই সাধারণ ডায়েরি বা মামলা গ্রহণ করেনি। রোববার (১৩ জুন, ২০২১) সকালে রংপুর সদর থানায় এ নিয়ে একটি জিডি করা হয়েছে আদনানের মায়ের পক্ষ থেকে। দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ স্বীকার করেছেন যে কোনো সাধারণ ডায়েরি বা মামলা তারা গ্রহণ করেননি।
কারণ কি? তোফায়েল আহমদ বলছেন, ‘তিনি (আদনান) কোথা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সেই লোকেশনটা তো আমরা নিশ্চিত না। তিনি গাবতলী থেকে নিখোঁজ হয়েছেন, সেটা তো আমরা জানি না। সেক্ষেত্রে যেখান থেকে তিনি রওনা হয়েছেন, সেই রংপুর অথবা তার ঢাকায় যেখানে বাসা, সেখানে জিডি হতে পারে বা মামলা হতে পারে।’
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিকে অনুসন্ধানের জন্য পুলিশের আলাদা কোনো বিভাগ নেই।
দেখা যাচ্ছে গুম শুধু নয়, পুলিশ গুম হওয়া নাগরিকের পরিবারের অভিযোগও অস্বীকার করে, আমলে নেয় না। নাগরিকদের রক্ষা করবার দায় অস্বীকার করার অর্থ অপরাধীর অপরাধে সহায়ক হওয়া। আদনান ঠিক কোন্ জায়গা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেই মামলা নেয়া হয়নি বলে পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে। । কিন্তু এটা পরিষ্কার যে তিনি গাবতলীতে পৌঁছানোর পর গুম হয়েছেন। ঘটনা ঢাকাতেই ঘটেছে। অর্থাৎ আদনান কোথায় নিখোঁজ হয়েছেন সেটা অনিশ্চিত দাবি করার কোন সুযোগ নাই। রোববার সকালে রংপুর সদর থানায় আদনানের মায়ের পক্ষ থেকে শুধু একটি জিডি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।
চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, দায়িত্বশীল হাতে গোনা দুই একটি পরিচিত মানবাধিকার সংগঠন শুরু থেকেই আদনানের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আলেম কিম্বা টুপিকোর্তা পরা মাদ্রাসার ছাত্রদের ‘মানবাধিকার’ থাকতে পারে এটা অনেক ‘মানবাধিকার সংগঠন’ (?) বিশ্বাস করে না। আমি এখন যেসকল ‘বিশিষ্ট ব্যাক্তি’দের নামে দৈনিক পত্রিকায় বিবৃতি ছাপা হয়, যাদের বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রায়শই যারপরনাই উদ্বিগ্ন দেখা যায়, তাদের মহান বিবৃতির জন্য অপেক্ষা করে আছি। মিনতি জানিয়ে রাখলাম। আশা করি তাঁরা কবুল করবেন। আমার কথায় কারো আহত হওয়ার কিছু নাই। এলিট শ্রেণী ধর্ম বিদ্বেষের কারণে মাদ্রাসার ছাত্র, টুপিকোর্তা পরা ধর্ম্প্রাণ মুসল্মান কিম্বা ইসলামপন্থিদের মানবাধিকার স্বীকার করে না। এই অভিযোগ আমরা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে করছি বলে চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও আজকাল অনেকে সাড়া দিচ্ছেন। তাদের জন্য দোয়া করি। কিন্তু এখনও তাদের তরফে কোন বিবৃতি আসে নি।
এবার আমার দুই একটি কথা:
১. আমি বাংলাদেশের তরুণ আলেমদের খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্বেক্ষণ করি। কারণ আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝি যে আগামি দিনের জাতীয় নেতৃত্ব তাদের হাতেই ন্যস্ত হবে ইসলাম সম্পর্কে যাদের পরিচ্ছন্ন চিন্তা রয়েছে, কিম্বা যাদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে কোন প্রকার হীনমন্যতা নাই। কোন জনগোষ্ঠিকে বিশ্বসভায় শক্ত স্থান আদায় করতে হলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বহু আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। সেই ক্ষেত্রে ইসলামের আভ্যন্তরীণ তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের (discursive tradition) সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণদের পরিচিত হওয়া খুবই জরুরী কাজ। সেটা আরও বেশী দরকার যেন ইসলামকে আমরা সংকীর্ণ জাতিবাদ কিম্বা পরিচয়সর্বস্ব সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে পরিণত করে না ফেলি। এই কাজটি সঠিক ভাবে আমাদের জ্ঞানচর্চার তরিকায় আয়ত্ব করতে পারলেই আমরা পরবর্তী উন্নত চিন্তা ও পর্যালোচনার স্তর — অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও রুহানিয়াতের জগতে প্রবেশ করতে পারব। এই দিক থেকে আদনান তরুণ আলেমদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মূর্খদের দেশ বলে আমরা অনেকে তার নাম জানি না।
আমি তরুণ আলেমদের ফেইসবুক অনুসরণ করি এবং মনোযোগের সঙ্গে তাদের ওয়াজ শুনি। সেই অভিজ্ঞতা ও সতর্ক পর্যালোচয়ান থেকেই বুঝতে পারি এদের মধ্যে মাত্র ৩১ বছর বয়স্ক শায়খ আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নীচে আমি তাঁর একটি ভিডিও শেয়ার করছি। তাঁর পঠনপাঠন, বাচনভঙ্গী, তথ্য ও পর্যালোচনা বাংলাদেশে ধর্মতাত্ত্বিক তর্কবিতর্ককে খুবই পরিশীলিত ও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। যে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তিনি কথা বলেন তা, বলা বাহুল্য, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের অনন্ত যুদ্ধের বিপরীতে নতুন ভাবে মজলুম বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করে। বলাবাহুল্য, তাঁকে গুম করা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয় মোটেও।
২. কিন্তু গুম, আইনবহির্ভুত হত্যা এবং জুলুমের যে প্যাটার্ন আমরা দেখছি তার গূঢ় পরিকল্পনাটি এখন আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই দিকটা বোঝা দরকার। খুনি মোদীর বাংলাদেশে আগমন বাংলাদেশের জনগণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রতিহত করেছে। সেই প্রতিরোধে সম্প্রতিকালে কমপক্ষে উনিশজন শহিদ হয়েছেন, বহু হতাহত হয়েছেন। যাদের গুম করা হচ্ছে তারা সেই প্যাটার্নেরই ধারাবাহিতা। খুনি ও হিন্দুত্ববাদী মোদীর প্রতিরোধেরঙ্কখেত্রে যে সকল তরুণ নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই বিশেষ ভাবে এবং ব্যাপক ভাবে ধরপাকড় করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক তরুন এখন কারাগারে। আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনানের গুম হওয়া একটা সামগ্রিক প্যাটার্নের অন্তর্গত। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করা। বিশেষত আগামি দিনে নেতৃত্বের গুণ সম্পন্ন তরুণদের ধ্বংস করা। তরুণদের বেছে বেছে গুম, আইনবহির্ভূত ভাবে হত্যা করা, জেলজুলুম অত্যাচার জোরদার করা নতুন প্যাটার্ন আমরা লক্ষ করছি। সেই প্যাটার্ন অনুসরণ করেই এখন দিল্লীর আগ্রাসন ও তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য গুম, আইনবহির্ভূত হত্যা এবং জুলুম চলছে।
৩. আমরা একটি পরাধীন দেশ। সেটা এক কথা — কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে তরুণ নেতৃত্বকে সমূলে নিঃশেষ করা ভয়ংকর একটি নীতি। তরুণ শায়খ আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান বিরল তরুণ। যারা তাঁকে চেনেন না তাঁদের অবগতির জন্য তরুণ শায়েখের একটি ভিডিও শেয়ার করছি। দয়া করে শুনবেন।
৪. ইসলামি ধর্মতত্ত্বে বাংলাদেশে শক্তি ও সামর্থ বৃদ্ধির অর্থ ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনার জন্য উপযূক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তৈরি করা। ইসলামের অবশ্যই নিজের কিছু বলার আছে, বাংলাদেশে চিন্তাচেতনার বিকাশের জন্য মনোযোগের সঙ্গে সেটা অবশ্যই অধ্যয়নের দরকার আছে। দেখা যাচ্ছে সাধারণ ভাবে চিন্তাচেতনায় এবং বিশেষ ভাবে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় বাংলাদেশকে পশ্চাতপদ করে রাখার পরিকল্পনাই আদনানকে গুম করার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। গুম, আইনবহির্ভূত হত্যা এবং তরুণদের ব্যাপক ভাবে গ্রেফতার ও কারাগারে নিক্ষেপ বাস্তবায়নের প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়।
অতএব আদনানের গুম হওয়াটা খুব সহজ ব্যাপার না। মনে হচ্ছে আমরা পরাধীন দেশের রাজমৈতিক পরিমণ্ডলে আরেকটি রক্তক্ষয়ী স্তরে প্রবেশ করেছি।
গুম নিয়ে আলোচনা করলে আমরা সাধারণত সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু গুমের সংখ্যা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একই ভাবে এখন কারা গুম, হত্যা ও জেলজুলুমের শিকার হচ্ছে সেই তথ্য আরো তাৎপর্যপূর্ণ। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১১ জন গুম হয়েছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য ছিল, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গুম হওয়া ৫৩২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে।
সংখ্যা দরকার। কিন্তু আরো বেশী দরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে শত্রুর সামরিক নীতির প্রতি ঘনিষ্ঠ নাগরিক নজরদারি।
আমার পর্যবেক্ষণ তখনই ভুল হবে যদি আদনানকে জীবিত খুঁজে পাওয়া যায় এবং যদি ক্ষমতাসীনরা নরেন্দ্র মোদী বিরোধী প্রতিরোধে গ্রেফতার হওয়া সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দেয়।
আদনানকে ফিরিয়ে দিন, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিন।